অসুস্থতার কারণে রোজা রাখতে না পারলে করণীয় কী? - What to do if you can not fast due to illness?
রমজানের রোজা ফরজ বিধান। প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতিটি মুমিনের ওপর রোজা রাখা আবশ্যক। তবে অসুস্থ ও অক্ষম ব্যক্তি কীভাবে রোজা রাখবে— সে ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা ও বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। কারণ, তবে মানুষের শক্তি, সামর্থ্য ও সাধ্যের বাইরে কোনো বিধান আল্লাহ কারও ওপর চাপিয়ে দেননি।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ সাধ্যের বাইরে কারো ওপর বোঝা চাপিয়ে দেন না। সে তা-ই পায়, যা তার অর্জন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৮৬)
রোগী রোজা ভাঙতে পারবে যখন
রোগের কারণে ডাক্তার যদি বলে, রোজা রাখলে রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে বা সুস্থতা বিলম্বিত হতে পারে, তাহলে রোজা ভাঙা যায়। কিন্তু সামান্য অসুখ, যেমন—মাথা ব্যথা, সর্দি, কাশি, অনুরূপ কোনো সাধারণ রোগ-বালাইয়ের কারণে রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ নয়। তবে রোগের কারণে যেসব রোজা ভঙ্গ হয়, সেগুলো পরে একটির বদলে একটি কাজা করে নিতে হবে।
রোজা পালনে রোগ বৃদ্ধি পেলে পরহেজগারি মনে করে রোজা পালন করা অনুচিত।
এ অবস্থায় রোজা ভঙ্গ করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের হত্যা কোরো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)
অতিশয় বৃদ্ধের জন্য রোজা পালন জরুরি নয়।
তবে ওই ব্যক্তি অন্য কাউকে দিয়ে কাজা আদায় করাবে বা ফিদিয়া দেবে। প্রতিটি রোজার জন্য একজন মিসকিনকে এক বেলা খাবার খাওয়াবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘শক্তিহীনদের কর্তব্য হচ্ছে ফিদিয়া দেওয়া, এটা একজন মিসকিনকে অন্নদান করা।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৪) মৃত্যুমুখী বৃদ্ধলোক অথবা এমন রোগে আক্রান্ত হলে, যা থেকে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, এমন অক্ষম ব্যক্তি প্রতিটি রোজার পরিবর্তে পৌনে দুই সের গম (ফিতরার পরিমাণ) অথবা সমপরিমাণ মূল্য আদায় করবে।
ইসলামের পরিভাষায় এটাকে ফিদিয়া বলা হয়। (জাওয়াহিরুল ফিকাহ : খণ্ড-১, পৃষ্ঠা ২৯)
রোজা অবস্থায় মস্তিষ্ক অপারেশন
রোজা অবস্থায় মস্তিষ্ক অপারেশন করালে রোজা ভাঙবে না, যদিও মস্তিষ্কে কোনো তরল কিংবা শক্ত ওষুধ ব্যবহার করা হয়। কেননা মস্তিষ্ক থেকে গলা পর্যন্ত সরাসরি কোনো নালিপথ নেই। তাই মস্তিষ্কে কোনো কিছু দিলে তা গলায় পৌঁছে না। [সূত্র : (ক) ইবনে আবিদিন, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা ৩৯৫; (খ) মোল্লা নিজাম উদ্দীন, ফাতাওয়া হিন্দিয়া, খণ্ড-১, পৃ. ২০৩]
রোজা অবস্থায় চোখে ওষুধ বা ড্রপ ব্যবহার
চোখে ড্রপ, ওষুধ, সুরমা, মলম ইত্যাদি ব্যবহার করলে রোজা নষ্ট হবে না।
