বরিশালের দর্শনীয় স্থানসমূহ-Places of interest in Barisal
দেশের খাদ্যশষ্য উৎপাদনের একটি মূল উৎস এই বৃহত্তর বরিশাল। একে বাংলার 'ভেনিস' বলা হয়। বরিশালে রয়েছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নদীবন্দর ।
বাংলার ভেনিস খ্যাত বরিশাল জেলার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো; লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি, দুর্গাসাগর দিঘী, গুঠিয়া মসজিদ, ভাসমান পেয়ারা বাজার, সাতলা শাপলা গ্রাম, বিবির পুকুর, ব্রজমোহন কলেজ, জীবনানন্দ দাশ এর বাড়ি, অক্সফোর্ড মিশন গীর্জা, বঙ্গবন্ধু উদ্যান(বেলস পার্ক), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, শ্বেতপদ্ম পুকুর, মুকুন্দ দাসের কালিবাড়ী ও শের-ই-বাংলা জাদুঘর ইত্যাদি।
বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে শাপলার এক বিশাল রাজ্য। ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় চেপে হারিয়ে যাওয়া যায় শাপলা ফুলের এই রাজ্যপাটে। প্রায় ১০ হাজার একর জলাভূমি জুড়ে এরকম লাল শাপলার আধিক্য। এখানকার অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয় শাপলা চাষ ও এর বিপণনের মাধ্যমে। সাতলা বর্তমানে একটি পর্যটকমুখী এলাকা হলেও এটি একটি বিলের নাম। একসময়ে বর্ষাকালে এটা সম্পূর্ণ ডুবে যেত। স্বাধীনতার পরে তৎকালীন মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত প্রথম সাতলায় বাঁধ দেওয়ার কাজ শুরু করেন। তারপর বিল থেকে বিশাল এলাকা উত্থিত হয়ে বর্তমানে মনোরম এলাকায় পরিণত হয়েছে সাতলা গ্রাম। এই বিলে প্রাকৃতিকভাবে শাপলা ফোটে। ছোট নদী, হাওর ও বিলবেষ্টিত ছোট গ্রাম সাতলা। বরিশাল সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়ন। ইউনিয়নের উত্তর সাতলা গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা ইউনিয়নের বাগদা ও খাজুরিয়া গ্রামের কয়েকশ হেক্টর জমি নিয়ে এ বিলের মূল অবস্থান। সবচেয়ে বেশি শাপলার উপস্থিতি দেখা যায় সাতলার নয়াকান্দি ও মুড়িবাড়ীতে। সূর্যের তেজ যত তীব্র হয় শাপলা ফুল ততই বুজে যায়। শাপলার আসল সৌন্দর্য উপভোগের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত। তাই শাপলার পরিপূর্ণ সৌন্দর্য দেখতে চাইলে খুব সকালেই সাতলা যাওয়া উত্তম।
বায়তুল আমান জামে মসজিদ কমপ্লেক্স
বরিশাল শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বানারীপাড়া সড়কসংলগ্ন উজিরপুর উপজেলায় এই গুঠিয়া গ্রামের অবস্থান। বরিশাল-বানারীপাড়া সড়ক ধরে এগুলেই উজিরপুর উপজেলা। সড়কের পাশে গুঠিয়ার চাংগুরিয়া গ্রাম। এ গ্রামেই আছে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বৃহৎ গুঠিয়া মসজিদ । ২০০৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর উজিরপুরের গুঠিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা শিক্ষানুরাগী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এস. সরফুদ্দিন আহম্মেদ সান্টু চাংগুরিয়ার নিজ বাড়ির সামনে প্রায় ১৪ একর জমির উপর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে গুঠিয়া বাইতুল আমান জামে মসজিদ-ঈদগাহ্ কমপ্লেক্স এর নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করেন। ৩ বছর মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্মাণকাজ বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন এস. সরফুদ্দিনের ছোট ভাই মোঃ আমিনুল ইসলাম নিপু। তিনি ২০০৬ সালে উক্ত জামে মসজিদ-ঈদগাহ্ কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। তার নির্মাণাধীন সময়কালের মধ্যে তিনি একটি বৃহৎ মসজিদ-মিনার, ২০ হাজার অধিক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ঈদগাহ্ ময়দান, এতিমখানা, একটি ডাকবাংলো নির্মাণ, গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, লেক-পুকুর খনন কাজ সহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপন-ফুল বাগান তৈরি ও লাইটিং ব্যবস্থা সম্পন্ন করেন। চাংগুরিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী এস সরফুদ্দিন আহমেদ এটির নির্মাণ ব্যয় বহন করেন।
অক্সফোর্ড মিশন চার্চ
