টাইফয়েড জ্বরের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার
Typhoid Fever

টাইফয়েড জ্বরের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার

Causes, Symptoms, Treatment and Remedy of Typhoid Fever

শীত আসতেই জ্বর-ঠান্ডা-কাশিতে ভুগছেন অনেকেই। এ সময় জ্বরের লক্ষণ দেখলেই অনেকে করোনা ভেবে ভুল করে থাকেন। টাইফয়েড জ্বরও হতে পারে এ সময়। তাই লক্ষণ বুঝে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

সালমোনেলা টাইফি নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার কারণে রোগটি হয়। দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে প্রধানত দেহে এ জীবাণু ছড়ায়। ফলে জ্বরসহ নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। যেকোনো বয়সী টাইফয়েডে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে শিশুর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

টাইফয়েড কি

টাইফয়েড বা টাইফয়েড জ্বর (ইংরেজি: Typhoid fever) হল এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত রোগ, যা Salmonella typhi ব্যাক্টেরিয়ার কারণে হয়। লক্ষণ মৃদু থেকে তীব্র হতে পারে, সচরাচর জীবাণু প্রবেশের ৬-৩০ দিন পর লক্ষণগুলি দেখা যায়। প্রায়ই কয়েকদিনের ব্যবধানে জ্বর এর তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

রোগটি কীভাবে ছড়ায়?

যে এই রোগে আক্রান্ত, তার মলের মাধ্যমে এটি ছড়ায়। সাধারণত এ জীবাণু দ্বারা দূষিত খাবার এবং পানি কোনো সুস্থ মানুষ খেলে তিনিও এ রোগে আক্রান্ত হন।

টাইফয়েডের ঝুঁকি কাদের বেশি?

যেকোন বয়সেই টাইফয়েড হতে পারে, তবে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। শরীরে জীবাণু প্রবেশ করলেই টাইফয়েড হবে এমন কোন কথা নাই কারণ দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকলে অনেক সময়ই জীবাণু দেহে সংক্রমণ করতে পারেনা। তবে কম রোগপ্রতিরোধক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি যেমন এইচআইভি পজিটিভ ও এইডস রোগীরা সহজেই টাইফয়েডে আক্রান্ত হতে পারে। যেসব এলাকায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি সেসব জায়গায় ভ্রমণ করলেও এ রোগের জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

টাইফয়েড জ্বরের কারণ

টাইফয়েড একটি মারাত্মক পানিবাহিত রোগ। দুই ধরনের জীবাণুর সংক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে। ‘সালমোনেলা টাইফি’ এবং ‘সালমোনেলা প্যারাটাইফি’। সালমোনেলা টাইফির সংক্রমণে হয় টাইফয়েড জ্বর বা ‘এন্টারিক ফিভার’ আর সালমোনেলা প্যারাটাইফির সংক্রমণে হয় প্যারা টাইফয়েড জ্বর।”

সালমোনেলা টাইফি শরীরের বৃহদান্ত্রে আক্রমণ করে। দূষিত পানি ও খাবার গ্রহণের মাধ্যমে এই জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। এছাড়াও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি উদাসীনতার কারণেও এটি শরীরে প্রবেশ করতে পারে। তবে শরীরে সালমোনেলা টাইফি থাকলেই যে টাইফয়েড বা এন্টারিক ফিভার হবে তা নয়। এই ব্যাকটেরিয়া শরীরের পিত্তথলিতে জমা থাকে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই কেবল আক্রমণ করে।

টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ

সাধারণত রোগ-জীবাণু শরীরে প্রবেশের ১০ থেকে ১৪ দিন পর রোগের লক্ষণ সমূহ প্রকাশ পেতে থাকে। জ্বর এ রোগের প্রধান লক্ষণ যা প্রথম চার-পাঁচ দিন জ্বর বৃদ্ধি পায় জ্বর কখনো বাড়ে, কখনো কমে; তবে কোনো সময় সম্পূর্ণ ছেড়ে যায় না। এর প্রধান প্রধান লক্ষণসমূহ নিম্নরুপঃ

১.১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত টানা জ্বর হওয়া।

২.জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা ও শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।

৩.ক্ষুধামন্দা হওয়া সহ কারো কারো কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।