যদিও এগুলোর স্বাদ গলায় উপলব্ধি হয়। কারণ চোখে ওষুধ ইত্যাদি দিলে রোজা না ভাঙার বিষয়টি হাদিস ও ফিকাহশাস্ত্রের মূলনীতি দ্বারা প্রমাণিত। [সূত্র : (ক) জাদিদ ফিকহি মাসায়িল, খণ্ড-১, পৃ. ১৮৩; (খ) আলিম ইবনুল আলা, আল-ফাতাওয়া তাতারখানিয়া, খণ্ড-২, পৃ. ৩৬৬)
মুখে ওষুধ ব্যবহার করা
মুখের অভ্যন্তরে কোনো ওষুধ ব্যবহার করে তা গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে, সেই ওষুধ যত স্বল্প পরিমাণই হোক না কেন। অতএব কেউ যদি রমজানে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু গিলে ফেলে, তাহলে তার ওপর ওই রোজার কাজা-কাফফারা উভয়টা ওয়াজিব হবে। (ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান, পৃষ্ঠা ২২৩)
রোজা অবস্থায় অক্সিজেন ব্যবহার
নাকে অক্সিজেন নিলে রোজা ভেঙে যাবে। কেননা শরীরের ভেতর ও বাইরে থেকে কোনো কিছু প্রবেশ করার যে চার নালি রয়েছে, নাক তার অন্যতম। তাই নাকে অক্সিজেন নিলে রোজা ভেঙে যাবে। [সূত্র : (ক) ইবনে আবিদিন, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা ২০০; (খ) খুলাসাতুল ফাতাওয়া, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা ২৫৩]
রোজা রেখে রক্ত দেওয়া ও নেওয়া
শরীরে রক্ত নিলে বা নিজ শরীর থেকে কাউকে রক্ত দান করলে কোনো অবস্থায়ই রোজা নষ্ট হবে না। কারণ রক্ত দেওয়ার কারণে কোনো বস্তু দেহের অভ্যন্তরে ঢোকেনি, তাই তাতে রোজা নষ্ট হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আর রক্ত নিলে যেহেতু উক্ত রক্ত শরীরের উল্লেখযোগ্য চার নালি থেকে কোনো নালি দিয়ে প্রবেশ করানো হয় না, বরং শরীরের অন্যান্য ছোট ছিদ্রের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়ে থাকে। সুতরাং রোজা অবস্থায় কারো শরীরে রক্ত দান করলে বা নিজে রক্ত গ্রহণ করলে রোজা নষ্ট হবে না। [সূত্র : (ক) আল-কাসানি, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা ৯২; (খ) ইবনে আবিদিন, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা ৪০০; (গ) ফাতাওয়া হিন্দিয়া, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা ২০০]
রোজা অবস্থায় এন্ডোস্কোপি করা
এন্ডোস্কোপি বলা হয়, চিকন একটি পাইপ মুখ দিয়ে ঢুকিয়ে পাকস্থলীতে পৌঁছানো। পাইপটির মাথায় বাল্বজাতীয় একটি বস্তু থাকে। পাইপটির অপর প্রান্তে থাকা মনিটরের মাধ্যমে রোগীর পেটের অবস্থা নির্ণয় করা হয়। একে এন্ডোস্কোপি বলা হয়। সাধারণত এন্ডোস্কোপিতে নল বা বাল্বের সঙ্গে কোনো মেডিসিন লাগানো থাকে না। তাই এন্ডোস্কোপি করালে রোজা ভাঙবে না। তবে যদি নল বা বাল্বে মেডিসিন লাগানো হয়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে। তেমনিভাবে টেস্টের প্রয়োজনে কখনো পাইপের সাহায্যে ভেতরে যদি পানি ছিটানো হয়, তখনো রোজা ভেঙে যাবে। (সূত্র : জাদিদ ফিকহি মাসায়িল, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা ১৮৬)
রোজা অবস্থায় ইনজেকশন নেওয়া
