সিজোফ্রেনিয়ার রোগের লক্ষণ ও করণীয়
সিজোফ্রেনিয়া হল একপ্রকার জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ব্যাধি। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর চিন্তাধারা এবং অনুভূতির প্রকাশের মধ্যে সঙ্গতি থাকে না ৷ রোগী বাস্তবতার বোধ বা উপলব্ধি হারিয়ে ফেলে, প্রায়ই হ্যালুসিনেশনে ভোগে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সামাজিক বা কর্মক্ষেত্রে অক্ষমতাজনিত অসুবিধার সম্মুখীন হন ৷
সিজোফ্রেনিয়ার কি
ভগ্নমনস্কতা একটি মানসিক রোগ। এই রোগের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে চিন্তাধারা এবং অনুভূতির প্রকাশের মধ্যে সঙ্গতি থাকে না৷ এর লক্ষণগুলো হলো উদ্ভট চিন্তা, বিভ্রান্তিকর বা অলীক কিছু দেখা, অসঙ্গতিপূর্ণ কথাবার্তা এবং অন্যরা যা শুনতে পায় না এমন কিছু শোনা। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সামাজিক বা কর্মক্ষেত্রে সচারচর অক্ষমতাজনিত অসুবিধার সম্মুখীন হন৷ ভগ্নমনস্কতার লক্ষণগুলি সাধারণত বয়ঃপ্রাপ্তির সময় দেখা দেয় এবং দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়৷ ইংরেজিতে রোগটিকে "স্কিটসোফ্রিনিয়া" (Schizophrenia) নামে ডাকা হয়।
ইংরেজি "স্কিটসোফ্রিনিয়া" শব্দটির উৎপত্তি গ্রীক শব্দমূল skhizein থেকে৷ এমন নামকরণ সত্ত্বেও স্কিটসোফ্রিনিয়া বলতে আদপে “দ্বিখন্ডিত মন” বুঝায় না; যদিও অনেক সময় সাধারণ মানুষ এটিকে ডিসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিজর্ডার (যা মাল্টি পারসনালিটি ডিজর্ডার বা স্প্লিট পারসোনালিটি নামেও পরিচিত) এর সাথে গুলিয়ে ফেলে; প্রকৃতপক্ষে এ দুটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যাধি৷
সিজোফ্রেনিয়া প্রকারভেদ
সিজোফ্রেনিয়া বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা - প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া, হেবিফ্রেনিক সিজোফ্রেনিয়া, ক্যাটাটনিক সিজোফ্রেনিয়া, সিম্পল সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি।
১) প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া : এক্ষেত্রে, কোনও ব্যক্তির নির্দিষ্ট কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস বা ধারণা, বিভ্রান্তি থাকতে পারে, হ্যালুসিনেশন হয়, যার সাথে বাস্তবতার কোনও সম্পর্ক নেই। যেমন- এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বিশ্বাস করতে পারে যে, কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর লোকেরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, কেউ তাকে বিরক্ত করছে।
২) হেবিফ্রেনিক সিজোফ্রেনিয়া : এর মূল বৈশিষ্ট্য হল, এতে আক্রান্ত রোগীরা অগোছালো চিন্তাভাবনা এবং বিশৃঙ্খল আচরণ করে। এক্ষেত্রে রোগীর সাধারণত অসংলগ্ন এবং অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা থাকে। এটি দৈনিক ক্রিয়াকলাপ যেমন রান্না করা, খাওয়া, নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া ইত্যাদিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
৩) ক্যাটাটনিক সিজোফ্রেনিয়া : এই ধরনের সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগী শারীরিকভাবে অদ্ভুত আচরণ করতে পারে, হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে রোগীর পেশি চালনার ভঙ্গি অস্বাভাবিক হয়, যেমন- হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যাওয়া, নিশ্চুপ হয়ে অদ্ভুত ভাবে বসে থাকা,অকারণে মারামারি, অন্যরা যা বলছে তা বারবার বলা, ইত্যাদি।
৪) সিম্পল সিজোফ্রেনিয়া : এক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণগুলি হালকা হয় এবং উগ্রতা প্রদর্শন করে না। যেমন- দুর্বল স্বাস্থ্যবিধি এবং অন্যান্য ছোটখাটো শারীরিক ও মানসিক সমস্যা।
লক্ষণসমূহ