৪.শিশুদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া ও বমি হতে পারে।

৫.গা ম্যাজ ম্যাজ করা সহ রোগীর কফ বা কাশি হতে পারে ।

৬.প্রচণ্ড পেটে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।

৭.দ্বিতীয় সপ্তাহে রোগীর পেটে ও পিঠে গোলাপি রঙের দানা দেখা দিতে পারে।

৮.কারো কারো জ্বরের সঙ্গে কাশি হয়।

৯.হার্ট রেট বা হৃদস্পন্দন কমে যেতে পারে।

১০.ওষুধ চলা অবস্থায়ও সপ্তাহ খানেক জ্বর থাকতে পারে।

রোগ বোঝার উপায়

টাইফয়েড রোগ নির্ণয় করা কঠিন। তবে রোগ নির্ণয়ের নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হলো রক্তের কালচার। ভিডাল টেস্ট করা, অবশ্য ভিডাল টেস্ট কোনো নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা নয়। কেননা টাইফয়েড জ্বরের জন্য টিকা নিলেও এ পরীক্ষাটি পজিটিভ আসতে পারে। পায়খানা-প্র¯্রাব কালচার করে নিয়মিত ওষুধের মাধ্যমে  জীবাণু আলাদা করা যায়।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা

১. প্রথম সপ্তাহে-

রক্ত কালচার (রক্তে কোনো জীবাণু আছে কি-না পরীক্ষা করা)

কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট

২. ২য় এবং ৩য় সপ্তাহে-

মল কালচার

প্রস্রাব কালচার

 ভিডাল টেস্ট

টাইফয়েড থেকে কী কী সমস্যা হতে পারে?

টাইফয়েডের ঠিকমতো চিকিৎসা করা না হলে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। রোগীর সাধারণত যে সমস্যাগুলো ঘটতে পারে তা হলো :

ক্ষুদ্রান্ত্রে রক্তক্ষরণ কিংবা ক্ষুদ্রান্ত্র ফুটো হয়ে যাওয়া (যাকে চলতি বাংলায় আমরা নাড়ি ফুটো হওয়া বলি)।

মেনিনজাইটিস।

অস্থি ও অস্থিসন্ধিতে ইনফেকশন।

পিত্তথলির প্রদাহ।

কিডনির প্রদাহ।

হৃৎপিণ্ডের পেশির প্রদাহ।

টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধে করণীয়

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী টাইফয়েড জ্বরের জন্য নির্ধারিত ভ্যাক্সিন (টিকা) গ্রহণ করা রোগটি থেকে বেঁচে থাকার একটি উপায়। ইনজেকশন এবং মুখে খাওয়ার উভয় ধরনের ভ্যাক্সিন বাজারে পাওয়া যায়। ভ্যাক্সিন গ্রহণ করার ব্যাপারে চিকিৎসককের পরামর্শ নেওয়া দরকার। সব সময়  ভ্যাক্সিন ১০০% কার্যকর  হয়না তাই ভ্যাক্সিনের পাশাপাশি নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা দরকার।

১.শাকসবজি, ফলমূল এবং রান্নার বাসনপত্র সবসময় পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিতে হবে।

২.খাবার ভালভাবে রান্না বা সিদ্ধ করে তারপর খাওয়া উচিত।

৩.খাবার গ্রহণ, প্রস্তত বা পরিবেশনের পূর্বে খুব ভালভাবে হাত ধৌত করতে হবে।

৪.পর্যাপ্ত পরিমাণে ফুটানো পানি বা পরিশোধিত পানি সংরক্ষণ করতে হবে এবং পানি যাতে দূষিত হতে না পারে সে জন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংরক্ষণকৃত সেই পানি পান করা উচিত।

৫.বোতলজাত, পরিশোধিত বা ফুটানো পানি হতে বরফ তৈরি করা না হলে সেই বরফ মিশিয়ে পানি বা অন্য কোন পানীয় পান করা হতে বিরত থাকতে হবে।

৬.রাস্তার পার্শ্বস্থ দোকানের খাবার গ্রহণ এবং পানি পান করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

৭.টয়লেট সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে।

৮.টয়লেট ব্যবহারের পর, শিশুকে পরিষ্কার করার পূর্বে, খাবার প্রস্তুত বা পরিবেশন করার পূর্বে, নিজে খাওয়ার পূর্বে বা শিশুকে খাওয়ানোর পূর্বে সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত পরিষ্কার করতে হবে।

টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসা

রেজিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধক না হলে, ফ্লুরোকুইনোলন যেমন সিপ্রোফ্লক্সাসিন সবচেয়ে কার্যকরি। অন্যথায়, তৃতীয় প্রজন্মের সেফালোস্পোরিন যেমন সেফট্রায়াক্সন বা সেফোট্যাক্সিম কার্যকরি। মুখে খাওয়ার ঔষধের মধ্যে সেফিক্সিম ব্যবহার করা হয়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে টাইফয়েড প্রাণঘাতী নয়। অ্যান্টিবায়োটিক যেমন অ্যাম্পিসিলিন, ক্লোরাম্ফেনিকল, অ্যামক্সিসিলিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ইত্যাদি টাইফয়েড চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসায় এ রোগে মৃত্যুর হার ১% এ নেমে আসে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও স্যালাইন গ্রহণ করতে হবে।

