কোষ্টকাঠিন্য রোগের কারণ ও প্রতিরোধের উপায়
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপরিকল্পিত ডায়েট, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হয়ে থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই সমস্যা বংশগত। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় সময় মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিতে পারলে তা কোলন ক্যান্সারের আশঙ্কা বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্যের ফলে শরীর থেকে মল প্রতিদিন স্বাভাবিক ভাবে নির্গত হতে পারে না। পেট ভরে কিছু খাওয়ার ক্ষেত্রেও সব সময় যেন একটা ভয় তাড়া করে বেড়ায়।
কোষ্ঠকাঠিন্য ( Constipation) কি
কোষ্ঠ অর্থ হচ্ছে মলাশয়। কোষ্ঠকাঠিন্য অর্থ হচ্ছে মলাশয়ের মল ঠিকমতো পরিষ্কার না হওয়া বা মলে কাঠিন্যহেতু মলত্যাগে কষ্টবোধ হওয়া। যদি যথেষ্ট পরিমাণ আঁশ জাতীয় খাবার খাওয়ার পরও সপ্তাহে তিন বারের কম স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত মলত্যাগ হয়, তবে তাকে কোষ্ঠকাঠিন্য বলে।
লক্ষণ বা উপসর্গ
মূল উপসর্গটাই হলো শক্ত ও কঠিন মল। এর সঙ্গে নিম্নে উল্লিখিত এক বা একাধিক উপসর্গও থাকতে পারে।
১.মলত্যাগে অনেক বেশি সময় লাগা
২.অনেক বেশি চাপের দরকার হওয়া
৩.অধিক সময় ধরে মলত্যাগ করার পরও অসম্পূর্ণ মনে হওয়া
৪.মলদ্বারের আশপাশে ও তলপেটে ব্যথা
৫. প্রায়ই আঙ্গুল, সাপোজিটরি বা অন্য কোনো মাধ্যমে মল বের করার চেষ্টা করা হয়। যা ঠিক নয়।
কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ
১. আঁশজাতীয় খাবার এবং শাকসবজি ও ফলমূল কম খেলে।
২. পানি কম খেলে।
৩. দুশ্চিন্তা করলে।
৪. কায়িক পরিশ্রম, হাঁটা-চলা কিংবা ব্যায়াম একেবারেই না করলে।
৫. অন্ত্রনালীতে ক্যান্সার হলে।
৬. ডায়াবেটিস হলে।
৭. মস্তিষ্কে টিউমার হলে এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে।
৮. অনেক দিন বিভিন্ন অসুস্থতার কারণে বিছানায় শুয়ে থাকলে।
৯. বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সেবন, যেমন-
ক. ব্যথার ওষুধ
খ. উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ
গ. গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ
ঘ. খিঁচুনির ওষুধ
ঙ. যেসব ওষুধের মধ্যে আয়রন, ক্যালসিয়াম ও অ্যালুমিনিয়ামজাতীয় খনিজ পদার্থ থাকে। তা ছাড়া স্নায়ুতন্ত্র ও হরমোনের বিভিন্ন ধরনের অসুবিধার জন্যও কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। এর মধ্যে কাঁপুনিজনিত অসুখ, স্নায়ু রজ্জু আঘাতপ্রাপ্ত হলে, কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা ও থাইরয়েডের সমস্যা উল্লেখযোগ্য।
কোষ্ঠকাঠিন্য চিকিৎসা না করা হলে যে সমস্যা হতে পারে
১. পায়খানা ধরে রাখার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
২. পাইলস।
৩. এনালফিশার।
৪. রেকটাল প্রোলাপস বা মলদ্বার বাইরে বের হয়ে যেতে পারে।
৫. মানসিকভাবে রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা থাকে।
৬. প্রস্রাব বন্ধ হতে পারে।
৭. খাদ্যনালীতে প্যাঁচ লেগে পেট ফুলে যেতে পারে।
৮. খাদ্যনালীতে আলসার বা ছিদ্র হয়ে যেতে পারে।
৯. কোষ্ঠকাঠিন্য যদি কোলন ক্যান্সার এবং মস্তিষ্কে টিউমারের জন্য হয় এবং সময়মতো চিকিৎসা করা না হয় তবে অকালমৃত্যু হতে পারে।
যে ধরনের খাবার এড়িয়ে চলতে পারেন
দুধ: দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার (যেমন: পনির, আইসক্রিম ইত্যাদি) কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়াতে পারে অনেকের। এ ধরনের খাবারে আঁশের পরিমাণ কম। ছোট শিশু যারা শুধু কৌটার দুধ খায়, তাদের এ সমস্যা বেশি। তবে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় দুধ থাকা উচিত। টক দই হজমে সহায়ক।