ইনজেকশন নিলে রোজা নষ্ট হবে না। চাই তা গোস্তে নেওয়া হোক বা রগে। কারণ ইনজেকশনের সাহায্যে দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশকৃত ওষুধ গোশত বা রগের মাধ্যমেই প্রবেশ করানো হয়ে থাকে, যা অস্বাভাবিক প্রবেশপথ, তাই এটি রোজা ভঙ্গের গ্রহণযোগ্য কারণ নয়। [সূত্র : (ক) ইবনে আবিদিন, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা ৩৯৫; (খ) ইবনু নুজাইম, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা ২৭৮; (গ) আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা ২১৪)
রোজা রেখে এনজিওগ্রাম করা
এনজিওগ্রাম করালে রোজা নষ্ট হবে না। এনজিওগ্রাম বলা হয় হার্টের রক্তনালি ব্লক হয়ে গেলে ঊরুর গোড়ার দিকে কেটে একটি বিশেষ রগের ভেতর দিয়ে (যা হার্ট পর্যন্ত পৌঁছে) ক্যাথেটার ঢুকিয়ে পরীক্ষা করাকে। ওই ক্যাথেটারে কোনো মেডিসিন লাগানো থাকলেও যেহেতু তা রোজা ভঙ্গের কোনো গ্রহণযোগ্য রাস্তা দিয়ে গ্রহণযোগ্য স্থানে পৌঁছায় না, তাই তার দ্বারা রোজা ভঙ্গ হবে না। (সূত্র : আল-মালাকাতুল ফিকহিয়া, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা ১২৪)
নাকে ওষুধ বা ড্রপ ব্যবহার
নাকে ড্রপ, ওষুধ, পানি ইত্যাদি দিয়ে ভেতরে টেনে নিলে রোজা ভেঙে যাবে। কারণ নাক রোজা ভেঙে যাওয়ার অন্যতম রাস্তা। কেননা নাকে ড্রপ ইত্যাদি নিলে তা গলা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। [সূত্র : (ক) ইবনে আবিদিন, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা ২০০; (খ) খুলাসাতুল ফাতাওয়া, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা ২৫৩]
রোজা অবস্থায় ইনহেলার ব্যবহার
সালবিউটামল ও ইনহেলার ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যাবে। শ্বাসকষ্ট দূর করার জন্য ওষুধটি মুখের ভেতরভাগে স্প্রে করা হয়। এতে যে জায়গায় শ্বাসরুদ্ধ হয় সেই জায়গাটি প্রশস্ত হয়ে যায়। ফলে শ্বাস চলাচলে আর কষ্ট থাকে না। উল্লেখ্য, ওষুধটি যদিও স্প্রে করার সময় গ্যাসের মতো দেখা যায়, কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে তা দেহবিশিষ্ট তরল ওষুধ। অতএব মুখের অভ্যন্তরে স্প্রে করার দ্বারা রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, মুখে স্প্রে করার পর না গিলে যদি থুতু দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে রোজা ভঙ্গ হবে না। এভাবে কাজ চললে বিষয়টি অতি সহজ হয়ে যাবে। এতে শ্বাসকষ্ট থেকে রেহাই পাওয়ার পাশাপাশি রোজা ভঙ্গ হবে না। অনেককে বলতে শোনা যায় যে ইনহেলার অতি প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়, তাই এতে রোজা ভঙ্গ হবে না। তাঁদের এ উক্তিটি একেবারে হাস্যকর। কেননা কেউ যদি ক্ষুধার তাড়নায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে অতি প্রয়োজনে কিছু খেয়ে ফেলে, তাহলে অতি প্রয়োজনে খাওয়ার কারণে তার রোজা কি ভঙ্গ হবে না? অবশ্যই ভেঙে যাবে। সুতরাং ইনহেলার অতি প্রয়োজনে ব্যবহার করলেও তার দ্বারা রোজা ভেঙে যাবে এবং পরে তার কাজা দিতে হবে। [সূত্র : (ক) ইবনে আবিদিন, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা ৩৯৫; (খ) ফাতাওয়ায়ে ফক্বীহুল মিল্লাত ৫/৪৫৯, (গ) হেদায়া ১/১২০]
