কালাপাহাড়, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার-Kala Pahar, Kulaura, Moulvibazar
মৌলভীবাজারের দর্শনীয় স্থান কালা পাহাড় বাংলাদেশের উত্তর অংশের সর্বোচ্চ পাহাড় বিন্দু বা চূড়া। এটি সিলেটেরও সর্বোচ্চ পাহাড়চূড়া। এর উচ্চতা প্রায় ১১০০ ফুট। এর এক পাশে বাংলাদেশের কুলাউড়া-জুড়ী সীমান্ত ও অন্য পাশে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত। পাহাড়টি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের রবিরবাজারের নিকটে বেগুনছড়া পুঞ্জিতে অবস্থিত। কুলাউড়া শহর থেকে কালা পাহাড়রের দূরত্ব আনুমানিক ৩৫ কিলোমিটার এবং আজগরাবাদ চা বাগান থেকে এর দূরত্ব মাত্র চার কিলোমিটার।
কালা পাহাড়রের প্রায় ৬০ শতাংশ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত এবং বাকি অংশ ভারতের উত্তর ত্রিপুরার অন্তর্ভুক্ত। ত্রিপুরা রাজ্যে পাহাড়টি রঘুনন্দন নামে পরিচিত। বাংলাদেশে পাহাড়টির সর্বোচ্চ চূড়ার স্থানীয় নাম `কালা পাহাড়` এবং পাহাড়ের পর্বতশ্রেণীকে স্থানীয় ভাষায় লংলা পাহাড় শ্রেণী ডাকা হয়। তবে পাহাড়টি ‘হারারগঞ্জ পাহাড়’ নামেও পরিচিত বলে মনে করেন, বাংলাদেশ জিওগ্রাফিক সোসাইটি।
কালা পাহাড় এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
কালা পাহাড়ের চূড়া থেকে অসাধারণ সব দৃশ্যও চোখে পড়ে। পাহাড়ের চূড়া থেকে উত্তর-পূর্বাংশের দিকে তাকালে দেখা যায় জুড়ি উপজেলায় অবস্থিত রাজকি চা বাগান ও ফুলতলা বাজার। পূর্ব–দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর জেলার প্রধান শহর ধর্মনগরের একাংশ চোখে পড়বে। শরৎকালে আকাশ পরিষ্কার থাকলে এর চূড়া থেকে হাকালুকি হাওরে মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা যায়। ভারতের মেঘালয়ের পাহাড় গুলোর দৃশ্য এই পাহাড় থেকে সবসময় দেখা যায়।
বর্ষাকালে এই পাহাড়ের চূড়া থেকে একদম কাছাকাছি মেঘের খেলা উপভোগ করা যায়। সেসময় ঝিরি পথে যাবার পথে বেশ কিছু ছোট ছোট ঝর্ণার দেখা মিলে। বৃষ্টির দিনে সেখানের ছড়া পথে অধিবাসীরা ভেলা করে যাতায়াত করে।
এ পাহাড়ে রয়েছে আকর্ষণীয় বেশ কয়েকটি ঝরনা। এখন পর্যন্ত মানুষের দর্শন পায়নি এমন বেশ কয়েকটি ঝরনাও রয়েছে এখানে।
কালাপাহাড়ের সাতটি আকর্ষণীয় ঝরনা হলো-পাষাণের ধর ঝরনা, বেলকুমা ঝরনা, জাহাজমারা বাবা ঝরনা, উপলিয়া সং ঝরনা, শোলকুটার সং ঝরনা, জাহাজমারা পাদদেশ-১ ও জাহাজমারা পাদদেশ-২ ঝরনা। এসব ছাড়াও ছোট-বড় আরও কয়েকটি জলপ্রপাত রয়েছে এ পাহাড়ে, যা পর্যটকদের মুগ্ধ করবে।
কালা পাহাড় এর পথ
আজগরাবাদ চা বাগান থেকে বেগুনছড়া পুঞ্জি যাওয়ার সময় পথে পাওয়া যাবে ফানাই নদীসহ আরো আটটি পাহাড়ি বড় বড় খাল। এছাড়াও বেগুনছড়া থেকে কালা পাহাড় যাবার পথেও কোথাও পাবেন ঝিরি পথ আবার কোথাও পাবেন খাড়া পাহাড়ি পথে ঘন জঙ্গল ও ছোট ছোট পাহাড়ি ছড়া। তার উপর কোথাও একেবারে খাড়া হয়ে নামতে হবে আবার কোথাও একেবারে খাড়া পাহাড়ি পথে উঠতে হবে।
এসব পথ দিয়ে এগোতে থাকলে দেখা পাবেন হাতির মলের। স্থানীয়দের মতে, এখানে আগে প্রচুর হাতি পাওয়া যেতো। পরে ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ায় এখন আর এখানে বন্যহাতিরা আসেনা। তবে প্যেষ্য হাতিদের বিচরণ আছে এখানে। ভাগ্য ভালো থাকলে এসব হাতির দেখা পেতে পারেন। নানা রোমাঞ্চকর অভিযানের অভিজ্ঞতা পেতে পেতে আপনি পৌঁছে যাবেন কালা পাহাড়ের চূড়ায়। প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টার পুরো রাস্তাটাই চ্যালেঞ্জিং-এ ভরপুর। কালা পাহাড়ে উঠার রাস্তা একটি, পাহাড়ি রাস্তা। কিন্তু পাহাড় থেকে নামার রাস্তা দুটি। ঝিরি পথ ও পাহাড়ি পথ।