মাংস: লাল মাংসে (গরু ও খাসির) চর্বি বেশি থাকে। এটা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। এই খাবার অন্ত্রে অনেকক্ষণ থাকে। মাংসের সঙ্গে পাতে যেন প্রচুর সবজি ও সালাদ থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
চিপস: স্ন্যাকস বা নাশতা হিসেবে পটেটো চিপসজাতীয় খাবার ভালো নয়। এগুলো কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়িয়ে দেবে।
হিমায়িত খাবার: সংরক্ষিত বা প্রক্রিয়াজাত খাবারে পানি শুকিয়ে ফেলা হয় ও লবণ বেশি থাকে। ফলে এ ধরনের খাবারে কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়বে।
বেকারি পণ্য: বেকারি পণ্য যেমনবিস্কুট, ক্র্যাকার্স, ডোনাট, পেস্ট্রিজাতীয় খাবারে চর্বি বেশি, জলীয় অংশ কম, আঁশও কম। এর ফলে যাঁদের কোষ্ঠকাঠিন্য আছে, তাঁদের জন্য এগুলো বর্জনীয়। ফল খাওয়াটা তাঁদের জন্য ভালো।
কাঁচকলা: কাঁচকলা খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়, এটা ঠিক। তবে পাকা কলায় যথেষ্ট আঁশ আছে। তাই ওটা খাওয়া যাবে।
ভাজাপোড়া: ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই, বিস্কুটের গুঁড়া ও ব্রেড ক্রাম্বে ভাজা যত খাবার আছে, সেগুলো অন্ত্রের চলন কমিয়ে দেয় ও কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়ায়।
কোষ্টকাঠিন্য থেকে মুক্তির উপায়
চিকিৎসকদের মতে, কোষ্ঠকাঠিন্য সারানোর চেয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য যেন না হয় সেভাবে জীবন যাপন করা বেশি ভাল। নিয়মিত শাকসবজি খাওয়া, প্রচুর পরিমাণে পানি খাওয়া বিশেষকরে সকালে খালি পেটে পানি খাওয়া, চর্বি ও আমিষযুক্ত খাবারের প্রতি মনোযোগ কমিয়ে দেয়া, সঠিক মাত্রায় ঘুম, ইত্যাদি কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে সাহায্য করে। তবে কোষ্ঠকাঠিন্য হলে দেরি না করে সাথে সাথে চিকিৎসা করা উচিত। এর জন্য নিচেরকোষ্ঠকাঠিন্য ভাল করার প্রাকৃতিক ঔষধগুলো খেতে পারেন।
কোষ্ঠকাঠিন্য ঔষধ
কোষ্ঠকাঠিন্য রোগের কারনের শারীরিক অস্বস্তির পাশাপাশি মানসিক দুশ্চিন্তাও বেড়ে যায়। কোষ্টকাঠিন্য থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে অনেক প্রাকৃতিক ঔষধ আছে যেগুলো হজমক্রিয়াকে গতিশীল করার পাশাপাশি এই রোগ ভাল করে। আর সেগুলো খুব সহজেই ঘরে বসে তৈরি করা যায়।
গরম পানিঃ অবাক করা হলেও সত্য যে, গরম পানি কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ সাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। নিয়মিত সকালে খালি পেটে ১ গ্লাস গরম পানি পান করলে কখনো কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ হবে না। শরীরে পানির অভাব মানে ডিহাইড্রেড হবে না। এটা ত্বকের জন্যও অনেক উপকারি। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে পায়খানা নরম করতে ২-৩ ঘণ্টা পর পর ১ গ্লাস কুসুম গরম পানি পান করুন এবং হাঁটাহাঁটি করুন।
লেবু পানিঃ লেবুর রস কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে খুব কার্যকরী। এতে থাকে পুষ্টিগুণগুলো হজমক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে মলত্যাগকে গতিশীল করে। এটা সবচেয়ে সহজ কিন্তু সর্বোত্তম পদ্ধতি। ১ গ্লাস কুসুম গরম পানির সাথে ১ টেবিল চামচ লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন। কোষ্ঠকাঠিন্য না সারা পর্যন্ত সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে এবং সন্ধ্যায় এটা পান করুন।
মধুঃ পায়খানা নরম করতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে মধু খুব কার্যকরী ভুমিকা পালন করতে পারে। যারা নিয়মিত ১ চা চামচ করে মধু খান তাদের কোনদিন কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ হবে না। কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পেতে দিনে ৩ বার ২ চা চামচ করে মধু খান। তবে খুব দ্রুত কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ১ গ্লাস গরম পানির সাথে ১ টেবিল মধু এবং ১ টেবিল চামচ লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন। এটাকে কোষ্ঠকাঠিন্য ভাল করার মহৌষধ বলা হয়।
