ঈদুল আযহায় পশু কুরবানী করে উৎসব কি অনৈতিক? - Eid al-Adha animal sacrifice festival is immoral?
Animals on Eid-ul-Azha

ঈদুল আযহার সময় ইসলামবিরোধীদের থেকে একটি যুক্তি শোনা যায়ঃ

“পশু হত্যা করে খাওয়ায় কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু পশু হত্যা করে ধর্মীয় উৎসব করা অনৈতিক।”

এখানে এই যুক্তির মাঝে কিছু সমস্যা আছে। 

 ❏ প্রথমতঃ

খাওয়ার জন্য পশু হত্যা যদি অনৈতিক না হয় তাহলে এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে পশু হত্যামাত্রই অনৈতিক নয়। তাদের যুক্তি থেকেই এটা বোঝা গেলো।

❏ দ্বিতীয়তঃ

পশু হত্যার সাথে খাওয়ার ব্যাপার যুক্ত থাকলে তা যদি অনৈতিক না হয় (তাদের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী), তাহলে মুসলিমদের ঈদুল আযহার কুরবানীও মোটেও অনৈতিক হতে পারে না। আল কুরআনে সুরা হজ-এ কুরবানী সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

“ এবং মানুষের মধ্যে হজ্বের জন্যে ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে।

যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাঁর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময়। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ-অভাবগ্রস্থকে আহার করাও।

এরপর তারা যেন দৈহিক ময়লা দূর করে দেয়, তাদের মানত পূর্ণ করে এবং এই সুসংরক্ষিত গৃহের তাওয়াফ করে।

এটা শ্রবণযোগ্য। আর কেউ আল্লাহর সম্মানযোগ্য বিধানাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে পালনকর্তার নিকট তা তার জন্যে উত্তম। উল্লেখিত ব্যতিক্রমগুলো ছাড়া তোমাদের জন্যে চতুস্পদ জন্তু হালাল করা হয়েছে। সুতরাং তোমরা মূর্তিদের অপবিত্রতা থেকে বেঁচে থাক এবং মিথ্যা কথন থেকে দূরে সরে থাক;” 

কুরআনে স্পষ্ট করেই বলা হচ্ছে যে, কুরবানীর পশু থেকে নিজেরা আহার করবে এবং দরিদ্রদেরকে আহার করাবে। আল্লাহ যেহেতু কুরবানীর পশুকে হালাল করেছেন, মুসলিমরা এই হালাল মাংস ভক্ষণ করে। শুধু নিজেরাই যে ভক্ষণ করে তাই না, দুঃখী-দরিদ্রদেরকেও তা থেকে দান করে। আল কুরআনের আয়াত থেকেই এটা স্পষ্ট। এমন তো না যে কুরবানীর সময়ে মুসলিমরা শুধুমাত্র “পশুহত্যা” করেই উৎসব করে। মুসলিমরা শুধুমাত্র “পশুহত্যা করে আনন্দ করে” এর মাংসগুলোকে ফেলে দিচ্ছে না। মুসলিমরা নিজেরা এই হালাল মাংস খায় এবং দরিদ্রদেরকে দান করে।  ঈদের আনন্দ এভাবেই পূর্ণতা পায়। ঠিক যেমনি ঈদুল ফিতরের জরুরী অনুষঙ্গ হচ্ছে ঈদের সলাতের আগেই ফিতরা হিসেবে দরিদ্রদেরকে খাদ্য দেয়া যাতে কেউ ঈদের দিন অভুক্ত  না থাকে। ঈদুল আযহাতেও মুসলিমরা পশু কুরবানী করে “রক্তের হোলিখেলায়” মাতে না বরং নিজেরা দরিদ্রদেরকে এই মাংস দান করে। মুসলিমদের ২টি ঈদের সাথেই এভাবে দরিদ্রদের কল্যাণ জড়িয়ে আছে। মুসলিমদের ঈদ আনন্দটা এমন। মদ খেয়ে, পার্টি করে, হুল্লোর করে আনন্দ করা ইসলামের নীতি না। ইসলামের আনন্দ পবিত্র আনন্দ। মুসলিমরা সলাত আদায় করে, দরিদ্রদেরকে দান করে ঈদের দিনে আনন্দ করে। পৃথিবীর আর কোন ধর্মগ্রন্থে এভাবে ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে দরিদ্রদেরকে দান করতে বলে দেয়া হয়েছে?