টাইফয়েড জ্বরে ঘরোয়া সেবা দেওয়ার উপায়

প্রচুর পানি পান: টাইফয়েড হলে যতটা সম্ভব বেশি পরিমাণে পানি খেতে হবে। অবশ্য শুধু পানি নয়, এরসঙ্গে যেকোনও তরল খাবার খেতে পারেন। ফলের রস, হার্বাল চা-ও থাকতে পারে তালিকায়। টাইফয়েড থেকে ডাইরিয়া হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। তা যাতে না হয় তাই তরল খাবার খাওয়া প্রয়োজন। যেকোনও ফলের রস এক্ষেত্রে কার্যকরী হতে পারে। তরল যত বেশি শরীরে ঢুকবে, শরীর থেকে টক্সিন বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়বে। ফলে শরীর সুস্থ হবে তত তাড়াতাড়ি।

আদা: শরীরের যে কোনও রকম সমস্যায় আদা সবচেয়ে উপকারী। এতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে। এই অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রক্তকে বিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে। কিডনি থেকে অযাচিত পদার্থ বের করে দিতেও সাহায্য করে আদা। ফলে শরীর পরিষ্কার হয়। সবচেয়ে উপকারী কাঁচা আদা বা অর্ধেক রান্না করা আদা। এতে গুণাগুণ বেশি থাকে। তাই টাইফয়েডের সময় আদা যত শরীরে ঢুকবে, তত ভাল।

তুলসীপাতা: অনেক রোগের ওষুধ তুলসী। টাইফয়েডের জন্য এটি খুব সাধারণ ঘরোয়া ওষুধ। অনেক আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতেও কাজে লাগে তুলসী। টাইফয়েডেও এই পথ্য যথেষ্ট উপকারী। গরম জলে প্রথমে তুলসী পাতা হালকা করে ফুটিয়ে নিতে হবে। এতে বাইরের ধুলো চলে যাবে। তারপর অল্প মধু বা আদার রস বা গোলমরিচের গুঁড়ো দিয়ে তুলসী পাতা খাওয়া যেতে পারে। টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়া তাড়াতে খুব সাহায্য করে তুলসী।

অ্যাপেল সিডার ভিনিগার: এতে প্রচুর অ্যাসিডিক উপাদান থাকে। জ্বর কমাতে সাহায্য করে অ্যাপেল সিডার ভিনিগার। দেহ থেকে উত্তাপ বের করে এটি। টাইফয়েড মানেই জ্বর একটি বড় সমস্যা। এক্ষেত্রে বেশি জ্বর হলে অ্যাপেল সিডার ভিনিগার দেওয়া যেতে পারে। ডাইরিয়াকেও আটকায় এই ঘরোয়া টোটকা। দেহের পুষ্টি বৃদ্ধি করতেও সাহায্য করে।

ঠান্ডা পানির জলপট্টি: জ্বর বেশি হলে ঠান্ডা পানিতে কাপড় ভিজিয়ে মাথায় দিয়ে রাখতে হবে। অর্থাৎ বেশি বেশি করে জলপট্টি দিতে হবে। দেহের তাপমাত্রা আরও বেড়ে গেলে অবশ্য এতে আর কাজ হয় না। তখন ঠান্ডা পানিতে মাথা ধুয়ে দিতে হবে। ঠান্ডা পানি দিয়ে কাপড় ভিজিয়ে সারা গা মুছিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এতে জ্বর খুব তাড়াতাড়ি নেমে যায়।

আনারসের অবিশ্বাস্য স্বাস্থ্য উপকারিতা
পানিফলের পুষ্টি ও ভেষজগুণ-water caltrop benefits
শশার পুষ্টিগুণ
বথুয়া শাকের ঔষধি গুনাগুন
ঢেঁড়সের পুষ্টিগুণ
রোজায় গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা সমাধানে যা করবেন - What to do to solve gastric problems during ramadan
তোকমার গুনাগুণ
সিজোফ্রেনিয়ার রোগের লক্ষণ ও করণীয়
কোষ্টকাঠিন্য রোগের কারণ ও প্রতিরোধের উপায়
পায়ের গোড়ালি ফাটার কারণ ও প্রতিকার