আমানুল্লাহ নোমান
কোরবানির ইতিহাস অনেক আগের কালের। মানবসৃষ্টির সূচনালগ্নে তথা হজরত আদমের (আ.) যুগ থেকে কোরবানীর শুভযাত্রা হয়েছিল।
কোরআনে কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন (হে নবী) তাদের সামনে আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে পড়ে শোনাও, যখন তাদের প্রত্যেকে একেকটি কোরবানি পেশ করেছিল এবং তাদের একজনের কোরবানি কবুল হয়েছিল, অন্যজনের কবুল হয়নি। সে (দ্বিতীয়জন প্রথমজনকে) বলল, আমি তোমাকে হত্যা করে ফেলব। প্রথম জন বলল, আল্লাহ তো মুত্তাকিদের পক্ষ থেকেই (কোরবানি) করেন। (সূরা মায়েদা : আয়াত-২৭)
কিন্তু এ কোরবানির প্রেক্ষাপট কী ছিল, মুফাসসিররা হাদিসের আলোকে সে ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তার সারমর্ম হলো হজরত আদমের (আ.) দুই পুত্র ছিল। একজনের নাম হাবিল, অন্যজনের নাম কাবিল। বলা বাহুল্য, তখন পৃথিবীতে মানব বসতি বলতে কেবল হজরত আদমের (আ.) পরিবারবর্গই ছিল।
তার স্ত্রীর গর্ভে প্রতিবার দুটি যমজ সন্তানের জন্ম হতো। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে, তাদের দুজনের পরস্পরে বিয়ে জায়েজ ছিল না। কিন্তু এক গর্ভের ছেলের সঙ্গে অপর গর্ভের মেয়ের বিয়ে হালাল ছিল। কাবিলের সঙ্গেও এ মেয়ের জন্ম হয়। কিন্তু যমজ হওয়ার কারণে কাবিলের সঙ্গে তার বিয়ে জায়েজ ছিল না। তা সত্ত্বেও কাবিল গোঁ ধরে বসেছিল তাকেই বিয়ে করবে। হাবিলের পক্ষে ওই মেয়ে হারাম ছিল না। তাই সে তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছিল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তা নিষ্পত্তির জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, তারা উভয়ে কোরবানি পেশ করবে। আল্লাহ তায়ালা যার কোরবানি কবুল করবেন তার দাবি ন্যায্য মনে করা হবে। সুতরাং উভয়ে কোরবানি পেশ করল। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হাবিল একটি দুম্বা কোরবানি দিয়েছিল আর কাবিল পেশ করেছিল কিছু কৃষিজাত ফসল। সেকালে কোরবানি কবুল হওয়ার আলামত ছিল এই যে, কোরবানি কবুল হলে আসমান থেকে আগুন এসে তা জ্বালিয়ে দিত।
সুতরাং আসমান থেকে আগুন এলো এবং হাবিলের কোরবানি জ্বালিয়ে দিল। এভাবে প্রমাণ হয়ে গেল যে, তার কোরবানি কবুল হয়েছে। কাবিলের কোরবানি যেমনটা তেমনই পড়ে থাকল। তার মানে তার কোরবানি কবুল হয়নি।
তারপর প্রত্যেক নবীর শরিয়তে কোরবানির বিধান থাকলেও তার নিয়ম ও পন্থা এক ছিল না। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরিয়তে কোরবানির যে পন্থা ও পদ্ধতি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত হয়েছে, তার মূল উত্স হলো হজরত ইবরাহিমের (আ.) সেই ঐতিহাসিক কোরবানি, যা স্বীয় ছেলে হজরত ইসমাঈলকে (আ.) নিয়ে সংঘটিত হয়েছিল। কোরআন-হাদিসে তার সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল ছেলের সুসংবাদ দিলাম।
অতঃপর সে ছেলে যখন ইবরাহিমের সঙ্গে চলাফেরা করার উপযুক্ত হলো, তখন সে বলল, বত্স! আমি স্বপ্নে দেখছি যে, তোমাকে জবেহ করছি। এবার চিন্তা করে বল, তোমার অভিমত কী। ছেলে বলল, আব্বাজান! আপনাকে যার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, আপনি সেটাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে সবরকারীদের একজন পাবেন। সুতরাং (সেটা ছিল এক বিস্ময়কর দৃশ্য) যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিল আর আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম হে ইবরাহিম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। নিশ্চয়ই আমি সত্কর্মশীলদের এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি।
নিশ্চয় এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা এবং আমি এক মহান কোরবানির বিনিময়ে সে শিশুকে মুক্ত করলাম। এবং যারা তার পরবর্তীকালে এসেছে তাদের মধ্যে এই ঐতিহ্য চালু করেছি। (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত-১০১-১০৮)