কোনো কোনো চিকিৎসক বলেন, সাহিরতে এক ডোজ ইনহেলার নেওয়ার পর সাধারণত ইফতার পর্যন্ত আর ইনহেলার ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। তাই এভাবে ইনহেলার ব্যবহার করে রোজা রাখা চাই। হ্যাঁ, কারো যদি বক্ষব্যাধি এমন মারাত্মক আকার ধারণ করে যে ইনহেলার নেওয়া ছাড়া ইফতার পর্যন্ত অপেক্ষা করা দায় হয়ে পড়ে, তাহলে তাদের ক্ষেত্রে এই সুযোগ রয়েছে যে তারা প্রয়োজনভেদে ইনহেলার ব্যবহার করবে ও পরবর্তী সময় রোজা কাজা করে নেবে। আর কাজা করা সম্ভব না হলে ফিদিয়া আদায় করবে। আর যদি ইনহেলারের বিকল্প কোনো ইনজেকশন থাকে, তাহলে তখন ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করবে। কেননা রোজা অবস্থায় ইনজেকশন নিলে রোজা ভাঙবে না। (সূত্র : ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান, পৃষ্ঠা ৩২৪)
রোজা অবস্থায় স্যালাইন ব্যবহার
স্যালাইন নিলে রোজা ভাঙবে না। কেননা স্যালাইন নেওয়া হয় রগে। আর রগ রোজা ভাঙার গ্রহণযোগ্য কোনো ছিদ্র বা রাস্তা নয়। তবে রোজার দুর্বলতা দূর করার উদ্দেশ্যে স্যালাইন নেওয়া মাকরুহ। [সূত্র : (ক) আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা ২৮৮)
রোজা অবস্থায় প্রস্রাবের রাস্তায় ওষুধ ব্যবহার
পুরুষের প্রস্রাবের রাস্তা ও নারীদের লজ্জাস্থানে ওষুধ ইত্যাদি ব্যবহার করলে রোজা নষ্ট হবে না। তেমনিভাবে প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে বা নারীদের লজ্জাস্থানে কোনো ওষুধ ভেতরে প্রবেশ করালেও রোজা ভঙ্গ হবে না। কেননা সেখান থেকে এমন কোনো স্থানে তা পৌঁছে না, যেখানে পৌঁছলে রোজা ভেঙে যায়। বরং মূত্রনালি বা জরায়ু তথা গর্ভাশয়ে পৌঁছে মাত্র। আর মূত্রনালি বা গর্ভাশয় রোজা ভঙ্গের গ্রহণযোগ্য খালি জায়গা নয়। তাই রোজা নষ্ট হবে না। (আল-মালাকাতুল ফিকহিয়া, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা ১১৪-১১৫)
রোজা অবস্থায় ঢুস ব্যবহার
ঢুস নিলে রোজা ভেঙে যাবে। কারণ ঢুস মলদ্বারের মাধ্যমে ভেতরে প্রবেশ করে। আর মলদ্বার রোজা ভাঙার রাস্তা ও পথ। [সূত্র : (ক) ইবনে আবিদিন, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা ৩৭৬; (খ) আল-মারগিনানি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা ২২০]
রোজা অবস্থায় ইনসুলিন ব্যবহার
রোজা অবস্থায় ডায়াবেটিক রোগী ইনসুলিন নিলে রোজা নষ্ট হবে না। কারণ ইনসুলিন রোজা ভাঙার গ্রহণযোগ্য রাস্তা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে না এবং গ্রহণযোগ্য কোনো খালি স্থানেও পৌঁছে না। [সূত্র : (ক) ইবনে আবিদিন, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা ৩৬৭; (খ) ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান, পৃষ্ঠা ৩২৭]