আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম-Andarkilla Shahi Jame Mosque
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের উপাসনার স্থান মসজিদ। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ হলেও এখানে ইসলামের ইতিহাস তেমন পুরোনো নয়। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের কিছু প্রাচীন মসজিদ ছাড়া মোঘল আমলের পূর্বের সমস্ত স্থাপনাই ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থিত ‘আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ’ এখনো তার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
মসজিদের ইতিহাস
পরবর্তীতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দ আরবি ১০৭৮ হিজরিতে মোগলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে জলদস্যুদের আস্তানায় মসজিদ নির্মাণ করেন। এ মসজিদের নামকরণ করেন ‘আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ’।
৫৬ বছর পর চট্টগ্রামের আরেক শাসনকর্তা নবাব ইয়াসিন খাঁ ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের সন্নিকটে পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের একটি টিলার ওপর আরেকটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করেন। যার নাম রাখেন ‘কদম রসুল’।
এক সময় আন্দরকিল্লা মসজিদের চেয়ে কদম রসুল মসজিদটি গুরুত্ব পেতে থাকে আর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটি মুসল্লি ও গুরুত্ব হারাতে থাকে। একপর্যায়ে আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদটি লোকশূন্য হয়ে পড়ে।
এ সুযোগে ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটিকে তাদের গোলাবারুদ রাখার গুদাম হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। পরবর্তীতে ১১৫ বছর পর হামিদুল্লাহ খাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের নামাজের জন্য আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটি আবারও উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
১৬৬৭ সাল থেকে এ মসজিদ ঘিরে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপক আনাগোনা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আওলাদে রাসুলগণই এ মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হতেন। যার ধারাবাহিকতা এখনও বিদ্যমান। বর্তমানে এ মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন আওলাদে রাসুল আল্লামা আনোয়ার হোসানইন তাহের জাবেরি আলমাদানি।
আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদ চট্টগ্রামসহ তার আশপাশের মানুষের আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার মসজিদে রূপ নেয়। বিশেষ করে জুমআর নামাজ পড়তে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে মুসল্লিরা উপস্থিত হন।
আন্দরকিল্লা মসজিদ এর স্থাপত্যশৈলী
মোঘল স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী তৈরি হয়েছে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। মসজিদটি দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসজিদের আদলে তৈরি।
আর সেই একই রীতিতে বড় বড় পাথর ব্যবহার করে এই মসজিদটি নির্মিত হয় বলে একে ‘পাথরের মসজিদ’ও বলা হয়ে থাকে।
মসজিদের নির্মাণ শৈলী সম্পর্কে জানা যায়, সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট ওপরে ছোট একটি পাহাড়ের ওপর এর অবস্থান। মূল মসজিদের নকশা অনুযায়ী এটি ১৮ গজ (১৬ মিটার) দীর্ঘ। প্রস্থ ৭ দশমিক ৫ গজ (৬.৯ মিটার)।
প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২ দশমিক ৫ গজ (২.২ মিটার) পুরু।
পশ্চিমের দেয়াল পোড়া মাটির তৈরি এবং বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের তৈরি। মসজিদটির পূর্বে তিনটি ও উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে মোট ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে।
মসজিদটিতে তিনটি মেহরাব থাকলেও সাধারণত মধ্যখানের ও সর্ববৃহৎ মেহরাবটিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এটির চারপাশের দেয়াল আড়াই গজ প্রস্থ বিশিষ্ট।
মসজিদের পশ্চিম দিকের দেয়াল নান্দনিক টেরাকোটা সমৃদ্ধ। অন্য তিন দিকের দেয়ালগুলো পাথরের তৈরি। মসজিদটির ছাদে তিনটি গম্বুজ মসজিদের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
মসজিদ দখল ও পুনরুদ্ধারের ইতিহাস
বৃটিশ শাসনামলে মসজিদটিকে অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তারা মসজিদটির গম্বুজ ও কয়েকটি পিলার ভেঙে ফেলে।
১৭৬১ সাল থেকে ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৯৪ বছর তারা এই মসজিদে কোনো ধরনের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতে দেয়নি।
পরবর্তীতে এর প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেন তৎকালীন বৃটিশ রাজের অধীনস্ত রাজস্ব কর্মকর্তা খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খান।
তার এই আন্দোলনের মুখে ১৮৫৬ সালে আন্দরকিল্লা মসজিদ পুনরায় চালু হয়।
প্রয়োজন সংরক্ষণের
এমন একটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মসজিদটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বলিষ্ঠ পদক্ষেপের প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর শামসুল হোসেন গনমাধ্যমকে বলেন, “আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হলেও আন্দরকিল্লা মসজিদ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। অন্যথায় আমরা অমূল্য এক সম্পদ হারাবো।”
পুরাতত্ত্ব বিভাগে আঞ্চলিক পরিচালক বলেন, “চট্টগ্রামের প্রাচীন অবকাঠামোগুলোকে চিহ্নিত করতে জরিপ চালানো হচ্ছে। এটি শেষ হলেও চিহ্নিত ভবনগুলোকে সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া হবে।”