কমলার খোসা দিয়ে রূপচর্চা-Beauty with orange peel
Orange Peel Powder for Skin

উজ্জ্বল ত্বক পেতে কমলার খোসা দিয়ে রূপচর্চা

শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে আগমন ঘটে কমলালেবুর। খাদ্য তালিকায় তাই এই ফলটি থাকবেই। কমলালেবুর খোসা না ফেলে দিয়ে আপনি চাইলে ব্যবহার করতে পারেন ত্বকের যত্নে। ফলে খাওয়া এবং রূপচর্চা দুটোই হলো। শীত আসা মানেই ত্বকে টানটান ভাব হতে শুরু করে। বিভিন্ন ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করেও দেখা যায়, অনেকের ত্বকের শুস্কতা কাটে না। নিষ্প্রাণ ত্বকের জন্য তাই কমলালেবুর থেকে ভালো আর কিছুই হতে পারে না। 

ভিটামিন সি- ত্বককে সূর্যের ফ্রি র‌্যাডিক্যাল থেকে রক্ষা করে। ব্রণ সৃষ্টিকারী জীবাণু মেরে ফেলে আপনাকে স্বাস্থ্যকর ত্বক। ক্যালসিয়াম- জরাজীর্ণ ত্বককে সতেজ হতে সহায়তা করে এবং ডিএনএর ক্ষতি প্রতিরোধ করে। ত্বকের শুষ্কতা এবং অ্যালার্জি নিরাময়ের জন্যও ভাল। পটাসিয়াম- ডিহাইড্রেটেড ত্বককে হাইড্রেটকরে। ত্বকের আর্দ্রতা সংরক্ষণে সহায়তা করে। ম্যাগ্নেসিয়াম- তরুণ এবং ঝলমলে ত্বকের জন্য কোষের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস প্রতিরোধ করে। এছাড়া, এর রয়েছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য যা প্রতিদিনকার জীবাণু, ব্রণ ও চর্মরোগ থেকে আপনার ত্বককে রক্ষা করে।

কমলার খোসা ব্যবহারের পদ্ধতি:

কমলার খোসা বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহার করা যায়। সব থেকে বেশি ব্যবহৃত হয় খোসার গুঁড়ো। কমলার খোসার গুঁড়ো বাজারেই কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু আপনি চাইলে ঘরে বসে খুব সহজেই এটি বানিয়ে ফেলতে পারেন। তার জন্য ১০-১২টি কমলা ধুয়ে পরিষ্কার করে নিন। কমলার খোসা ছাড়িয়ে সেগুলো একটি ডালায় রোদে শুকোতে দিন। আপনি কাজটি ঝটপট করতে চাইলে ওভেনও ব্যবহার করতে পারেন। পুরোপুরি শুকিয়ে মচমচে হয়ে গেলে খোসা গুলো ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে নিন। হয়ে গেল কমলার খোসা গুঁড়ো যা আপনি বেশ কয়েক মাস একটি কাঁচের বয়ামে সংরক্ষণ করতে পারবেন। এই কমলার খোসার গুড়োগুলোকে আপনারা চাইলে শুকনো কোনো ঢাকনা যুক্ত পাত্রে ৩-৪ মাস পর্যন্ত সঞ্চয় করে রাখতে পারেন। 


এছাড়াও সতেজ কমলার খোসা ব্লেন্ড করে বা পানি দিয়ে জালিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। চলুন জেনে নেই এখন কমলার খোসা ব্যবহারের বিভিন্ন পদ্ধতি।

কমলার খোসা দিয়ে ক্লীনজার:

ত্বক পরিষ্কার বা ফেশিয়ালের সর্ব প্রথম ধাপটি হল ক্লীনজিং। কমলার খোসা দিয়ে খুব কার্যকর উপায়ে ত্বক পরিষ্কার করা সম্ভব। কারণ এতে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি ত্বকের লাইটনিং এজেন্ট হিসাবেও কাজ করে এবং পিগমেন্টেশন চিহ্নের জন্য আশ্চর্যজনকভাবে কাজ করতে পারে। কমলা খোসাযুক্ত ফেস প্যাকগুলো ফেস ক্লীনজারহিসাবে ব্যবহারে ত্বককে সতেজ দেখায়।কমলা খোসার বিভিন্ন বেস মিশ্রণের সাথে যুক্ত করে যেকোনো ধরণের ত্বকের সমস্যার প্রতিকারের জন্য সেরা।

