হিজড়া হওয়ার লক্ষণ - Signs of being transgender
প্রতিটা হিজড়ার জন্ম হয় একজন ছেলে সন্তান হিসেবে। কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালে ধীরে ধীরে সেই ছেলের মধ্যে মেয়েলিভাব প্রকাশ পেতে থাকে।
তার শরীর ছেলের হলেও মনমানসিকতা হয় মেয়েদের মতো। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার এই মনগজগতের পরিবর্তনের ফলে তার চালচলন কথাবার্তা এবং ব্যবহারে মেয়েলিপনা প্রকাশ ঘটতে থাকে। এভাবেই একজন ছেলে হয়ে জন্ম নেওয়ার পরেও ধীরে ধীরে হিজড়া, ট্রান্স জেন্ডার, বৃহন্নলা, উভয় লিঙ্গ বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষে পরিণত হয়।
হিজড়া কাকে বলে
“হিজড়া” শব্দটি একটি উর্দু শব্দ, যা সেমেটিক আরবি ধাতুমূল হিজর থেকে “গোত্র হতে পরিত্যাক্ত” অর্থে এসেছে। পরবর্তীতে তা বাঙলা এবং হিন্দি ভাষায় বিদেশী শব্দ হিসেবে প্রবেশ করেছে। শব্দটির ভারতীয় ব্যবহারকে প্রথাগতভাবে ইংরেজিতে “ইউনাক” (Eunuch, অর্থঃ খোজা) বা “হারমাফ্রোডাইট” (hermaphrodite, অর্থঃ উভলিঙ্গ) হিসেবে অনুবাদ করা হয়, যেখানে “পুং জননাঙ্গের অনুপস্থিতি” বোঝানো হয়। সাধারণত অধিকাংশ হিজড়াই স্বাভাবিক পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণকারী, তবে এদের মধ্যে আন্তঃলিঙ্গ বৈচিত্র্য নিয়ে জন্মানো অল্পসংখ্যক সদস্যও রয়েছে। ইংরেজীতে একে ট্রান্সজেন্ডার (Transgender) বলা হয়।
বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে গেলে, ভ্রূণের বিকাশের সময় অস্বাভাবিক মাত্রার যৌন হরমোন হিজড়া জন্ম দেওয়ার প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়।
অনেক সময় কোনও শিশু এমন যৌনাঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে যেগুলি পুরুষ বা মহিলা হিসাবে পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না, এদের যৌনাঙ্গ অস্পষ্ট। বৈজ্ঞানিকভাবে এরা ambiguous genitals বা ইন্টারসেক্স অবস্থা (intersex state) হিসাবেও পরিচিত।
তবে বেশিরভাগ ব্যক্তি হলেন সিউডো-হার্মাফ্রোডাইটস অর্থাৎ তাদের অস্পষ্ট বাহ্যিক যৌনাঙ্গ থাকে এবং তাদের ডিম্বাশয় বা টেস্টিস কোনো একটি থাকে তবে উভয়ই হয় না। জেনেটিকভাবে সিউডো-হার্মাফ্রোডাইট বলতে পুরুষ বা মহিলা হিজড়া বলা হয়।
হিজড়া এর প্রকারভেদ
আধুনিক জেনেটিক্স বা চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে হিজড়া হলো সেক্র ক্রোমোজমের ত্রুটিপূর্ণ বিন্যাস (Chromosomal Aberration) বা জিন জনিত জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধি ব্যাক্তি যাদের জন্ম পরবর্তী সঠিক লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়।
প্রাকৃতিক ভাবে চার ধরনের হিজড়া হলেও আজকাল অসৎ উদ্দেশ্যে নারী পুরুষদের অপারেশন ও হরমোণ পরিবর্তণ করে হিজড়া বানানো হয়।
