
থানচির দর্শনীয় স্থান - Thanchi Travel Guide
অপরূপ সৌন্দর্যের লীলভূমি বান্দরবান জেলা। এ জেলায় রয়েছে পর্যটকদের জন্য নয়ন ও প্রাণজুড়ানো সব দর্শনীয় স্থান। বান্দরবান থেকে থানচির পথে বান্দরবান শহর থেকে থানচি যাওয়ার সাধারণ উপায় হচ্ছে বাস অথবা চাঁদের গাড়ি।
থানচির দূরত্ব প্রায় ৭৫ কিলোমিটার। বাসে গেলে প্রায় চার ঘণ্টার জার্নি আর চাঁদের গাড়িতে তিন ঘণ্টা লাগে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে থানচির বাস চলা শুরু হয় এবং দেড় ঘণ্টা পরপর একটি বাস ছাড়ে। আর বাসস্ট্যান্ডের পাশেই আছে চাঁদের গাড়ির কাউন্টার, সেখান থেকে যে কোনো সময় গাড়ি বুক করা যায়। বান্দরবান শহর থেকে রওনা দিলেই কয়েক মিনিট পরেই একের পর এক পাহাড়ি গ্রামের দেখা মেলে আর সঙ্গে দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ের সারি। যেদিকে তাকাবেন যেন সবুজ আর সবুজ। চোখের প্রশান্তির সঙ্গে আছে প্রাণভরে বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার শান্তি। শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে গেলেই একটি ঝর্ণার দেখা মিলবে।
ঝর্ণার পাশেই অবস্থিত বাজার ও পাহাড়ি গ্রামেও কিছু সময় কাটাতে পারেন। আবার গাড়ি চলতে শুরু করবে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে। গাড়ির ডান পাশে তাকালে হয়তো দেখছেন এক বিশাল পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে, আর বাঁ পাশে দূর পাহাড়ের মাঝে আদিবাসী গ্রাম। শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে পৌঁছালেই হাতের ডানে পড়বে চিম্বুক পাহাড়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই পাহাড়ে উঠতে আপনাকে তাই ট্র্যাকিং শুরু করতে হবে। কিছুটা কষ্ট হলেও যখন উঁচু থেকে একদিকে সাঙ্গু নদীর বয়ে চলা এবং পাহাড়ের সারি দেখবেন, তখন কষ্টের কথা ভুলে যাবেন। এই পথেই শহর থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে বাংলার দার্জিলিংখ্যাত নীলগিরি পর্যটনকেন্দ্র। এই কেন্দ্রে দেখা হয়ে যেতে পারে মেঘের সঙ্গে। মেঘ আপনাকে ছুঁয়ে দেবে। যদি পরিস্কার দিনে যান, তাহলে কেওক্রাডংসহ বিশাল বিশাল পাহাড়ের সারি, সাঙ্গু নদী ও বগা লেকের দেখা পেয়ে যেতে পারেন। পথ দিয়ে চলতে চলতে আদিবাসী বাজার, আদিবাসী গ্রাম, জুম চাষ, পাহাড়ি পশুপাখি, নতুন নানা রকমের গাছ ও বিশাল বিশাল ফলের বাগানের দেখা পেয়ে যাবেন। আশপাশের সৌন্দর্য আপনাকে চোখ ফেরাতে দিতে চাইবে না।
কিন্তু এরপর যখন চার ঘণ্টা জার্নি করে থানচি বাজারে পৌঁছাবেন, তখন চারপাশের পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা সাঙ্গু নদী আপনাকে আরও বেশি মুগ্ধ করবে। বাজারে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে নদীতে তাকালে দেখতে পাবেন একের পর এক ইঞ্জিন নৌকা সাজিয়ে রাখা। এই অপরূপ দৃশ্য যেন ছবিতে আঁকা কোনো ক্যানভাসের মতো! থানচি থেকে আপনি সাকা হাফং, নাফাখুম জলপ্রপাত, আমিয়াখুম জলপ্রপাত, ছোট পাথর (তিন্দু), বড় পাথর বা রাজা পাথর, তমা তুঙ্গী, বাকলাই জলপ্রপাতসহ অপরূপ সব স্থানে ঘুরতে যেতে পারবেন। মূলত এই বাজার থেকেই সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করলে ওরা একজন গাইড দিয়ে দেয়, সেই গাইডের মাধ্যমে নৌকা বা ট্রলার ভাড়া করে রেমাক্রি যেতে হয় এবং সেখান থেকে বিভিন্ন জলপ্রপাতে যাওয়া যায়।
