কমলার খোসার উপকারিতা ও অপকারিতা-Benefits and harms of orange peel
Benefits of orange peel

কমলার খোসার উপকারিতা,গুনাগুন ও ব্যবহার

একটি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল হিসেবে কমলা সবার কাছে সুপরিচিত তবে খুব কম মানুষই এ বিষয়ে সচেতন যে, ভেতরের নরম শাঁসটির পাশাপাশি খোসাও ভিটামিন সির একটি চমৎকার উৎস। পলিফেনল নামের একপ্রকার উদ্ভিজ্জ উপাদানসমৃদ্ধ কমলার খোসা ডায়াবেটিস ও স্থূলতার মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগ মোকাবেলা এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য উপকারী। একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, খোসায় পলিফেনলের উপস্থিতি এতো বেশি, এর পরিমাণ মূল ফলটির চেয়ে অনেক বেশি। খোসার মধ্যে যে এসেনশিয়াল অয়েল আছে, তা লাইমোনেন দ্বারা সমৃদ্ধ এবং এটি চামড়ার ক্যান্সার মোকাবেলায় সহায়তা করে। সুস্বাদু ফলটির খোসায় অত্যন্ত উচ্চমানের আঁশ আছে, যা পরিপাক ক্রিয়া সঠিকভাবে বাড়াতে সহায়তা করে।

কমলার খোসার উপকারিতা ও গুনাগুন

কমলালেবু শরীরের পক্ষে যতটা উপকারি, তার থেকেও কম উপকারি নয়, এই ফলে খোসা ৷ জেনে নিন কমলা লেবুর খোসা কী কী কাজে লাগে ৷

পেটের সমস্যা দূরীকরণে:

কমলালেবুর খোসা পেটের সমস্যার সমাধান করে। এমনকি গ্যাস, অ্যাসিটিডি ও বমি বমি ভাব দূর করতেও কমলার খোসার জুড়ি নেই। প্রতিদিন সকালে খোসার মিহি কুচি এক চা চামচ পরিমাণ মধুর সঙ্গে খেয়ে নিন। তাহলে এ ধরনের সমস্যায় আর সহজে পড়বেন না। এমনকি সকালের নাস্তায় সালাদের সঙ্গেও এটি খেতে পারেন।

পিত্ত ও কফের সমস্যায়:

কমলার খোসার রসের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হলো এটি কফের সমস্যা ও পিত্তের যে কোন ধরনের সমস্যা দূর করে। প্রথমে কমলার খোসা পাতলা করে ছিলে নিন। এরপর ভেজিটেবল পিলারের সাহায্যে কিংবা গ্রেটারে ঘষে নিন। পরে খোসার কুচিগুলো রঙ চা তৈরির সময়েই ঢেলে দিন। সঙ্গে অল্প পরিমাণে আদা দিলে আরও ভাল হয়। এবার পানি একটু ফুটিয়ে আদা ও কমলার গন্ধ ছড়ালেই চায়ের মতো পান করুন। সঙ্গে দিতে পারেন মধুও। তাহলে কফ ও পিত্ত সমস্যার অবশ্যই সমাধান হবে।

চুলের যত্নে:

চুল নরম ও খুশকিমুক্ত করতে দারুণভাবে কাজ করে কমলার খোসা। সেজন্য কমলার খোসা পানিতে ফুটিয়ে সারারাত রেখে দিন। পরদিন সেই পানি ছেঁকে তা দিয়ে চুল ধুয়ে নিন। এতে চুল হবে নরম ও খুশকিমুক্ত।

ওজন কমাতে:

উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরলের সমস্যা ও ওজন কমানোর জন্য কমলার খোসা অনেক বেশি কার্যকরী। কারণ এতে ট্রাইগ্লিসারাইড দ্রবীভূত থাকে যেটি সমস্যাগুলো দূর করতে সাহায্য করে।

অনিদ্রা দূর করে:

কমলার খোসা মিশ্রত পানি গোসলের সময় ব্যবহার করলে এটি অনিদ্রা দূর করে। এমনকি কুসুম গরম পানিতে এর খোসা ফেলেও গোসল করা যায়। তবে চাইলে পানির সঙ্গে খোসার তেল মিশিয়ে নিতে পারেন।

