বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা-The regional language of Barisal
বাংলাদেশের ভৌগোলিক পার্থক্য ও ঐতিহাসিক কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন উপভাষার জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণের অন্যতম অঞ্চল বরিশাল। প্রাচীন কালে বরিশাল ‘বাঙ্গালা’ নামে পরিচিত ছিলো।এই ‘বাঙ্গালা’ শব্দটি ‘বাকলা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। শোনা যায়, ডঃ কানুনগো নামক এক ব্যক্তি বাকলা বন্দর নির্মাণ করেন। এ সামুদ্রিক বন্দরে আরব ও পারস্যের বণিকেরা বাণিজ্য করতে আসতেন। দশম শতকে দক্ষিণ পূর্ববঙ্গে চন্দ্র রাজবংশ চন্দ্রদ্বীপ নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। বাকলা ছাড়াও চন্দ্রদ্বীপের অংশ ছিলো বর্তমান মাদারীপুর,গোপালগঞ্জ এবং বাগেরহাট জেলার অংশবিশেষ। পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি ইত্যাদি বরিশাল অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।
প্রমিত বাংলার সঙ্গে পার্থক্য
ধ্বনিতত্ত্ব
১.ই,উ স্বরধ্বনির ক্ষেত্রে অপিনিহিতির ব্যবহার লক্ষণীয়। যথাঃ- রাখিয়া>রাইখ্যা, আজি>আইজ
২.“এ” কারের উচ্চারণ অনেক সময় “এ্যা” হয়। যথা- বেল>ব্যাল, মেঘ>ম্যাগ
৩.কখনাে কখনাে অনুনাসিক স্বরধ্বনিতে অর্ধঅনুনাসিকের ব্যবহার পাওয়া যায়। যথাঃ চাঁদা>চান্দা, আধার>আন্ধার।
৪.মহাপ্রাণ ঘােষ ধ্বনি অল্পপ্রাণ ঘােষ ধ্বনি হয়, যথাঃ দুধ>দুদ, ভাত>বাত।
৫.পদের আদ্যাক্ষর “শ” “ষ” “স” ধ্বনি “হ” ধবনিতে পরিবর্তিত হয়। যথা- শালিক>হালিক, শামুক>হামুক, সকাল>হকাল, শৌল>হৌল, শালা>হালা, শশুর>হৌর, শাড়ী>হাড়ী ইত্যাদি।
৬.অন্ত “ক” ও “খ” ধ্বনি “হ” ধ্বনি হয়। যথা- টাকা>টাহা, দেখা>দেহা ।
৭.অনেক সময় “র” ধ্বনি “ল” হয়। যথাঃ শরীর>শরীল ।
৮.কখনাে কখনাে “ল” এর উচচারণ “ন” হয়। যথাঃ লাঙ্গল>নাঙ্গল, লােনা>নােনা ইত্যাদি।
রূপতত্ত্ব
১.কর্মসম্প্রদানের একবচনে “রে” বিভক্তি, যথাঃ হ্যারে কও = তাকে বল ।
২.কর্তৃকারকে এক বচনে “এ্যা” বিভক্তি। যথাঃ সফিজ্যা বাড়ী গ্যাছে, করিম্যা এদিগে আয় ।
৩.করণকারকে “এ্যা” বিভক্তি। যথাঃ লাডিদ্যা পিডাও।
৪.ভবিষ্যতকালের উত্তম পুরুষের ক্রিয়া পদে ‘উম' মু বিভক্তি। যথাঃ করমু, খামু, যামু, মারমু ইত্যাদি।
বাক্য তত্ত্ব
দেহােছে = আসিয়া দেখ, তুই আইছ? = তুমি এসেছ?, কুম্মিদ্যা = কোথা হতে, অসন মন্তর = আসা মাত্র, হগলডি = সকলে, হরমু আনে কি = তারপর কি করব ইত্যাদি।
বরিশাল অঞ্চলের আঞ্চলিক শব্দ:-
পেয়ারা-হব্রি,
নারিকেল-নাহোইল,
রান্নাঘর-ওশ্যা,
পাতিল-পাইলা,
মোরগ-রাওয়া,
শিম-উশ্যি,
পেঁপে-পোম্বা,
জাম্বুরা-ছোলোম,
জামরুল-লকট,
কবুতর-কইতোর,
মুরগী-মুরহা,
বিড়াল-বিলোই,
সাঁতার-হাতোর,
বোকা-বোগদা,
ড্রয়িংরুম-আইত্না,
স্টোররুম-উগোইর,
ফ্লোর-খাডাল,
লাকড়ি-দাউর,
তরকারীর ঝোল -শালুনের হুররা,
লাউ- কদু,
ধান খেত- কোলা,
গোছল করা- নাইতে যাওয়া,
উঠান-উডান,
পেঁপে - কোম্বা,
শসা- হোয়া ,
গুর-মিডা
বজ্রপাত-ঠাডা
ঝারু-পিছা
তেতুল-ট্যাংগা,
টাকি-চ্যাং ,
পেয়ারা-গইয়া
শিশু-গেদু,
বৃষ্টি-দ্যাওই,
টক-চুক্কা,
সকাল-বেইন্নাহাল,
সরিষার তেল-কউর্-রা ত্যাল,
চাষাবাদ-আইল্লাডি,
দাঁড়িপাল্লা-পালা-পোইরান,
কেরোসিন-কেরেস্তাল,
মাইর-কেনু,
হাস মুরগীর খাবার-আদার ,
ভেলা-ভুর,
চিরুনী-কাহোই,
গ্যানজাম-কের্তোন,
সর্দি-হিওইন,
থুথু-ছ্যাপ ..।।
বরিশালের কিছু আঞ্চলিক কথা
১.কোথায় যাস?- কোম্মে যাও আয়?
২.ও সকালে আমাদের বাড়িতে আসবে -ও বেইন্নাহালে মোগো বাড়ি আইবে আনে।
২.এরকম হা করে তাকিয়ে আছিস কেনো? -এরহম আক্কইররা চাইয়া রইছ কা?
৩.এত কথা বলিস কেনো? -এ্যাতো প্যাচাল পোডো কা আয়?
৪.এই দুপুরের রোদে মাঠের মধ্যে দাড়িয়ে আছিস কেনো? -এই দুহাইররা রৌদে কোলার মইদ্দে খাড়াইয়া রইছছ কা?
৫.তোর বাবা তোকে ডাকছে। শিগগীর যা। -তোর বাফে/বাজানে তোরে বোলাইতে লাগজে। ছ্যাৎ কইররা যা।
৬.তুই সারাদিন কোথায় থাকিস? কি করিস? তোকে খুজতে খুজতে প্রাণ বেড়িয়ে যায় আমার।
-তুই হাঙ্গাদিন কোম্মে থাহো আয়? কি হরো? তোরে বিছরাইতে বিছরাইতে মোর পরান বাইরাইয়া যায়।
৭.চাচা! আপনার ছেলে সবার সাথে খালি ঝগড়া বাধায়।- কাক্কু/দুদু! আম্মের পোলায় ব্যাবাক্কের লগে এ্যাকছের কাইজ্জা বাজায়।
৮.তোর মুখটা এত শুকিয়ে গিয়েছে কেন? -তোর থুতমাডা এরহম হুগাইয়া গ্যাছে কা?
৯.আমাদের পাড়ার হাকিম চাচা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। একদম মারাত্মক অবস্থা
-মোগো কান্দার হাকিম কাক্কু আচুক্কা অসুস্থ অইয়া পড়ছে। এ্যাক্কারে চ্যাতাইয়া হালাইছে।