অথচ ঈদুল আযহার এই দিকগুলোকে উল্লেখ না করেই ইসলামের শত্রুরা ক্রমাগত বলতে থাকেঃ “মুসলিমরা রক্তারক্তি করে ঈদুল আযহায় উৎসব করে”। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে একই দিনে অনেক পশু জবাই করা হলে রাস্তা তো রক্তে লাল হবেই। যেহেতু এখানে নির্দিষ্ট স্থানে কুরবানীর ব্যবস্থা নেই। রক্ত ঝরিয়ে রাস্তা লাল করা বা নোংরা করা তো ঈদুল আযহা বা কুরবানীর উদ্যেশ্য না। [3] সুনির্দিষ্ট স্থানে পরিচ্ছন্ন উপায়ে কুরবানী দেয়া গেলে এবং রাস্তাঘাট নোংরা না করে পরিচ্ছন্ন রাখা গেলে নিঃসন্দেহে তা উত্তম। কিন্তু নাস্তিক-মুক্তমনাদেরকে দেখা যায় ঈদুল আযহার রক্তাক্ত রাস্তার ছবি পোস্ট করে এর নামে বিষোদগার করতে।

তাদেরকে একটা জিনিস মনে করিয়ে দিতে চাইঃ এমনকি খাবার জন্য পশু জবাই করা হলেও তাতে কিন্তু রক্ত ঝরে। প্রতিদিন কসাইখানায় মাংস উৎপাদনের জন্য যে পশুগুলোকে হত্যা করা হয়, সেগুলো কিন্তু রক্তবিহীন না! ব্যাপার হচ্ছে ঐ রক্ত আপনাদের চোখের সামনে আসে না, ঈদুল আযহার দিনেরটা আসে। চোখের সামনে না আসা মানেই কিন্তু এই না যে এর অস্তিত্ব নেই। এরপরও যদি মুসলিমদের ঈদকে ‘রক্তারক্তির উৎসব’ বলতে চান তাহলে আমরা বলবোঃ আপনাদের খাদ্যাভ্যাসও রক্তারক্তি খাদ্যাভ্যাস!

নাস্তিক-মুক্তমনাদের মাঝে যারা খাওয়ার জন্য পশুহত্যাকে নৈতিক মনে করেন, তাদের কারো থেকে ঈদুল আযহাকে অনৈতিক বলা মোটেও যৌক্তিক নয়। আপনি যদি ভিগান কিংবা ভেজিটারিয়ান না হন [5], তাহলে ঈদুল আযহাকে বর্বর বলা আপনার জন্য একটি দ্বিমুখী নীতি। বর্তমান সময়ে ঈদুল আযহাকে বর্বর বলা নাস্তিক-মুক্তমনাদের এক বড় অংশই ভিগান নন, ভেজিটারিয়ানও নন। তারা সারা বছর মাংস ভক্ষণ করেন কিন্তু ঈদুল আযহা এলেই ভুল যুক্তি দিয়ে একে বর্বর বলেন।

পশু হত্যার সাথে যদি খাদ্যের ব্যাপার জড়িত থাকে তাহলে নাস্তিক-মুক্তমনাদের নৈতিকতার মানদণ্ড অনুযায়ী সেটা অনৈতিক কিছু নয়। কিন্তু ঈদুল আযহা এলেই তারা একে বর্বর, অনৈতিক ইত্যাদি বলে তাদের ব্লগ এবং ফেসবুক লাইভ সরগরম করে রাখে। ঈদুল আযহার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্বকেও কোনো যুক্তিবান মানুষের পক্ষে অগ্রাহ্য করা সম্ভব না। পৃথিবীর বহু জায়গায় মাংস এক প্রকারের আকাঙ্খিত এবং উন্নত খাদ্য হিসাবে বিবেচিত। মুসলিম দেশগুলোতে বহু দরিদ্র মানুষ সারা বছর ধরে ঈদুল আযহার প্রতীক্ষায় থাকে যে এই সময়টাতে তারা মাংস খেতে পাবে। এখানে কুরবানীর পশুর সাথে জড়িত বিপুল পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক নানা গুরুত্বপূর্ণ দিকও জড়িয়ে আছে। [6] পশু জবাই তো ঈদুল আযহার একমাত্র কাজ না বরং অনেকগুলো কাজের একটা কাজ। ইসলামবিরোধীরা ঈদুল আযহাকে “রক্তপাতের উৎসব” বলে প্রচার করে, ঈদুল আযহাকে আংশিকভাবে তুলে ধরে এর অন্য অনুষঙ্গগুলো এড়িয়ে যায়। এভাবে আংশিকভাবে একটা বিষয়কে চিত্রিত করে অনেক সাধারণ জিনিসকেও খুব সহজে ভয়ঙ্কর এবং বর্বর হিসাবে তুলে ধরা যায়।

তাদের ভুল যুক্তি বা দ্বিমুখী নীতিটি কি বোঝা যাচ্ছে? তাদের এই আংশিক প্রচারণার দিকটি কি স্পষ্ট হচ্ছে?