নীলগিরি, থানচি
নীলগিরি বান্দরবান জেলায় অবস্থিত একটি পাহাড় ও জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। নীলগিরিকে বলা হয় বাংলাদেশের দার্জিলিং। যেখানে গেলে মেঘের খেলা দেখার জন্য আর ভারতের দার্জিলিং যাওয়া লাগে না। নীলগিরি পাহাড়টি বান্দরবান জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়টি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ ফুট উঁচুতে। এই পাহাড়ের চূড়ায়ই আছে সেনাবাহিনী পরিচালিত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটনকেন্দ্রগুলোর একটি ‘নীলগিরি পর্যটনকেন্দ্র’। নীলগিরি পর্যটনকেন্দ্রে ঢুকতে টিকিট বাবদ জনপ্রতি ৫০ টাকা ও গাড়ির জন্য আলাদা ৩০০ পার্কিং ফি নেওয়া হয়।
নীলগিরি যাওয়ার পথে রাস্তের দু’ধারেই পাহাড়, পাহাড়ের বুকে অসংখ্য কলাগাছের চাষ হয়। পথিমধ্যে পরিশ্রমী পাহাড়ি মানুষদের দেখা যায়। অনেকের হাতে দেখা যায় দা-কোদাল। এক লেনের রাস্তায় তীব্র গতিতে ছুটে যায় চান্দের গাড়ি।
পাহাড়ি রাস্তার দুই থেকে আড়াই হাজার ফুট নিচেও দেখা যায় চোখ ধাঁধানো মোলায়েম সবুজ দৃশ্য। বান্দরবান শহর থেকে নীলগিরি ৪৬ কিলোমিটার দূরের ভ্রমণ। দু’ ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় হয় সেখানে পৌঁছাতে। নীলগিরিতে বেলা ১১টার পর মেঘ চোখের সামনে কুয়াশার মতো উড়তে শুরু করেছিল। একদম স্বচ্ছ একটা পরিবেশের সাক্ষী হওয়ার জন্য বান্দরবান যাওয়া উচিত।
চিম্বুক পাহাড়, থানচি
বান্দরবান জেলা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এটি বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম পর্বত। চান্দের গাড়ি দিয়ে চিম্বুক ভ্রমণের সময় এর চারপাশের নয়নাভিরাম প্রকৃতির দৃশ্য দেখা যায়। দর্শনার্থীরা যখন এই জায়গা থেকে নিচের দিকে তাকায়, তারা মেঘের ভেলা দেখে অবাক হয়ে যায়। বান্দরবান শহর থেকে পৌঁছাতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে বিকাল ৪টার পর চিম্বুক-থানচি রুটে কোনো যানবাহন চলবে না। তাই চিম্বুক পাহাড়ে যেতে হলে সেই সময়ের আগেই যেতে হবে। সাধারণত পর্যটকরা চিম্বুক, নীলগিরি, মিলনছড়ি, এবং শৈলপ্রপাত ঝর্ণা একসঙ্গে দেখার জন্য গাড়ি ভাড়া করে।
শৈলপ্রপাত ঝর্ণা, থানচি
মিলনছড়ির এই জলপ্রপাতটি থানচি থানা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে। এর অত্যন্ত ঠাণ্ডা এবং স্বচ্ছ পানিতে প্রচুর পাথর দেখা যায়। ঝর্ণাটি স্থানীয়দের জন্য বিশুদ্ধ পানির একটি বড় উৎস। জলপ্রপাতের বাইরে একটি বাজারও রয়েছে যেখানে পর্যটকরা তাঁত পণ্য এবং স্থানীয় খাদ্য সামগ্রী কিনতে পারেন। এখান থেকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংগ্রামী জীবন গভীরভাবে অবলোকন করা যায়। বান্দরবানের অন্যতম আকর্ষণ চিম্বুক পাহাড় ও নীলগিরির পথের মাঝেই পড়ে শৈলপ্রপাত। তাই নীলগিরি ভ্রমণের গাড়ি মাঝ পথে থামিয়ে এই ঝর্ণা দেখে নেয়া যায়।
তিন্দু, থানচি
