এলার্জি প্রতিরোধের প্রাকৃতিক উপায় - Natural way to prevent Allergy
অ্যালার্জির সমস্যা খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। কমবেশি সকলেই এই সমস্যায় ভুগে থাকেন। হাজারো ওষুধ খেলেও এই সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। কিন্তু ঘরোয়া পদ্ধতিতেও এই অ্যালার্জি প্রতিরোধ করা যায়।
এলার্জি কী?
এলার্জি শব্দটি গ্রিক শব্দ Allos এবং Ergos শব্দের সমন্বয়ে তৈরি। যার অর্থ পরিবর্তিত প্রতিক্রিয়া। ধুলাবালি, ফুলের রেণু, নির্ধারিত কিছু খাবার, ঔষধ ইত্যাদির ফলে শরীরে প্রদাহজনিত যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তাকে সাধারণভাবে আমরা এলার্জি বলে জানি।
সবার শরীরে একটি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম আছে। কোন কারনে এই ইমিউন সিস্টেমে সমস্যা হলে এলার্জির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সাধারণত আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন ক্ষতিকর বস্তুর প্রতি শরীরের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে অ্যালার্জি । আমাদের দেশে অগণিত মানুষের কাছে অসহনীয় এক রোগের নাম হচ্ছে এলার্জি।
কারো কারো ক্ষেত্রে এ সমস্যা সামান্য আবার কারো ক্ষেত্রে এটি জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। বিভিন্ন ধরনের সাধারন ব্যাপার যেমন – ঘরের ধুলাবালি, ফুলের ঘ্রাণ, গরুর মাংস, চিংড়ি, ইলিশ, গরুর দুধ ইত্যাদি কারণে গায়ে চুলকানি শুরু হলে বা চামড়ায় লাল লাল চাকা হয়ে ফুলে উঠলে ধরে নিতে হবে আপনার অ্যালার্জি আছে।
অ্যালার্জি (এলার্জি) এর উপসর্গ
বিভিন্ন ধরণের এলার্জির উপসর্গগুলি হল:
ধূলা থেকে এলার্জি
সর্দি বা বন্ধ নাক
হাঁচি
চোখ লাল হয়ে জল পড়া এবং চুলকানি
কাশি, বুকে ঘড়ঘড় আওয়াজ, দম বন্ধ বোধ হওয়া। (আরও পড়ুন - বুকে ব্যথার কারণগুলি)
অ্যালার্জিক রাইনাইটিস
সর্দি বা বন্ধ নাক।
চোখে এবং ত্বকে চুলকানি।
হাঁচি
ক্লান্তি এবং নাক বন্ধ থাকার কারণে ঘুমের ব্যাঘাত জনিত দুর্বলতা।
ত্বকের এলার্জি
ত্বকের এলার্জির সাধারণ উপসর্গগুলি হল লাল হয়ে যাওয়া, চুলকানি এবং ফুলে যাওয়া। কিছু ক্ষুদ্র পার্থক্য রয়েছে যা ত্বকের অবস্থার নির্ণয়ে সহায়তা করতে পারে।
একজিমা এবং কন্টাক্ট ডারমাটাইটিস
যাদের একজিমা আছে তাদের ত্বক প্রায়ই শুষ্ক হয়। চুলকানি হয় এবং ত্বক শক্ত হয়ে যায়। কারুর ক্ষেত্রে চুলকাতে গেলে শক্ত ত্বক ফেটে গিয়ে রস বেরোতে থাকে। এতে বোঝা যায় যে সংক্রমণ হয়েছে। বাচ্চাদের মুখে, শরীরের জোড়গুলিতে বা কানের পিছনে একজিমা হতে পারে। বড়দের ক্ষেত্রে এই গুলি ছাড়াও হাত এবং পায়ে হতে পারে। কন্টাক্ট ডারমাটাইটিসের ক্ষেত্রে এই রকমের উপসর্গ দেখা দিতে পারে যে জায়গা এলার্জেন বা ধাতুর সংস্পর্শে এসেছে।
ছুলি
ছুলি হলে ত্বক লাল হয়ে ফুলে যায়। কিছু জায়গা লাল হয়ে বিভিন্ন আয়তনে উঁচু হয়ে যায় এবং শরীরের যে কোন জায়গায় হতে পারে। এই রোগের একটি অবস্থার নাম হল এনজিয়োডিমা, যেখানে ত্বকের নিচের স্তরগুলিও প্রভাবিত হয়। চোখের চারপাশে, ঠোঁট বা গালে এটি হতে পারে। কখনও কখনও এটি যৌনাঙ্গে বা গলা বা পেটের ভিতরেও হতে পারে।
কীট-পতঙ্গ এবং পোষ্য থেকে এলার্জি
পোষ্য থেকে এলার্জির উপসর্গগুলি ধূলা থেকে এলার্জির মতন। পোষা জন্তুর সংস্পর্শে এলে এদের দেখা পাওয়া যায়। কীট-পতঙ্গ থেকে যে এলার্জিগুলি হয়, সেগুলির উপসর্গ হল:
মুখ মণ্ডল, ঠোঁট, গলা এবং জিহ্বা ফুলে যায়।
নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
যেখান কীট-পতঙ্গ কামড়ায় বা হুল ফোটায় সেখানে চুলকানি, ছুলি এবং অবশেষ ছোট ফোসকা পড়ে যার ভিতরে পুঁজের মতন বস্তু থাকে।
বমি করার ইচ্ছে, বা বমি করা।
পেটে সংকোচন হওয়া।
খাদ্যের এলার্জি
খাদ্যের এলার্জি'র উপসর্গ খাওয়ার ঠিক পরে অথবা কয়েক ঘণ্টা পরে হতে পারে। এর উপসর্গগুলি হল ত্বক লাল হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে চুলকানি, বন্ধ নাক, বমির ভাব, বমি করা, সংকোচন এবং উদরাময়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে খাদ্যের এলার্জি থেকে আর একটি গুরুতর রোগ হতে পারে, যার নাম এনাফাইল্যাক্সিস যার উপসর্গগুলি হল:
দম বন্ধ লাগা।
জিভ, গলা এবং ঠোঁট ফুলে যাওয়া।
হাত এবং পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরা।
এলার্জির কারন
ঘরের জমানো ধুলো হাঁপানি জনিত এলার্জির অন্যতম কারণ। ঘরের ধুলোবালিতে মাইটি নামক এক ধরনের জীবাণু থাকে যা শতকরা প্রায় 60% অ্যালার্জি সৃষ্টির জন্য দায়ী। তাই যারা হাঁপানিজনিত এলার্জি সমস্যায় ভোগেন তারা ঘরের ধুলো বালি থেকে সবসময় দূরে থাকবেন। অর্থাৎ ঘরের কম্বল, পর্দা, তোষক, বাড়ির আসবাবপত্র ইত্যাদিতে ধুলো জমে থাকে তা পরিষ্কার করার সময়েও দূরে থাকতে হবে।
দূষিত বাতাস, ফুলের পরাগ, ধুঁয়া, কাঁচা রংয়ের গন্ধ, চুনকাম, পুরনো ফাইলের ধুলো ইত্যাদি দেহে এলার্জিক বিক্রিয়া সৃষ্টি করে হাঁপানি রোগের সৃষ্টি করতে পারে। হাঁপানির সাথে এলার্জির সম্পর্ক আছে তাই যাদের হাঁপানি আছে তাদের এসব পরিত্যাগ করে চলতে হবে।
তাছাড়া ছত্রাক দেহে এলার্জি বা হাঁপানি সৃষ্টি করে। এটি একটি সরল উদ্ভিদ। কখনো কখনো ছত্রাক দ্বারা খাদ্য দূষিত হয়।তাছাড়া কিছু কিছু খাবার আছে (পনির,পাউরুটি, কেক ইত্যাদি) তৈরিতে ছত্রাক ব্যবহার করা হয় । আর এ ছত্রাক এলার্জি সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
মাথা ব্যথা, জ্বর, ফোঁড়া, পাঁচড়া ইত্যাদির কারণে আমরা পেনিসিলিন ও অ্যাসপিরিন ঔষধ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই খেয়ে থাকি। আর এ পেনিসিলিন ও অ্যাসপিরিন থেকেও শরীরে এলার্জিজনিত চুলকানি হতে পারে। অতিরিক্ত পেনিসিলিন ব্যবহারের কারণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন ঔষধ খাওয়া যাবে না। তাছাড়া বিভিন্ন ধরণের খাবারের মাধ্যমেও এলার্জি হয়।
এলার্জি থেকে বাঁচার ঘরোয়া উপায়
১.নিম পাতা
ভালো করে ১ কেজি নিম পাতা রোদে শুকিয়ে নিন। শুকনো নিম পাতা পাটায় পিষে গুঁড়ো করুন এবং তা ভালো করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটি কৌটায় ভরে রাখুন। এক চা চামচের ৩ ভাগের ১ ভাগ নিমপাতার গুঁড়া এবং ১ চা চামচ ইসবগুলের ভুষি ১ গ্লাস পানিতে আধা ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। আধা ঘণ্টা পর চামচ দিয়ে ভালো করে নাড়ুন।
প্রতিদিন সকালে খালি পেটে, দুপুরে ভরা পেটে এবং রাতে শোয়ার আগে খেয়ে ফেলুন। ২১ দিন একটানা খেতে হবে। কার্যকারিতা শুরু হতে ১ মাস লেগে যেতে পারে।
২.নারকেল তেল
নারকেল তেল স্কিন কেয়ারের জন্য সেরা । এটিতে ময়েশ্চারাইজিং রয়েছে যা অ্যালার্জির ক্ষেত্রে ত্বককে সুরক্ষা দেয়। শুধু তাই নয়, নারকেল তেল অ্যালার্জির কারণে চুলকানিও কমায়। একটি বাটিতে সামান্য নারকেল তেল নিন এবং ৫ সেকেন্ডের জন্য গরম করুন। তারপরে আপনি যেখানে অ্যালার্জির লক্ষণ দেখছেন সেই জায়গায় এই গরম তেলটি প্রয়োগ করুন। মনে রাখবেন, এ্যালার্জির জায়গায় রেখে দিন, ম্যাসাজ করবেন না। এক ঘন্টা রেখে দিন। ৩-৪ ঘন্টা পর পর নারকেল তেল ব্যবহার করতে পারেন। এটি ত্বকের অ্যালার্জি উপশম করবে।