পাদটিকা

আল কুরআন, হজ ২২ : ২৭-২৮

 http://www.quraanshareef.org/Surah-Al-Hajj#loc20

তবে এর মানে কিন্তু এটাও নয় যে কুরবানীর উদ্যেশ্য শুধুমাত্র মাংস খাওয়া। কেউ শুধুমাত্র মাংস খাবার জন্য কুরবানী দিলে কিন্তু তার কুরবানী হবে না। আল কুরআনে বলা হয়েছেঃ

“আপনি বলুনঃ আমার নামায, আমার কোরবানী এবং আমার জীবন ও মরন বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে।” (আল কুরআন, আন’আম ৬ : ১৬২)

http://www.quraanshareef.org/Surah-Al-Anam#loc160

“এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।”(আল কুরআন, হজ ২২ : ৩৭)

http://www.quraanshareef.org/Surah-Al-Hajj#loc30

এখানে মাংসের বিষয়টি উল্লেখ কারণ হলো কুরবানীর মাংসকে আল্লাহ হালাল করেছেন বিধান মুসলিমরা তা খায়। আল কুরআনেই এই মাংস খাওয়া ও দরিদ্রদের দান করবার কথা উল্লেখ রয়েছে। নিজেরা খাওয়া ও দরিদ্রদেরকে দান করবার মাধ্যমে ঈদুল আযহার আনন্দ পূর্ণতা পায়। অথচ নাস্তিক-মুক্তমনাদের নিজস্ব যুক্তিতেই যেখানে পশুহত্যা করে ভক্ষণ করা অনৈতিক নয় কাজেই তাদের যুক্তিতেই ঈদুল আযহা বর্বর হতে পারে না।

“এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।”(আল কুরআন, হজ ২২ : ৩৭)

http://www.quraanshareef.org/Surah-Al-Hajj#loc30

■ আবু মালেক আল-হারেস ইবনু আসেম আল-আশ'আরী(রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে- রাসুলুল্লাহ্(ﷺ) বলেছেন: "পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক; ...

[সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ২২৩]

https://hadithbd.com/hadith/link/?id=21668

■ সালিহ ইবনু আবু হাসসান(র.) বলেন, আমি সাঈদ ইবনুল মুসাঈয়্যাব (র.)-কে বলতে শুনেছি, অবশ্যই আল্লাহ তা'আলা পবিত্র এবং পবিত্রতা ভালোবাসেন। তিনি পরিচ্ছন্ন এবং পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন। তিনি মহান ও দয়ালু, মহত্ব ও দয়া ভালোবাসেন। তিনি দানশীল, দানশীলতাকে ভালোবাসেন। সুতরাং তোমরাও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থেক। আমার মনে হয় তিনি বলেছেনঃ তোমাদের আশপাশের পরিবেশকেও পরিচ্ছন্ন রাখো এবং ইয়াহুদীদের অনুকরণ করো না। … আমির ইবনু সা'দ তার পিতার সূত্রে নবী(ﷺ) হতে একই রকম হাদীস আমার কাছে বলেছেন। তবে তিনি তাতে বলেছেন, তোমাদের আশপাশের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখ।

[সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদিস নং : ২৭৯৯]

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=41373

■ আবু যার(রা.) সূত্রে বর্ণিত। নবী(ﷺ) বলেছেনঃ প্রতিদিন সকালে আদম সন্তানদের দেহের প্রতিটি জোড়ার জন্য সাদাকাহ ধার্য হয়। তার সঙ্গে সাক্ষাতকারীদের তার সালাম দেয়া একটি সাদাকাহ। সৎকাজের আদেশ করা একটি সাদাকাহ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করাও একটি সাদাকাহ। রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা একটি সাদাকাহ। ...

[সুনান আবু দাউদ (তাহকিককৃত), হাদিস নং : ৫২৪৩]

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=62611

[5] Vegan এবং Vegetarianরা পশু হত্যা করে খাওয়াকেও অনৈতিক মনে করেন। তবে তাদের এই নৈতিকতার স্ট্যান্ডার্ডের সাথেও আমরা একমত নই। মুসলিমদের নৈতিকতার উৎস কুরআন এবং সুন্নাহ।

[6] ■ “ঈদ বাণিজ্যে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে দেড় লাখ কোটি টাকা” - ভোরের কাগজ, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

http://www.bhorerkagoj.com/print-edition/2016/09/12/106771.php

■ "কুরবানির চামড়ার অর্থায়নে দারিদ্র বিমোচন ভাবনা _মতামত" - দৈনিক ইত্তেফাক, ২৯ জুলাই, ২০২০

https://www.ittefaq.com.bd/opinion/171230/

কুরবানির-চামড়ার-অর্থায়নে-দারিদ্র-বিমোচন-ভাবনা

https://response-to-anti-islam.com/show/%E0%A6%88%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%86%E0%A6%AF%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%AA%E0%A6%B6%E0%A7%81-%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%80-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%89%E0
হজ্ব কাদের উপর ফরজ - On whom is Hajj obligatory?
ফরজ গোসলের সঠিক পদ্ধতি - Correct method of Farj Ghusl
নারীর তালাক নেওয়ার বৈধ উপায় কী? - What is the legal way to divorce a woman?
এ বছর হজ্জের জন্য নিবন্ধন করবেন যেভাবে - How to register for Hajj this year
ইসলামের দৃষ্টিতে তালাক - Divorce in the eyes of Islam
বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার পর আমল - Actions after being saved from danger
কালো জাদু থেকে বাচার উপায়
সালামের উপকারিতা
জুমার দিনের মর্যাদাপূর্ণ আমল - The dignified act of Friday
ইসলাম ধর্মে গান-বাজনা হারাম - Music is forbidden in Islam