এদের প্রধান সমস্যা গুলো হল এদের লিঙ্গে নারী বা পুরূষের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকে না। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় লিঙ্গ নির্ধারক অঙ্গ থাকে না। এসবের উপর নির্ভর করে তাদেরকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায।মূলত এটি একটি শারীরিক গঠনজনিত সমস্যা যা অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের মতই কিন্তু প্রতিবন্ধকতার স্থানটি ভিন্ন হওয়াতেই তারা হিজড়া।
হিজড়াদের শারীরিক গঠন মূলত ৪ প্রকার। কিছু হিজড়া হলো যাদের মধ্যে নারী নারী জননাঙ্গ থাকে না। আবার কিছু হিজড়া হলো যাদের পুরুষের সকল বৈশিষ্ট্য থাকা সত্বেও পুরুষ জননাঙ্গ থাকে না। এছাড়া কিছু হিজড়ার উভয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। কারো কোনোটাই থাকেনা। আর শারীরিক ও মানসিক গঠনের উপর নির্ভর করে এদেরকে ৬ ভাগে ভাগ করা যায়।
শারীরিক ভাবে পুরুষ কিন্তু মানষিক ভাবে নারী বৈশীষ্ট্য এর অধীকারী হিজড়াদের বলা হয় অকুয়া, ঠিক বিপরীত হিজড়াদের বলা হয় জেনানা, আর মানুষের হাতে সৃষ্ট বা ক্যাসট্রেড পুরুষদের বলা হয় চিন্নি।
যদি কোন হিজরা নারী পুরুষাঙ্গের অধিকারী হয় আর সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হয় তবে এদের নারী ধরা হয়। ইসলামে হিজড়াদের অস্তিত্ব স্বীকার করা হলেও গোপনাঙ্গের ধরণের ভিত্তিতে হিজড়াদের নারী অথবা পুরুষের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
সেই অনুযায়ীই তাকে পর্দা, নামায, রোযা পালন করতে হবে, এমনকি সে মোতাবেক সম্পদের ভাগ ভাটোয়ারা করে দেয়া হয়েছে। যদিও আমাদের সমাজে হিজড়াদের পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়।
চিকিৎসা ভাষায়
মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বয়স আট সপ্তাহ হওয়া পর্যন্ত জরায়ুতে পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গ নির্ধারক দুটি নালিই সামান্তরালভাবে থাকে। সন্তানটি যদি মেয়ে হয়, তাহলে পুরুষ লিঙ্গ নির্ধারক নালিটি প্রাকৃতিকভাবে অপসৃত হয়। ছেলে হলে ঘটে ঠিক তার উল্টোটা। কিন্তু হিজড়াদের শরীরে দুটি নালিই থেকে যায়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিজড়াদের ডিম্বাশয় ও শুক্রাশয় থাকে, একই সঙ্গে জরায়ু ও পুরুষদের যৌনাঙ্গ থাকে। তবে কোনোটিই পুরোপুরি বিকশিত হতে পারে না। ডিম্বাশয় থেকে নারীদেহের হরমোন ইস্ট্রোজেন এবং শুক্রাশয় থেকে পুরুষদেহে থাকা এন্ড্রাজেন নির্গত হয়। এতে করে কারও কারও স্তন তৈরি হয়, কারও কারও দাড়ি-গোঁফও হতে পারে।
চিকিৎসকেরা বলেন, বাংলাদেশে শিশুর সুপ্ত পরিচয় জানতে প্রথমেই চিকিৎসকেরা ক্রোমোজোমাল অ্যানালাইসিস করেন। শিশুটির মধ্যে যে লিঙ্গের প্রভাব বেশি, তাতেই তাকে রূপান্তর করা হয়।
এটা জন্মগত ত্রুটি
হিজড়া/লিঙ্গান্তর এক ধরনের ইন্টার সেক্স ডিজঅর্ডার (আইএসডি) বা ডিজঅর্ডারস অব সেক্সুয়াল ডেভেলপমেন্ট (ডিএসডি) জাতীয় জন্মগত ত্রুটি।