ক্লীনজার তৈরি করতে যা যা লাগবে:

১. একটি কমলার খোসা।

২. একটি শসা।

প্রথমে শসাটি ধুয়ে মুখ কেটে কষ বের করে ছোট ছোট টুকরো করে নিন। এবার শসার টুকরো গুলো কমলার খোসার সাথে ব্লেন্ড করে ফেলুন। প্রয়োজনে সামান্য পানি ব্যবহার করতে পারেন। পুরোপুরি ব্লেন্ড হলে ব্যস তৈরি হয়ে গেল ক্লীনজার।

হাতের তালুতে এই ক্লীনজার নিয়ে ত্বক আলতোভাবে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করুন সাবানের মত। এই ক্লীনজার সব ধরণের ত্বকের জন্যই উপযুক্ত। কিন্তু আপনার ত্বক যদি খুব বেশি শুষ্ক হয়ে থাকে তাহলে ২-৩ ফোঁটা ইসেশিয়াল তেল ব্যবহার করুন সাথে।

কমলার খোসা দিয়ে বডি স্ক্রাব:

ক্লীনজিং এর পরবর্তী ধাপ হচ্ছে স্ক্রাবিং। বডি স্ক্রাব একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি যা মূলত দেহের ও মুখের ত্বককে এক্সফোলিয়েট এবং হাইড্রেট করে। ত্বকের মৃত কোষ সরিয়ে ত্বককে করে মসৃণ এবং নরম। বডি বা ফেইস স্ক্রাব সাধারণত লবণ বা চিনি এবং ম্যাসাজের জন্য তেল এবং অন্যান্য উপাদান ব্যবহৃত হয়।

কমলার খোসা দিয়ে বডি স্ক্রাব বানাতে যা যা লাগবে:

১. চিনি- ১কাপ।

২. নারকেল তেল বা অলিভ ওয়েল- ৩/৪চা চামচ।

৩. মধু- ২চা চামচ।

৪. তাজা কমলা- ১টি।

একটি পাত্রে চিনি, তেল ও মধু একসাথে মিশিয়ে নিন। এবার একটি গ্রেটারের সাহায্যে কমলার খোসা আস্তে আস্তে পাত্রে কুচি করে দিন। খেয়াল রাখবেন যেন খোসার সাদা অংশ না দিয়ে ফেলেন। মিশ্রণটি আবার মিশিয়ে নিন। তৈরি হয়ে গেল স্ক্রাব। ফেশিয়ালের সময় মুখ পরিষ্কার করে কিংবা গোসলের সময় পুরো শরীরেও এই স্ক্রাব ব্যবহার করতে পারবেন। এই স্ক্রাব সব ধরণের ত্বকের সাথেই মানানসই। বিশেষ করে যাদের ত্বক খুব রুক্ষ তাদের জন্য এটি খুবই কার্যকরী। কিন্তু আপনার ত্বকে যদি কোন ক্ষত থেকে থাকে তাহলে স্ক্রাব ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।

স্ক্রাবটি সংরক্ষণের জন্য একটি পরিষ্কার কাঁচের বয়াম ব্যবহার করুন। খেয়াল রাখুন বয়ামটি যেন শুষ্ক হয়। বয়ামে ভরে স্ক্রাবটি রেখে দিতে পারেন বাথরুম সেলফে। এটি ২-৩ মাস পর্যন্ত ভালো থাকবে।


কমলার খোসা দিয়ে ফেস প্যাক:

ফেস প্যাক বা মাস্ক কে না পছন্দ করে? স্ক্রাবের পর একটি ফেস প্যাকত্বকের পৃষ্ঠ থেকে ময়লা, তেলদূর করে আপনার ত্বক পরিষ্কার করতে সহায়তা করে। তবে আপনি কি জানেন যে সঠিক মাস্কিং প্রক্রিয়া আপনার ফেশিয়াল রুটিনকে পুরো নতুন স্তরে নিয়ে যায়? এপিডার্মিসের শীর্ষ স্তরগুলির নীচে লুকিয়ে থাকা অমেধ্যগুলি আঁটকিয়ে ত্বক পরিষ্কার করতে কেবল একটি ভাল ফেসিয়াল মাস্ক বা ফেস প্যাক সাহায্য করতে পারে। ফেস প্যাক ব্যবহার করার সময় ত্বক একটি "ডিটক্সিং" এর মধ্য দিয়ে যায়। প্যাক  ব্যবহারের সাথে তাৎক্ষণিক আপনি ত্বকে পরিবর্তন লক্ষ্য করবেন। ত্বকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোমকূপ গভীরতর পরিষ্কারে অবিশ্বাস্যভাবে কার্যকর ফেস প্যাক। এবং আপনি তা খুব ভালভাবে দেখতে এবং অনুভব করতে পারেন। চলুন জেনে নেই কমলার খোসা দিয়ে একটি ফেস প্যাক তৈরির পদ্ধতি।