৩.মধু
যদিও এটি প্রমাণ করার মতো কোনও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নেই যে মধুতে এলার্জি নিরাময় হয়। কিন্তু বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এলার্জি দূর করতে মধু পান করেন।
অ্যালোভেরার ওষধি গুণাগুণ সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। অ্যালোভেরা বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়। কিছু লোক এটি রস হিসাবে ব্যবহার করে। এটি ত্বকের অ্যালার্জি থেকে মুক্তি পাওয়ার সেরা উপায়। অ্যালার্জির কারণে যদি আপনার ত্বকের চুলকানি এবং শুকনো সমস্যা হয় তবে অ্যালোভেরার ওষধি গুণগুলির জন্য দ্রুত জ্বালা এবং চুলকানি থেকে মুক্তি দেয়। চুলকানি থেকে মুক্তি পেতে প্রথমে কিছুটা তাজা অ্যালোভেরা নিয়ে ত্বকে লাগান। আপনার যদি অ্যালোভেরা না থাকে তবে আপনি অ্যালোভেরা জেলটি ব্যবহার করতে পারেন। অ্যালোভেরা জেলটি ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের জন্য রেখে দিন, চুলকানি এবং জ্বলন্ত সমস্যা কিছু দিনের মধ্যে মুক্তি পাবে।
ডায়েটরি স্পিরুলিনা - য এক ধরনের নীল-সবুজ শেত্তলা।এলার্জিক রাইনাইটিস এর বিরুদ্ধে এটি অত্যন্ত কার্যকরী।
৬.অ্যাপল সিডার ভিনেগার
১ গ্লাস পানিতে অ্যাপল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে প্রতিদিন পান করুন । নিয়মিত এভাবে খেলে এটি আপনাকে অ্যালার্জির সমস্যা থেকে মুক্তি দিবে ।
৭.টি-ট্রি অয়েল
টি-ট্রি অয়েল এলার্জি থেকে মুক্তি পাওয়ার দুর্দান্ত উপায়। টি-ট্রি অয়েলও ত্বকের অ্যালার্জিতে খুব সহায়ক। এটিতে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টিআইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা অনেক ত্বকের অ্যালার্জি থেকে মুক্তি দেয়। । ত্বকের লালচেভাব এবং চুলকানি থেকে মুক্তি পেতে টি-ট্রি অয়েল একটি দুর্দান্ত বিকল্প।
৮.বেকিং সোডা
ত্বকের অ্যালার্জি থেকে মুক্তি পেতে বেকিং সোডাও ব্যবহার করতে পারেন। বেকিং সোডা রান্নাঘরের এমন একটি জিনিস যা ত্বকের অনেক সমস্যা দূর করে। আপনি যদি ত্বকের অ্যালার্জিজনিত সমস্যায় ভুগতে থাকেন তবে আপনি বেকিং সোডাও ব্যবহার করতে পারেন। তবে এটি ব্যবহার করার সময় কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। এটি ত্বকে পিএইচ ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
কীভাবে ব্যবহার করবেন- ত্বকে বেকিং সোডা ব্যবহার করতে প্রথমে এক চামচ বেকিং সোডা নিন এবং এতে সামান্য জল যোগ করুন। এখন একটি মসৃণ পেস্ট তৈরি করুন এবং এটি অ্যালার্জির জায়গায় লাগান। এটি ১০ মিনিটের পরে ধুয়ে ফেলুন। অ্যালার্জি থেকে মুক্তি পেতে আপনি এটি দিনে ৩-৪ বার ব্যবহার করতে পারেন।
৯.লেবু
লেবু হল অন্যতম সাইট্রিক জাতীয় ফল যা অ্যালার্জিতে দারুণ কাজ করে। মধুর সঙ্গে লেবুর রস মেশালে শরীরের জন্য দারুণ উপকারী। নিয়মিত এই পানীয় খেলে শরীরের টক্সিন বেরিয়ে যাবে। এবং অ্যালার্জির সমস্যাও কমে আসবে।
১০.আদা
আদা অ্যালার্জির জন্য খুব ভাল কাজ করে। আদাতে বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরানো, হজমের সমস্যা, এমনকী ডায়ারিয়ার মতো সমস্যাতেও ভীষণ কার্যকরী। গরম জলের মধ্যে আদা ফুটিয়ে তাতে মধু মিশিয়ে খেয়ে নিন।