দাঁত ও মুখের ক্ষেত্রে:

মুখের দূর্গন্ধ নিয়ে অনেকেই নানা রকম সমস্যায় ভুগেন। কিন্তু এ দূর্গন্ধ দূর করতে অনায়েসেই ব্যবহার করতে পারেন কমলা লেবুর খোসা। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে বা দিনের যেকোনো সময়ে কমলার খোসা চিবিয়ে খেতে পারেন। এতে আপনার মাড়িও ভালো থাকবে আর মুখের দূর্গন্ধও অনেকটা দূর হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে কমলার খোসা চিবিয়ে খেলে দাঁত অনেক সাদা ও ঝকঝকে হয়ে যাবে। সবচেয়ে ভালো ও প্রাকৃতিক উপায়ে দাঁতের কালো ও হলদে ভাব দূর করতে পারে কমলার খোসা। শুধু কমলার খোসার ভেতরের দিকে একটু পানি ছিটিয়ে দিয়ে দাঁত ঘষে নিতে হবে। আপনি চাইলে কমলার কাঁচা খোসা বেটে পেস্টের মতোও ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া ত্বকের ক্ষেত্রে কমলা লেবুর রস খুবই উপকারি।

ক্যান্সার ও হাড়ের রোগ প্রতিরোধে:

কমলার খোসায় ফ্লেভোনয়েড রয়েছে যা ‘হেস্পিরিডিন’ নামে পরিচিত। এটি কোলন ক্যান্সার এবং অস্টিওপরোসিস বিরুদ্ধে কাজ করে আমাদের রক্ষা করে।

অ্যাজমা ও কাশির সমস্যা লাঘবে:

কমলার খোসার গুঁড়ো কাশির সমস্যা দূর করে। এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা ও অ্যাজমা উপশমে এটি কাজে লাগে। এসব কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে কমলার খোসায় তৈরি চা নিয়মিত পান করুন। আবার কমলার খোসা দিয়ে মোরব্বা বা টফিও তৈরি করে রাখা যায়। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন সকালে এ টফি চা পানের সময় ভালো করে চিবিয়ে খান। তাহলে রোগমুক্তি ঘটবে।

দাঁতের হলুদ ভাব কাটাতে :

কমলার খোসায় ছিটিয়ে নিন সামান্য পানি। এরপর সেই পানি মাখা খোসা দাঁতে ঘষে নিন। এতে দাঁতের হলদেভাব নিমেষে চলে যাবে। চাইলে খোসা বেটে তা পেস্টে লাগিয়েও ব্যবহার করতে পারেন। ঘরের গন্ধ দূর করতে : একটি পাত্রে পানি নিয়ে তাতে সামান্য দারুচিনি, কমলার খোসা দিয়ে কয়েক মিনিট ফুটিয়ে নিন। এই মিশ্রণের গন্ধে ঘরে থাকা শীতের স্যাঁতস্যাঁতেভাবের গন্ধ চলে যাবে।

অ্যাসিডিটি দূর করতে:

কমলার খোসার তেলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি রয়েছে যা পেটের অ্যাসিডিটি দূরীকরণে সহায়তা করে। এছাড়াও এতে ডি-লিমোনেন নামের একটি উপাদান আছে যা অন্ত্র ও লিভার ফাংশনকে স্বাভাবিক রাখে। আর এর তেল পানিতে দু’ফোঁটা মিশিয়ে পান করলে অ্যাসিডির সমস্যা একেবারেই চলে যাবে।

ত্বকের জন্য ব্যবহার:

কমলার খোসায় সাইট্রিক অ্যাসিডের উপস্থিতি বেশি হওয়ায় এটি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সহায়তা করে। ঘরে কমলার খোসার পাউডার তৈরি করা খুব সহজ এবং এর মাধ্যমে বানানো কষজাতীয় পদার্থ প্রাকৃতিকভাবে ত্বককে উজ্জ্বল করে। এটি চমৎকার ব্ল্যাক হেড রিমুভার হিসেবে কাজ করে। প্রতিদিন মুখে ভালো করে ঘঁষলে মুখের কালো দাগ ও ব্রণের দাগ দূর হয়। কিছু খোসাকে সূর্যের আলোয় শুকান এবং একটি গ্রিন্ডারে ব্লেন্ড করুন, যতক্ষণ না খোসাগুলো চমৎকার পাউডারে পরিণত না হয়। কেউ চাইলে কমলার খোসার পাউডার দইয়ের সাথে মিশিয়ে ফেসপ্যাক হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। একই উপায়ে মুখের স্ক্রাব হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন।

অনিদ্রা দূর করে:

কমলার খোসা গোসলের পানিতে ব্যবহার করলে এটি অনিদ্রা দূর করে। খোসা গুলো কাঁটাচামচ দিয়ে ভালো করে কেঁচে নিন। তারপর গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। পানির তাপমাত্রা কুসুম গরম থাকতে থাকতে গোসল সেরে নিন। চাইলে মিশিয়ে দিতে পারেন খোসায় তৈরি এসেনশিয়াল অয়েলও।

কমলার খোসার ব্যবহার

কমলা লেবু শীতকালীন ফল হলেও এখন সারা বছরই পাওয়া যায়। প্রচুর পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এ ফলটি খাওয়া খুবই উপকারি। কমলা লেবু খাওয়ার পর সাধারণত আমরা খোসা ফেলে দেই। কিন্তু অনেকেই জানি না যে, কমলার খোসায় রয়েছে অসাধারন পুষ্টিগুণ। চলুন জেনে আসি কমলার খোসার কিছু ব্যবহার -

খোসার জেলি :

কমলালেবুর জেলির মতো এর খোসা থেকে তৈরি জেলি বেশ সুস্বাদু হয়।

উপকরণ- দু’টা কমলালেবু, দু’কাপ লেবুর খোসা, এক টেবিল চামচ জিলেটিন, সামান্য জল, দু’টেবিল চামচ চিনি, আর দু-তিন ফোঁটা অরেঞ্জ এসেন্স।

পদ্ধতি- একটি পাত্রে প্রথমে পানি ও জিলেটিন মিশিয়ে নিন। এবার কমলালেবু থেকে রস বের করে নিয়ে ছিঁবড়েটা ফেলে দিন। এবারে খোসাগুলো পেস্ট করে নিতে হবে। এবার জিলেটিন মিশ্রণটি হালকা আঁচে গলে যাওয়া পর্যন্ত রান্না করুন। এরপর মিশ্রণটি ঠান্ডা করে তাতে রস, পেস্ট করা ছাল, চিনি আর অরেঞ্জ এসেন্স মিশিয়ে দিন। চিনি গলে যাওয়া পর্যন্ত হালকা আঁচে রাখুন। চিনি গলে গেলে মিশ্রণটি ঠান্ডা করে ছাঁচে ফেলে চার থেকে ছয় ঘণ্টা ফ্রিজে রাখলেই তৈরি কমলালেবুর খোসার জেলি।

কমলালেবুর খোসার চা

ভিটামিন সি-তে সমৃদ্ধ কমলালেবুর খোসা চা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তো বাড়িয়ে দেয়। শীতের সকালে ঘুম কাটতে না চাইলে এই চা মুখে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকালটা সতেজতায় ভরিয়ে তুলবে। রোদে বা শুকনো খোলায় কমলালেবুর খোসা একটু নাড়াচাড়া করে নিন। রস একেবারে শুকিয়ে গেলে মিক্সিতে গুঁড়ো করে রেখে দিন। সকালবেলা উঠে গরম পানিতে আধ চা চামচ এই খোসার গুঁড়া নিয়ে তা গুলে নিলেই হল। অবশ্য এই চায়ের সঙ্গে যদি একটু আদা মিশিয়ে নিতে পারেন, স্বাদ বাড়বে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে এই চা খেলে সাধারণ সর্দি-কাশি হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। এ ছাড়া, হজমের সমস্যা বা অ্যাসিডিটি হলে এই চা খেতে পারেন। অনেক উপকার হয়। যাদের সকালে ডিটক্স ওয়াটার খাওয়ার অভ্যাস আছে, তারা এই চা খেলে আলাদা করে আর কিছু খাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে ধরনের সংক্রমণ হয়, তা ঠেকাতে, ওজন ঝরাতেও খেয়ে দেখতে পারেন কমলালেবুর খোসা দিয়ে বানানো চা।