উপকরণ:

১. টক দই- ৩ টেবিল চামচ।

২. হলুদ গুঁড়ো- ১/২ চা চামচ।

৩. মধু- ১চা চামচ।

৪. কমলার খোসা গুঁড়ো- ১চা চামচ।

একটি পরিষ্কার পাত্রে টক দই আগে নিয়ে ফেটিয়ে নিন। তারপর এর মধ্যে বাকি সব উপাদান গুলো একে একে ঢেলে ভালভাবে মিশিয়ে নিন। এবার একটি নরম ব্রাশের সাহায্যে মুখে মেখে নিন। ২০ মিনিট পর কুসুম গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিন। শুষ্ক হোক বা তৈলাক্ত, এই ফেস প্যাক সব ক্ষেত্রেই কার্যকর, বিশেষ করে ব্রণের জন্য। কিন্তু যদি আপনার ত্বকে কোন ক্ষত থেকে থাকে তাহলে হলুদ গুঁড়ো ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। এই ফেস প্যাক রক্ত সঞ্চালনকে উৎসাহিত করতে সহায়তা করে। ফেসপ্যাক শুকানোর প্রক্রিয়ায় আপনার ত্বকের রক্তনালীতে প্রসার ঘটে। যা আপনার ত্বককে নরমঅনুভূতি দেয়। মসৃণ চেহারার সাথে ত্বকে রেখে যায় দীপ্তিমান আভা এবং সতেজতা।


কমলার খোসা দিয়ে পিল অফ মাস্ক:

পরিষ্কার ত্বক স্বাস্থ্যকর ত্বক। আর ত্বক পরিষ্কারের সর্ব শেষ ধাপটি হচ্ছে পিলঅফমাস্ক। এটি ত্বকের উপরের মৃত স্তর এবং ক্ষুদ্র লোমকূপের ময়লা তুলে ফেলে। মাস্ক শুকানোর পরে আপনি যখন তুলে ফেলেন তখন এটি ধূলিকণা এবং ময়লার সমস্ত অণু কণা তুলে ফেলে। আর সাথে সাথেই আপনি অনুভব করতে পারবেন দীপ্তিমান আভা!

পিল অফ মাস্ক আপনার ত্বককে উজ্জ্বল এবং আরও টানটান দেখায়। ফেস প্যাক ব্যবহারের পর একটি পিলঅফ মাস্ক আপনাকে আরও সজীব ও তরুণ দেখাবে। নিয়মিত ব্যবহারে আপনি সূক্ষ্ম বলি রেখার হ্রাসের বিষয়টিও লক্ষ্য করতে পারবেন;বিশেষত যদি আপনার পিলঅফ মাস্কে ভিটামিন সি, ভিটামিন ই বা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্যযুক্ত এক্সট্রাক্ট থাকে। এরকম একটি পিল অফ মাস্ক খুব সহজেই বানাতে পারেন কমলার খোসা দিয়ে।