হজরত ইবরাহিমের (আ.) স্বপ্ন ও তার কোরবানির ঘটনা নিয়ে হাদিস, তাফসির ও ইতিহাসের কিতাবে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে।
এ হুকুমের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার প্রকৃত লক্ষ্য হজরত ইসমাঈলকে (আ.) জবেহ করা ছিল না, বরং উদ্দেশ্য ছিল, নিজের পক্ষ থেকে জবেহ করার সব আয়োজন সমাপ্ত করে জবেহ করতে উদ্যত হয়ে যাও।
অতঃপর পিতা-পুত্র উভয়ে তো নিজেদের পক্ষ থেকে আল্লাহ তায়ালার হুকুম তামিল করতে পুরো প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম, তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ।
অর্থাত্ আমার আদেশ পালনে তোমার যা করণীয় ছিল তাতে সত্যি নিজের পক্ষ থেকে কোনো ত্রুটি রাখনি। এখন এই পরীক্ষা পূর্ণ হয়ে গেছে। হজরত জিবরাঈল (আ.) তখন জান্নাত থেকে একটি দুম্বা নিয়ে এলেন, এটি হজরত ইবরাহীমকে (আ.) দেয়া হলে তিনি আল্লাহর নির্দেশক্রমে ছেলের পরিবর্তে সেটি কোরবানি করলেন। তারপর থেকে পশু কোরবানির বিধান তার শরিয়তে যেমন প্রচলিত ছিল, তেমন তা আমাদের শরিয়তে মুহাম্মদীতেও প্রচলিত। এজন্য কোরবানিকে ‘সুন্নাতে ইবরাহিমী’ নামে অভিহিত করা হয়।
কোরবানির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই হলো পূর্ণ আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ করা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর আদেশ পালন করা। এক্ষেত্রে মানুষের প্রশংসা কুড়ানো এবং লৌকিকতার কোনো অবকাশ নেই। তাই কোরবানির মধ্যে সেই মানসিকতাই কার্যকর থাকতে হবে, যা পবিত্র কোরআনে এভাবে বিধৃত হয়েছে(হে নবী) বলে দাও, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ, সবই আল্লাহ তায়ালার জন্য। যিনি জগতগুলোর প্রতিপালক। (সূরা আনআম, আয়াত-১৬২)
এ প্রসঙ্গে সূরা কাউসারের দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘সুতরাং তুমি নিজ প্রতিপালকের (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য নামাজ পড় এবং কোরবানি দাও’।
এখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এবং তার মাধ্যমে পুরো উম্মতকে সালাত (নামাজ) ও নাহর (কোরবানির) আদেশ দেয়া হয়েছে। ‘নাহর’ শব্দের মূল ব্যবহার হলো উট জবেহ করা, তবে সাধারণত যে কোনো পশু জবেহ করাকেই নাহর বলা হয়। আয়াতে এমন জবেহ বা কোরবানি উদ্দেশ্য, যা আল্লাহ তায়ালার জন্য ইবাদত হিসেবে করা হয়।
কোরবানির গোশতের এক ভাগ গরিব-মিসকিনদের, আরেক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের মাঝে বিতরণ করতে এবং বাকি এক ভাগ কোরবানিদাতাদের খেতে বলা হয়। এটা শরিয়তের মুস্তাহাব নিয়ম। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন—সুতরাং (হে মুসলিম) সেই পশুগুলো থেকে (জবেহ করার পর) তোমরা নিজেরাও খাও এবং দুস্থ-অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও (সূরা : হজ-২৮) এ প্রসঙ্গে সূরা হজের অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, কোরবানির উট ও গরুকে তোমাদের জন্য আল্লাহর ‘শাআইব’-এর অন্তর্ভুক্ত করেছি। তোমাদের জন্য তাতে আছে কল্যাণ, সুতরাং যখন তা সারিবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়ানো থাকে, তোমরা তার ওপর আল্লাহর নাম (নিয়ে জবেহ কর) নাও। তারপর যখন (জবেহ হয়ে যাওয়ার পর) মাটিতে পড়ে যায়, তখন তার গোশত থেকে নিজেরাও খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও এবং তাকেও (খাওয়া) যে নিজে অভাব প্রকাশ করে। (সূরা : হজ-৩৬)
এছাড়া হাদিস শরীফেও ক্ষুধার্ত ও দরিদ্রদের মাঝে কোরবানির গোশত বিতরণের খুব তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের ইখলাস ও মহব্বতের সঙ্গে কোরবানি করে, তাঁর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের তাওফিক দান করুন।