আপনি চাইলে যেকোনো পথে নামতে পারেন। তবে আপনি যদি ট্রেকিং প্রিয় হন তাহলে কালা পাহাড়ের উল্টো দিকে মুড়াইছড়া ইকোপার্ক হয়ে জুড়ী উপজেলায় ফুলতলা বাজারের কাছে রাজকি চা বাগান হয়ে বের হতে পারেন। রাস্তাটি সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য। এই পথ দিয়ে নামতে চার থেকে সাড়ে চার ঘন্টা সময় লাগে। তবে রাস্তাটি দিয়ে যেতে হলে আগে থেকে গাইডকে বলতে হবে, কারণ সব গাইড এ রাস্তা চিনেনা।
কিভাবে যাবেন
কুলাউড়া শহর থেকে কালাপাহাড় এর দূরত্ব আনুমানিক ৩৫ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়াগামী শ্যামলী, এনা পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি বাস রয়েছে। কুলাউড়া নেমে আজগরাবাদ চা বাগানগামী সিএনজিতে চড়ে বসুন। লোকাল গেলে ৪০ টাকার মতো খরচ পড়বে। রিজার্ভ করলে ২২০-২৫০ টাকা। আসগরাবাদ গিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বেগুনছড়া পুঞ্জির পথ দেখিয়ে দেবে। খাসিয়াপল্লী পৌছে স্থানীয় কাউকে নিয়ে দেড় থেকে দুই ঘণ্টার পাহাড়ি ট্রেইল ধরে পৌছে যাবেন কালা পাহাড়ের চূড়ায়।
ফেরার সময় রাতের উপবন এক্সপ্রেস এ ফিরতে পারেন নয়তো বিকাল ৫.২০ মিনিটে এনা পরিবহনের একটা বাস ছড়ে কুলাউড়া থেকে। ভাড়া পড়বে ৫০০ টাকা। এছাড়া বিভিন্ন পরিবহনের বেশ কিছু নাইট কোচ ছেড়ে আসে।
সবচেয়ে সহজ হয় যদি ঢাকা থেকে সিলেট গামী রাত ৯.৩০ মিনিটের উপবন এক্সপ্রেস এ যেতে পারেন। যা আপনাকে রাত ৪ টার দিকে কুলাউড়া ষ্টেশনে নামিয়ে দিবে। শোভন চেয়ার ভাড়া ৩২০ এবং শোভন ভাড়া ২৩০ টাকা।
কেউ যদি খরচ কমাতে চান তাহলে কুলাউড়া শহর থেকে বাসে করে যেতে পারেন রবিরবাজার, ভাড়া পড়বে ১০টাকা প্রতিজন। এরপর রবিরবাজার থেকে সিএনজিতে আজগরাবাদ টি স্টেট, ভাড়া ১০০/১২০।
পাহাড়ের যাবার ট্রেকিং পথটি অনেক সুন্দর। পাহাড়ে উঠার পথ একটা (পাহাড়ি পথ) কিন্তু নামার পথ দুইটা, ঝিরি পথ ও পাহাড়ি পথ ( ঝিরি পথে গেলেও আপনাকে বেশ কিছুটা পাহাড়ি পথ দিয়ে হাটতে হবে)। বেগুণছড়া পুঞ্জি থেকে নেয়া গাইড আপনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে কালা পাহাড়ের চূড়ায়। মোটামোটি দুই থেকে আড়াই ঘন্টা লাগে। উঠতে নামতে মোট পাচ সারে পাচ ঘন্টা লাগে। আগেই বলেছি এই পাহাড়ের পরিবেশ বেশ বন্য, এর চূড়ার পরিবেশ ও ঠিক তেমনি বন্য। অন্যান্য পাহাড়ের চূরা থেকে যেমেন আসে পাশের পরিবেশ পরিষ্কার দেখা যায়, এর চূড়া থেকে তেমনটা দেখতে পারবেন না।
পাহাড়ের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি ও সতর্কতা:
• ট্রেকিং এর জন্যে ভালো গ্রিপের জুতো ব্যবহার করবেন
• পাহাড়ে জোঁক থাকে, সঙ্গে একটু লবণ রাখবেন যাতে জোঁক ধরলে ছাড়ানো যায়।
• ব্যাকপ্যাক যতোটুকু সম্ভব হালকা রাখবেন।
• পর্যাপ্ত পানি ও খাবার স্যালাইন নেবেন।
• পাহাড়ের উঁচু-নিচু পথ, চলার সময় সাবধান থাকবেন।
• ফার্স্ট এইডের জন্যে যা প্রয়োজন সঙ্গে রাখবেন।
• ঝরনা ও ট্রেইলে দয়া করে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না।
• স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করুন।
• কোনো খনিজ সম্পদ বা পাহাড়ের জিনিস নিয়ে আসার কথা না ভাবাই ভালো।
• সময়ের দিকে খেয়াল রাখুন যেন ফিরে আসার পথেই সন্ধ্যা না হয়ে যায়।
• আর হে, আপনি কোথায় যাবেন, কিভাবে যাবেন তা আগ থেকেই পরিকল্পনা করে বের হন।