বাংলাদেশের নায়াগ্রা নামে পরিচিত তিন্দুর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড়ি নদী সাঙ্গু। পাহাড়, মেঘ, নদী, জলপ্রপাত, রহস্য, রোমাঞ্চ সবই এখানে পাওয়া যায়, তাই তিন্দু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ভ্রমণকারীদের জন্য অন্যতম প্রিয় আকর্ষণ। বান্দরবান থেকে থানচি উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৭৯ কিলোমিটার। বান্দরবান থেকে থানচি যাওয়ার পথে মিলনছড়ি, চিম্বুক, নীলগিরি পড়ে। এই দীর্ঘ পথে চারপাশের সুন্দর প্রকৃতি দেখতে দেখতে চোখ ও মন দুটোই সতেজ হয়ে যায়। থানচি ঘাট থেকে ছোট ইঞ্জিনের নৌকা ভাড়া করে প্রায় দুই ঘণ্টায় থানচি থেকে তিন্দু পৌঁছানো যায়। এ সময় যাত্রাপথে সাঙ্গু নদীর মনোমুগ্ধকর রূপের অভিজ্ঞতা নেয়া যায়।
কিভাবে যাবেন:
থানচি যেতে চাইলে প্রথমে আপনাকে বান্দরবান শহরে যেতে হবে। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন বান্দরবানের উদ্দেশ্যে কয়েকটি পরিবহন কোম্পানির গাড়ি ছেড়ে যায়।
যেমন শ্যামলি, হানিফ, ইউনিক, এস আলম, ডলফিন- এর যেকোনো একটি বাসে চড়ে আপনি বান্দরবানের যেতে পারেন। রাত ১০ টায় অথবা সাড়ে ১১টার দিকে কলাবাগান, সায়েদাবাদ বা ফকিরাপুল থেকে এসব বাস বান্দরবানের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। নন এসি বাসে জন প্রতি ভাড়া ৫৫০ টাকা।
আপনি চাইলে প্রথমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম। তার পর চট্টগ্রাম থেকে থেকে বান্দরবান হয়েও যেতে পারেন। বদ্দারহাট থেকে বান্দারবানের উদ্দেশে পূবালী ও পূর্বানী পরিবহনের বাস যায়। এসব বাসে জনপ্রতি ২২০টাকা ভাড়া রাখা হয়।
ঢাকা থেকে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাস চড়লে আপনি সকাল ৭:৩০ এর মধ্যেই বান্দারবান পৌঁছে যাবেন। তারপর বান্দরবান জেলা শহরে নাশ্তা সেরে চান্দের গাড়ি নিয়ে সোজা থানচির উদ্দেশে রওনা হবে।এক্ষেত্রে গ্রুপে গেলে ভালো হয়। তাতে খরচ কম হবে। আপনি চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করে নিতে পারেন। তবে এতে খরচ পরবে তিন থেকে চার হাজার টাকা। বান্দরবান শহর থেকে থানচি উপজেলা সদরের দূরত্ব ৮২ কিলোমিটার।
বান্দরবান শহর থেকে থাচনি যাওয়ার পথে চাইলে মাঝে বলিপাড়ায় কিছুক্ষণ যাত্রা বিরতি নিতে পারেন। সকালে রওনা দিলে দুপুরের মধ্যে থানচি পৌছে যাবেন। থানচিতে ব্রীজ নির্মাণ করায় এখন নদী পার হওয়ার ঝামেলা নেই।তারপর সাংগু হেটে পার হয়ে থানচি বাজারে পৌঁছাবেন।
তবে এক্ষেত্রে আপনাকে সবার আগের যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে বিজিবিকে আপনার পরিচয় দিয়ে তাদের নিকট থেকে অনুমতি নেওয়া। যাত্রা পথে যে বাজারটি পরবে সেখান থেকে খাওয়া দাওয়া করে নিতে পারেন। খুব সুলবেই আপনি এখান থেকে খাওয়া দাওয়ার করতে পরবেন।
বাজার থেকে অপনাকে নৌকা ভাড়া করতে হবে। এখানে আলাদা কোন গাইড পাওয়া যায় না। তাই নৌকার মাঝিই আপনার গাইডের কাজ করবে। নৌকা ভাড়ার খরচ নির্ভর করবে দিনের পরিমানের ওপর। নৌকা ভাড়ার জন্য আপনাকে দিনপ্রতি প্রায় ৮শ থেকে ৯শ টাকা গুনতে হবে।
মোবাইল নেটওয়ার্ক:
থানচি, তিন্দু দুই জায়গাতেই মোবাইল নেটওয়ার্ক (জিপি, রবি, টেলিটক, সিটিসেল) আছে। নিজের মোবাইল সাথে না নেয়াই ভালো। বাড়তি বোঝা বলে মনে হবে। দোকান থেকেই প্রয়োজনীয় কথা সেরে নিতে পারবেন। নিলেও নোকিয়া জাভা সেট নিয়ে যাবেন, চার্জ অনেক দিন থাকে।
আপনার মতামত লিখুন