১ ব্যক্তির মধ্যে এমন কিছু বিশ্বাস তৈরি হয় যার পক্ষে তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই, কোনো যুক্তি এই বিশ্বাসকে সমর্থন করে না এবং এই বিশ্বাস ব্যক্তির সমাজ বা শিক্ষাগত স্তরের বিশ্বাসগুলোর সঙ্গে কোনোভাবেই মেলে না। যেমন- কেউ যদি বিশ্বস করেন যে, তার কোনো বিশেষ ক্ষমতা আছে যা অন্যদের নেই এবং এই বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে তিনি অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারেন।
২ ব্যক্তি এমন কিছু দেখে অথবা শোনে অথবা স্পর্শ পায় যা একেবারেই বাস্তবে হচ্ছে না। তার আশপাশের মানুষজন বুঝতে পারে যে বাস্তবে এমন কোনো কিছুই হচ্ছে না তবু ব্যক্তি তাদের বিশ^াস করতে পারে না।
৩ ভাষার ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। তাদের কথাগুলো বিচ্ছিন্ন হয়। তারা ক্রমাগত অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বলতে পারেন। অর্থাৎ তাদের কথা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না।
৪ তাদের আচরণের ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। ব্যক্তি অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ করা শুরু করেন। একা থাকতে পছন্দ করেন, কখন কখন একদম স্থির হয়ে থাকেন বা একদম নড়াচড়া করেন না। আবার কখনো তারা অতিরিক্ত চঞ্চল হয়ে উঠেন অথবা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন।
৫ ব্যক্তির চিন্তা ভাবনায় কিছু পরিবর্তন আসে। নিজের যত্ন নিজে নিতে পারে না। সে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতে পারে না। নিজের পেশাগত কাজ ঠিকমতো করতে পারে না।
৬ এ ছাড়া আরো কিছু সমস্যা দেখা যেতে পারে। যেমন-ব্যক্তির মধ্যে আবেগীয় অসঙ্গতি দেখা যায়। যেমন- হাসির সময় না হেসে কেঁদে ফেলতে পারেন, আবার দুঃখের খবর শুনে হেসে ফেলতে পারেন। তাদের মুখভঙ্গিতে কোনো আবেগীয় প্রকাশ থাকে না।
সিজোফ্রেনিয়ার কারণ
এই রোগের সঠিক কারণ জানা যায়নি। তবে, যে যে কারণগুলিকে এই রোগের জন্য দায়ী করা হয়, সেগুলি হল-
১.জেনেটিক বা বংশগত এই রোগ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও দেখা যায়। বাবা, মা-এর মধ্যে কারুর এই রোগ থাকলে সন্তানেরও হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
২.ভাইরাস সংক্রমণ, মানসিকভাবে অত্যন্ত চাপগ্রস্থ পরিস্থিতি, ইত্যাদির কারণে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৩.মস্তিষ্কে রাসায়নিক উপাদানের ত্রুটি এবং নিউরোকেমিক্যাল উপাদানে কোনও ঘাটতি হলে এই রোগ হয়।
৪.জন্মকালীন কোনও জটিলতা থাকলেও এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
৫.গর্ভাবস্থায় কোনও মা যদি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন এই রোগ হতে পারে।
৬.কিছু উত্তেজক মাদকদ্রব্য এবং ওষুধ এই রোগের কারণ।
সিজোফ্রেনিয়ার উপসর্গ
সিজোফ্রেনিয়া মূলত একটি গুরুতর মানসিক সমস্যা। এই রোগের ৫টি সাধারণ উপসর্গ আছে।
১. ডিলিউসন: এটি হচ্ছে এক প্রকার মিথ্যা বিশ্বাস। যার বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল নেই। যেমন- কেউ এমন বিশ্বাস করে, যে তিনি প্রধানমন্ত্রী কিংবা কোনো নায়িকা কিংবা কোনো হিরো তাকে ফলো করে। একে প্রিসিকিউটরি ডিলিউশন বলে। কিংবা সে বিশ্বাস করে তার চিন্তা অন্যজন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। একে বলে ডিলিউশন অব কন্ট্রোল।
এ ছাড়াও সে বিশ্বাস করে, তিনি দেশের একজন বিশেষ কিছু। সবাই তার ভক্ত। সে নিজকে নেতা বা তারকা হিসেবে বিশ্বাস করেন। একে বলা হয় ডিলিউশন অব গ্রান্ডিওস। সে মনে করে, কেউ এসে তাকে লন্ডন নিয়ে যাবে। তার জন্য বিমান পাঠাবে কিংবা অন্য দেশের কেউ তার প্রতিটি পদক্ষেপ ফলো করে।
২. হ্যালুসিনেশন: এক্ষেত্রে রোগীর মধ্যে অস্বাভাবিক সেন্স কিংবা উপলব্ধি তৈরি হয়। যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন- সে নিজের কানে অনেক কিছু শুনতে পাবে। অথচ বাস্তবে কেউ কথা বলছে না। আবার সে গায়েবি আওয়াজ শুনতে পাবে। সে এসব শব্দে সাড়া দিবে কিংবা অদৃশ্য বস্ত দেখবে। যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।
৩. ডিসঅরিয়েন্টেড স্পিচ: এর অসংলগ্ন কথাবার্তা। সে তার স্বাভাবিক কথাবার্তা বলার প্যাটার্ন হারিয়ে ফেলবে। কখন কাকে কি বলতে হবে তা বুঝবে না। একেক সময় একক কথা বলবে। এই ধরুন, সে ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে।