কয়েকটি ইন্টার সেক্স ডিজঅর্ডার হলো : কঞ্জেনিটাল এড্রিনাল হাইপার প্লাসিয়া, অভোটেস্টিকুলার ডিজঅর্ডার অব সেক্স ডেভেলপমেন্ট, টেস্টোস্টারন বায়োসিন্থেসিস ডিফেক্ট, এস্ট্রোজেন ইন্সেসিটিভিটি সিনড্রোম, গোনাডাল ডিসজেনেসিস ইত্যাদি।
বোঝার উপায়
কোনো শিশু হিজড়া হয়ে জন্ম নিচ্ছে কি না তা বোঝা সম্ভব। এ জন্য জন্মের পরপরই শিশুদের নাক, কান, চোখ, মুখগহবর, হাত-পা, মলদ্বার, যৌনাঙ্গ ইত্যাদি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অনেক শিশুর যৌনাঙ্গ দেখে ছেলে বা মেয়ে বুঝতে অসুবিধা হয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাই পরবর্তীতে হিজড়া হয়। আবার অনেক শিশু ছোট বেলায় নিখুঁত মেয়ে বা ছেলে হিসেবে বড় হয়; কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালে লিঙ্গান্তর ঘটে ছেলে ও মেয়ে হয়; আবার মেয়ে ছেলে হয়। এদের অনেকেরই যতই লিঙ্গান্তর হোক না কেন পূর্বের লিঙ্গের কিছু বৈশিষ্ট্য থেকে যায়। ফলে সমাজে তারা হিজড়া হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ
হিজড়া হওয়ার মতো জন্মগত ত্রুটির সঠিক কারণ জানা যায়নি।
তবে এ জন্য কিছু বিষয়কে দায়ী করা হয়, যেমন—
► গর্ভাবস্থায় ভুল ওষুধ সেবন। বিশেষ করে হরমোনজাতীয় ওষুধ
► পরিবেশ দূষণ/তেজস্ক্রিয়তা
► নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে
► ক্রমোজমের সমস্যা ইত্যাদি।
করণীয়
► পরিকল্পিত গর্ভধারণ। গর্ভধারণের আগে থেকেই নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে থাকা।
► নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে পরিহার করা
► গর্ভধারণের আগে/গর্ভধারণ অবস্থায় তেজস্ক্রিয়তা থেকে দূরে থাকা।
► চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন না করা।
পরীক্ষা
ক্রমোজম অ্যানালিসিস, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, হরমোন পরীক্ষা ইত্যাদি।
সতর্কতা
শিশুর যৌনাঙ্গ নিয়ে কোনো সন্দেহ হলে অথবা শরীরে কোনো প্রকার অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখলে সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
চিকিৎসা
চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে হিজড়ারা ছেলে কিংবা মেয়ে হিসেবেই বেড়ে উঠতে পারবে এমনকি তাদের অনেকে সন্তান জন্মদানও করতে পারবে। তবে চিকিৎসা নির্ভর করছে কোন বয়সে যৌনাঙ্গ বা শরীরে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয় তার ওপর। এ জন্য প্রথমেই শিশুর ক্রমোজম অ্যানালিসিস করে জেনো টাইপ ঠিক করে নিতে হবে। অনেক সময় তা সম্ভব না-ও হতে পারে। অস্বাভাবিকতার সঠিক কারণ নির্ধারণ করে মা-বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনে সন্তান সাবালক হলে তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে ঠিক করতে হবে সে পুরুষ হবে, না নারী হবে। অস্বাভাবিকতার ওপর নির্ভর করে চিকিৎসাব্যবস্থা, অপারেশন বা ওষুধ। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নিলে তারা পুরুষ কিংবা নারী হিসেবেই বেড়ে উঠবে। অনেকে মা-বাবাও হতে পারবে।