উপকরণঃ

১. ২টি কমলার খোসা।

২. ১ প্যাকেট জেলাটিন পাউডার।

৩. ভিটামিন ই ইসেনশিয়াল ওয়েল।

৪. ১ কাপ পানি।

পিল অফ মাস্ক বানাতে প্রথমে একটি পাত্রে ১ কাপ বা ২৫০ মিলি পানি নিয়ে তার ভিতর কমলার খোসা গুলো দিয়ে মাঝারি আঁচে জ্বাল দিন। পানি অর্ধেক হয়ে গেলে চুলা থেকে নামিয়ে খোসা গুলো তুলে ফেলুন। এবার এই জ্বাল দেওয়া গরম পানিতে এক প্যাকেট জেলাটিন পাউডার ও ২-৩ ফোঁটা ভিটামিন ই ইসেনশিয়াল ওয়েল দিয়ে ভালো করে গুলে নিন। জেলাটিন পাউডার মিশে গেলে মিশ্রণটি একটু ঠাণ্ডা করে নিন। কিছুটা ঘন হয়ে এলে একটি ব্রাশের সাহায্যে ঠোঁট এবং চোখের অংশ ছাড়া মুখের বাকি অংশে মেখে নিন। ২০ মিনিট পর ধীরে ধীরে হাত দিয়ে মাস্কটি তুলে ফেলুন। এটি একটি সাধারণ পিল অফ মাস্ক। তাই সব ধরণের ত্বকেই এটি ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু সেনসিটিভ ত্বক হলে যত্ন সহকারে মাস্কটি তুলবেন।

পিল অফ মাস্ক লাগানোর একটি কার্যকরী পদ্ধতি হচ্ছে লোম বৃদ্ধির দিকে লাগানো। আর তার উল্টো দিকে তুলে ফেলা অর্থাৎ লোম বৃদ্ধির বিপরীত দিকে। এতে করে ব্লাকহেডস যেমন উঠে আসবে; মুখের ছোট ছোট লোমও অপসারিত হবে। ত্বকের ক্ষুদ্র লোমকূপ কমে আসবে আর ত্বক হবে টানটান!

কমলার খোসা দিয়ে টোনার:

একটি ফেশিয়ালের দ্বিতীয় অংশের প্রথম ধাপটি হল টোনার ব্যবহার করা। অনেকেই টোনারের সাথে পরিচিত না বা এর গুণাগুণ সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই বলে এটি ব্যবহার করেন না। কিন্তু ক্লীনজার কিংবা ময়েশ্চারাইজারের মতই এটি ত্বকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সহজভাবে বলতে গেলে টোনার পানির মত একটি পদার্থ যা পানির মতই দেখায় এবং পানির মতো কাজ করে। তবে এটি পানি নয়। এটি হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে ভরা। টোনারের অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য একে অনেক কার্যকরী করে তুলে।

উপকরণঃ

১. কমলার খোসা গুঁড়ো- ১চা চামচ।

২. অ্যালো ভেরা জেল- ২চা চামচ।

৩. গোলাপ জল- ১০০ মিলি।

প্রথমে একটি পাত্রে কমলার খোসা গুঁড়ো, অ্যালো ভেরা জেল ও গোলাপ জল ভালভাবে মিশিয়ে নিন। মেশানো হলে একটি ছাকনির সাহায্যে মিশ্রণটি একটি পরিষ্কার স্প্রে বোতলে ঢেলে নিন। ঢাকনা লাগিয়ে দিয়ে বোতলটি আপনার হাতের তালুতে আলতো করে প্রায় ৩0 সেকেন্ডের জন্য রোল করুন। ব্যাস তৈরি হয়ে গেল টোনার। অ্যালকোহল মুক্ত এই টোনার সব ধরণের ত্বকের জন্যই উপকারী।

এভাবে ফেশিয়ালের বিভিন্ন ধাপে ব্যবহার করতে পারেন কমলার খোসা। ঘরে তৈরি এই ফেশিয়াল ক্ষতিকারক কেমিক্যাল মুক্ত।খোসারখনিজ, ফলিকঅ্যাসিড এবং প্রাকৃতিক তেল আপনার ত্বককে প্রাণ ফিরে পেতে সাহায্য করে এবং সেটিও কোন ধরণের রাসায়নিক পদার্থ ছাড়া। এটিঅন্যান্য মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সমৃদ্ধ যা ত্বককে পুষ্টি দেয় এবং নিরাময় করে। বাজারের বিভিন্নব্যয়বহুল ত্বকের পণ্য'ফলের মিশ্রণ' রাখার দাবি করে, কিন্তু তাতে কেবলমাত্র ফলের মধ্যে পাওয়া যায় এমন কিছু পুষ্টিগুলির একটি অংশমাত্র থাকে। তাই নিজের অর্থ ব্যয় না করে এসব রাসায়নিক পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকুন এবং নিজেই ঘরে তৈরি ফেশিয়াল সামগ্রী ব্যবহার করুন। এতে ত্বক যেমন সুরক্ষিত থাকবে মনেও প্রশান্তি আসবে।

তথ্যসূত্র: somoynews.tv