রান্নার ক্ষেত্রে:

কমলার খোসা রান্নায় ব্যবহার করলে রান্নার স্বাদ ও গন্ধ অনেকটাই বেড়ে যায়। এর পাশাপাশি কমলা লেবুর খোসায় ভিটামিন সি রয়েছে, তা শরীরে প্রবেশ করে ভিটামিন সি-এর অভাব পূরণ করে থাকে। বাড়তি কোনো রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার না করে কেক বিস্কুট ইত্যাদি তৈরির সময় কমলা লেবুর খোসা ব্যবহার করতেই পারেন। এছাড়াও কমলার খোসা সালাদ তৈরিতে ব্যবহার করলে একটা অসাধারণ ভিন্ন স্বাদ যোগ হবে।

রুম ফ্রেশনার হিসেবে

রুম সুগন্ধি হিসেবে জুড়ি নেই কমলার খোসার। কমলার খোসা গরম পানিতে দিয়ে ফুটিয়ে নিন। সঙ্গে আরও কিছু সুগন্ধি ভেষজ যোগ করতে পারেন। ফুটে উঠলে জ্বাল কমিয়ে দিন। ধীরে ধীরে সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়বে রান্নাঘরসহ পুরো বাড়িজুড়ে। রান্নাঘরে থাকা মাছ, মাংসের গন্ধও দূর করা যায় এই পদ্ধতিতে।

খাবারে সুগন্ধ আনতে 

খাবারে সুগন্ধি ফ্লেভার আনতে অরেঞ্জ পিল জেস্ট বা কমলার খোসা কুচি করে মেশাতে পারেন। বিভিন্ন ধরনের সালাদেও মিশিয়ে নেওয়া যায় এই খোসা কুচি।  

অন্যান্য ক্ষেত্রে:

কোনো কারণে চিনি ভিজে গেলে তাতে কিছু শুকনো কমলা লেবুর খোসা রেখে দিতে পারেন। শুকনো কমলার খোসায় রয়েছে আদ্রতা শোষণ করার ক্ষমতা। এটা সহজেই চিনির আদ্রতা শোষণ করে চিনিকে করে তুলবে ঝরঝরে। বর্ষাকালে চিনিতে ভেজা ভেজা ভাব হলে এটা করে দেখতে পারেন। ঘরের স্যাঁতস্যাঁতে ভাব ও গন্ধ দূর করার কাজেও ব্যবহার করতে পারেন কমলার খোসা।

কমলার অপকারিতা 

আপনার পছন্দের কমলালেবুটি আপনার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে কমলা লেবুর উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ যেমন রয়েছে তেমন এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তাই কমলালেবু খাওয়ার আগে চলুন কমলা লেবুর অপকারিতা গুলো জেনে নিন।

১। অতিরিক্ত কমলালেবু খাওয়ার ফলে আপনার পেট ব্যথার মত সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

২। অতিরিক্ত কমলালেবু আপনি যদি খেয়ে থাকেন তাহলে আপনার ডায়রিয়ার মত সমস্যা সৃষ্টি হবে।

৩। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অতিরিক্ত ও অনিয়ত কমলার পরিমাণ বেশি খাওয়ার কারণে বুক জ্বালা বদহজম ও গলা জলার মত সমস্যা দেখা দিতে পারে।

৪। অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যায় যাদের হার্ট ও কিডনি সমস্যা রয়েছে এবং ডাক্তার অনেক সময় কমলালেবু খাওয়া থেকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকেন। কমলালেবু তো রয়েছে পটাশিয়াম অনেক সময় হার্ট ও কিডনি সমস্যায় যারা ভোগেন এবং পটাশিয়ামযুক্ত খাবার থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকে তারা এ থেকে বিরত থাকবেন।

তথ্যসূত্র: banglanews24.com