উচ্চমাত্রায় আঁশযুক্ত শাকসবজিঃ শাকসবজিতে প্রচুর আঁশ বা ফাইবার আছে। এটা খুব সহজে হজম হয় এবং মলদ্বারকে শক্তিশালী করে। এছাড়াও এতে আছে প্রচুর পারিমানে পানি যা মলত্যাগের রাস্তাকে পিচ্ছিল এবং মলত্যাগের গতি বৃদ্ধি করে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, পালং শাক, শিম, শিমের বিচি মূলা, বেগুন, অন্যান্য সবুজ শাক, ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ আছে। এসব সবজি নিয়মিত খেলে হজমজনিত সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায় এবং নিয়মিত পায়খানা হয়। আধা গ্লাস পালং শাকের রসের সাথে আধা গ্লাস গরম পানি মিশিয়ে দিনে দুইবার পান করলে খুব দ্রুত কোষ্ঠকাঠিন্য সেরে যায়।
ক্যাস্টর তেলঃ ক্যাস্টর তেল দেহের অভ্যন্তরীণ ছোট ও বড় অন্ত্র বা নাড়িভুঁড়ির কর্মপ্রক্রিয়াকে বাড়িয়ে দেয় এবং এর নাড়াচাড়াকে আরো গতিশীল করে। খালি পেটে ১ থেকে ২ চা চামচ ক্যাস্টর ওয়েল খান। সুস্বাদু করার জন্য ফলের জুস বা মধু মিশিয়ে খেতে পারেন। এটা খাওয়ার কয়েক ঘন্টার মদ্ধে মলত্যাগের চাপ অনুভূত হবে। কোষ্ঠকাঠিন্য ভাল হয়ে গেলে এটা খাবেন না।
তিসির বীচিঃ তিসির বিচি (Flax Seed) নানা ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ একটি খাবার। এতে আছে প্রচুর ফাইবার এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। এছাড়াও এতে মল নরম করার অনেক গুনাগুণ আছে যা কোষ্ঠকাঠিন্যের ঔষধ হিসেবে অত্যান্ত ফলপ্রসূ। ১ গ্লাস পানিতে ১ টেবিল চামচ তিসির বিচি ২-৩ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পানিসহ তিসির বিচি খেয়ে ফেলুন। সকালে আপনার অন্ত্রের কার্যক্রম অনেক ভাল হবে।
আঙ্গুরঃ আঙ্গুরে অদ্রবণীয় (insoluble) ফাইবার যা পরিপাকতন্ত্রকে শক্তিশালী করে এবং হজমশক্তি দ্বিগুন করে। সারাদিন ২৫০ গ্রাম আঙ্গুর অথবা আধা গ্লাস আঙ্গুরের রস পান করুন। অথবা ১০-১২ টা বিচী ছাড়া কিসমিস দুধের সাথে কয়েক মিনিট আগুনে রেখে গরম করে নিন। তারপর কিসমিসগুলো দুধ সহ পান করুন। এটা সন্ধ্যায় করলে বেশি কার্যকরী হবে। এটা বাচ্চাদের জন্য বেশি উপকারী।
ঝোলাগুড়ের সরবতঃ শুনে অবাক হলেও, ঝোলাগুড় (Molasses) কোষ্ঠকাঠিন্য ভাল করার পাশাপাশি পায়খানা নরম করার প্রাকৃতিক ঔষধ হিসেবে অনেক ফলপ্রসূ। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ১ চা চামচ ঝোলাগুড় খেয়ে নিন। এটাকে সুস্বাদু করার জন্য গরম দুধের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন। কোষ্ঠকাঠিন্য জটিলাকার ধারণ করলে পরিমাণ বাড়িয়ে ২-৩ টেবিল চামচ করে খান। ঝোলাগুড়ে উচ্চমাত্রায় ক্যালরি আছে তাই এটা দিনে একবারের বেশি খাওয়া ঠিক হবে না।
শুকনা খাবারঃ শুকনা খাবার যেমন, খেজুর, কিসমিস, বাদাম, আলুবোখারা, ইত্যাদিতে উচ্চমাত্রায় ফাইবার এবং টারটারিক এসিড আছে। পায়খানা নরম করতে এসব খাবার খুব উপকারি। গবেষণায় দেখা গেলে যারা নিয়মিত প্রিতিদিন এক মুঠ পরিমাণ কিসমিস খায়, তাদের পায়খানা নরম থাকে এবং হজম জনিত কোন সমস্যা হয় না।
প্রাকৃতিক এন্টিবায়েটিকঃ এটা আমার নিজের আবিস্কার বলতে পারেন। আমি যাদেরকে এটার পরামর্শ দিয়েছি, সবার কাজ হয়েছে। ফলাফল ১০০ ভাল। তাই আমি এর নাম দিয়েছি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার প্রাকৃতিক এন্টিবায়েটিক ঔষধ।
উপাদানঃ আদা, রসূন, চাপাতা/টিব্যাগ, মধু, লেবুর রস, গরম পানি
ধাপ ১. আদা (১ বর্গ ইঞ্চি) এবং বড় সাইজের ৩ কোয়া রসূন (ছোট সাইজের কোয়া হলে পরিমাণ মত) একসাথে ছেঁচে হালকা রস করে নিন।
ধাপ ২. এক কাপ পানি চায়ের জন্য গরম করে নিন। ইচ্ছে করলে চাপাতা সহ গরম করে নিন।
ধাপ ৩. ১টি চায়ের কাপের মধ্যে আদা-রসুন ছেঁচা এবং লেবুর রস রাখুন। এবার ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দিন। সব শেষে দুই চা চামচ মধু দিয়ে ভাল করে সব একসাথে মিশিয়ে নিন।