অক্সফোর্ড মিশন চার্চ এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বাংলাদেশের শৈল্পিক গির্জাগুলোর অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন। প্রাচ্যের ভেনিসখ্যাত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভাগীয় শহর বরিশালের বগুড়া রোডে অবস্থিত সুরম্য প্রাচীন স্থাপনা ইপিফানি গির্জা নাম হলেও অক্সফোর্ড মিশন নামেই পরিচিত। লাল ইটের গির্জাটি সিস্টার এডিথের নকশায় মূল আকৃতি দেন ফাদার স্ট্রং। ১৯০৩ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯০৭ সালে।
বরিশাল শহর থেকে আট কিলোমিটার উত্তরে লাকুটিয়া বাজার। এরপর ইট বিছানো হাঁটাপথ। কিছু দূর যাওয়ার পর মিলবে জমিদারদের অনেক মন্দির আর সমাধিসৌধ। রাস্তার ডান পাশে। এগুলোর বেশির ভাগই আটচালা দেউলরীতিতে তৈরি। শিখররীতির মন্দিরও। পাঁচটা মন্দির এখনো বলতে গেলে অক্ষতই আছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি এখন পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। অথচ এই বাড়িটিকে ঘিরে রয়েছে প্রায় চার শ’ বছরের পুরনো ইতিহাস।
লোহার দরজা পেরিয়ে জমিদার বাড়ির মূল প্রবেশপথের বাঁ পাশেই শান বাঁধানো ঘাটলা বাঁধা সুন্দর একটি পুকুর। বাড়িটি এখন বিএডিসির তত্ত্বাবধানে আছে। বাড়ির তিন ধারে ধানের জমি। বাড়ির কাছেই আমবাগান। বাগানটি গড়ে উঠেছে বিশাল এক দীঘির পাড়ে। একে সবাই রাণীর দিঘি বলে। শীতের সময় এখানে অনেকেই পিকনিক করতে আসেন। এই দীঘিতে প্রতি বছর চারদিক আলোকিত করে ফোটে পদ্মফুল। যেমন বড় তেমন এর রং। পাতাগুলোও ভীষন বড় বড়। বরিশালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পদ্মফুল ফোটে এই দীঘিতেই।
দুর্গাসাগর দীঘিটি অবস্থিত। বরিশাল ভায়া বানারীপাড়া নেছারাবাদ সড়কের পাশে এটির অবস্থান। ১৭৮০ খৃষ্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপ পরগনার তৎকালীন রাজা শিবনারায়ণ এলাকাবাসীর পানির সংকট নিরসনে মাধবপাশায় একটি বৃহৎ দীঘি খনন করেন। তাঁর মা দুর্গাদেবীর নামে দীঘিটির নামকরণ করা হয় দুর্গাগাসাগর। প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিবর্তে দুর্গাসাগর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে জেলা প্রশাসন। দুর্গাসাগর এর তিন দিকে ঘাটলা ও দীঘির ঠিক মাঝখানে ৬০ শতাংশ ভূমির উপর টিলা। দুর্গাসাগরে দর্শনার্থীদের অন্যতম আকর্ষণ মাঝখানের এই দ্বীপটির সৌন্দর্য। ২৫০০ হেক্টর আয়তনের দুর্গাসাগর দীঘিকে সাগর হিসেবে কল্পনা করলে, এ টিলাটি যেন একটি দ্বীপ। বাতাসের বেগ একটু বেশি হলেই দুর্গাসাগরে ঢেউ ওঠে। আর সেসব ছোট ছোট ঢেউয়ে ভেসে ওঠে পাড়ের বৃক্ষরাজির ছায়া।
স্থানীয়ভাবে এটি বরিশাল নগরী থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা গ্রাম। মাধবপাশা ছিল চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের সর্বশেষ রাজধানী। ১৭৮০ সালে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের তৎকালীন রাজা শিবনারায়ণ তার স্ত্রী দুর্গা রানীর নামে খনন করেন এক বিশাল জলাধার। নাম দেওয়া হয় 'দুর্গাসাগর'। রাজধানী মাধবপাশায় রাজাদের তেমন কোনো স্মৃতিঘেরা স্থাপনা না থাকলেও দুর্গাসাগর দীঘিটি এখনও চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য এবং রাজাদের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর দীঘিটি পুনঃখনন করা হয়। ১৯৯৬ সালে এই দীঘিকে 'দুর্গাসাগর দীঘি উন্নয়ন ও পাখির অভয়ারণ্য' প্রকল্পের আওতায় নিয়ে পরিণত করা হয়েছে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে। এ দীঘির এখন তত্ত্বাবধান করছে বরিশাল জেলা প্রশাসন।
১৯৯৬ সালে উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের পর নবরূপ পায় ঐতিহাসিক দুর্গাসাগর দীঘি। চারপাশে বিপুল সবুজ বৃক্ষের সমাহারে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পাখিকুলের কলকাকলীতে সারা বছর মুখর থাকে দুর্গাসাগর দীঘি। তাই সারা বছর ধরেই এ দীঘিতে আসেন পর্যটক। বিশেষ করে শীত মৌসুমে বনভোজন এবং দর্শনার্থীদের ঢল নামে দুর্গাসাগর দীঘির চারপাশে। গত কয়েক বছরে দর্শনার্থী আয় বেড়েছে পাঁচ গুণ। দুই-তিন বছর আগেও মাসে যেখানে দুর্গাসাগর দীঘি থেকে দর্শনার্থী-আয় ছিল ২৫/৩০ হাজার টাকা, এখন তা এক লাখে উন্নীত হয়েছে।দুর্গাসাগর দীঘির রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। দীঘি উন্নয়ন ও পাখির অভয়ারণ্য প্রকল্পের তথ্যসূত্র এবং বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ থেকে জানা যায়, জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা গ্রামে এই দীঘির রয়েছে কয়েকশ' বছরের ইতিহাস।