সে তার বন্ধুদের কিংবা অন্যদের বলবে আগামী মাসে সে ১০ তলা বাড়ি বানাবে। কিংবা অমুক নায়িকাকে বিয়ে করবে। এমপি ইলেকশন করবে ইত্যাদি এবং সব কথায় সে সিরিয়াসনেস দেখাবে। সিজোফ্রেনিয়া হতে হলে উপরের এই ৩টি থেকে যেকোনো একটা উপসর্গ থাকতে হবে।
৪. অসংলগ্ন আচরণ: এগ্রেসিভ বিহেভিয়ার তথা আক্রমণাত্মক আচরণ। এমন ব্যক্তিরা শুধু যে অন্যের সঙ্গেই এমন আচরণ করেন তা কিন্তু নয় নিজের সঙ্গে কিংবা পরিবেশের সঙ্গে এমনটি করে থাকেন।
যেমন- কেউ হয়তো নিজেকে আঘাত করে আর গাছপালা-পশু-পাখিকে কষ্ট দেয় কিংবা ঘরের জিনিসপত্র ভেঙে থাকেন। স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করেন না। যেমন ধরুন, রোগী খাবার খেতে বসেছেন। কিছু নিজে খাচ্ছেন, আর কিছু অন্যত্র সরিয়ে রাখছেন অন্যের জন্য (যার কোনো ভিত্তিই নেই) ইত্যাদি।
৫. নেগেটিভ আচরণ: রোগীর মধ্যে নেগেটিভ উপসর্গ তৈরি হয়। উদাহরণস্বরুপ, সে কোনো আবেগ দেখাতে পারবে না, তার মধ্যে আবেগ অনুভতি, আনন্দ প্রকাশ, এই বিষয়গুলো হারিয়ে যাবে। মনে করুন, তার কোনো আত্মীয় মারা গেলো এটা তার মাঝে প্রভাব বিস্তার করবে না এমনকি তাকে ব্যথিতও করবে না।
চিকিৎসা
গবেষণায় দেখা গেছে, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ চিকিৎসার পর সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়, ৫০ ভাগ ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে। বাকি ২৫ ভাগ কখনোই ভালো হয় না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি হচ্ছে চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শমতো চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া। কারণ নিয়মিত ওষুধ ও কতগুলো মনোবৈজ্ঞানিক কৌশল প্রয়োগ এবং উপদেশ মেনে চললে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
সিজোফ্রেনিয়ায় দুই ধরনের চিকিৎসা রয়েছে : ওষুধ প্রয়োগ ও সাইকোথেরাপি। এক্ষেত্রে ইনডিভিজুয়াল সাইকোথেরাপির মধ্যে রয়েছে হ্যালুসিনেশন নিয়ন্ত্রণ, ফ্যামিলি থেরাপি, যোগাযোগের প্রশিক্ষণ, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের কৌশল ইত্যাদি। অনেক সময় ভালো হয়ে যাওয়ার পর ওষুধ বন্ধ করে দিলে পুনরায় রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ জন্য মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি।
সিজোফ্রেনিয়া নিয়েও একজন রোগী ভালোভাবে বাঁচতে পারে, যদি ঠিকমতো চিকিৎসা করা যায়। এক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের জন্য পরিবার ও আমরা যা করতে পারি, সে ব্যাপারে কয়েকটি পরামর্শ:
১. মনে রাখবেন, এটি একটি রোগ (মেডিকেল ইলনেস)। আপনার পরিবারে তেমন কেউ থাকলে এর জন্য লজ্জিত বোধ করার কারণ নেই।
২. এ রোগের জন্য নিজেকে অপরাধী ভাববেন না। এটি কারও ভুলের ফল নয়। এটিকে মেনে নিন।
৩. আপনার রোগীর লক্ষণসমূহ কী তা জেনে নিন। রোগ পুনরায় আক্রমণের প্রাথমিক লক্ষণ হলো আগে ধরতে পারলে পুনরায় আক্রমণ ঠেকাতে পারবেন। যেমন, ঘুমের ধরনে পরিবর্তন বা সামাজিকভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া।
৪. রোগীর জন্য একটি দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করে তা মেনে চলতে সহায়তা করুন।
৫. রোগী যাতে নিয়মিত ওষুধ সেবন করে, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখুন।
৬. রোগীকে বুঝতে দিন তিনি একাই এই রোগ মোকাবিলা করছেন না, আপনারাও তাঁর সঙ্গে রয়েছেন। যোগাযোগের রাস্তা উন্মুক্ত রাখুন।
৭. প্রকাশ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা প্রকাশ করবেন না। আবার সরাসরি ও নির্দয় সমালোচনাও করবেন না।
৮. নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে প্রশংসা করুন।
৯. মনে রাখবেন, এঁদের যত্ন নেওয়া আবেগগতভাবে ও শারীরিকভাবে ক্লান্তিকর। নিজের জন্য সময় নিন।
১০. যদি বাসায় চিকিৎসা সম্ভব না হয়, আপনার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।