
মুখের স্বাস্থ্য রক্ষায় করণীয় - What to do to protect oral health
আমাদের শরীরের অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো দাঁত। আমাদের পরিপাকতন্ত্রের প্রথম কার্যক্রম শুরু হয় দাঁত দিয়ে খাদ্যদ্রব্য চিবানোর মাধ্যমে। সুন্দর হাসি, সঠিক উচ্চারণে কথা বলা ও খাদ্যদ্রব্য চিবিয়ে খাওয়া ছাড়াও শরীরের অন্যান্য রোগব্যাধি প্রতিরোধ বা প্রতিকারের জন্য দাঁতের গুরুত্ব অপরিসীম।
মানুষের রোগব্যাধির মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে দাঁতের রোগ। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, মাড়ির দীর্ঘদিনের প্রদাহ থেকে জীবাণু সহজেই রক্তনালিতে ঢুকে পড়ে, ফলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের মতো মারাত্মক পরিণতিও ডেকে আনতে পারে। এ ছাড়া ভুলে যাওয়া রোগ, অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট, দীর্ঘমেয়াদি মাথাব্যথা, অপরিপক্ব বা কম ওজনের সন্তান প্রসব, সময়ের আগেই সন্তান প্রসব ইত্যাদির জন্যও মুখ ও দাঁতের রোগ দায়ী। অথচ একটু সচেতন হলেই অধিকাংশ দাঁতের রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
মুখের স্বাস্থ্য রক্ষায়ও মৌসুমি ফল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে চাই কিছু সতর্কতা। যেমন—
আমের মধ্যে আছে প্রাকৃতিক চিনি। দাঁতে লেগে থাকলে এই সুগার ক্যারিজ বা দাঁত ক্ষয়ের কারণ হতে পারে। কিছুটা অ্যাসিডিক হওয়ায় আম খাওয়ার পর ভালোভাবে কুলি করা নিরাপদ। ব্রাশ করতে চাইলে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করা জরুরি। কারণ, অ্যাসিডিক পরিবেশে প্রতিরক্ষা আবরণ তুলনামূলক নরম থাকায় ব্রাশের ঘর্ষণে দাঁত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যেকোনো অ্যাসিডিক ও মিষ্টিজাতীয় খাবার যত কম সময় দাঁতের সংস্পর্শে রাখা যায়, ততটাই ভালো। ভিটামিন সির উৎস হিসেবে কাঁচা আম উৎকৃষ্ট।
কাঁঠালের ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম মুখের সার্বিক স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা, প্রদাহ দমনে সহায়ক ও জীবাণুনাশক উপাদান থাকাতে কাঁঠাল উপকারী ফল। তবে অবশ্যই পরিমিত খেতে হবে।
দাঁত, হাড় ও হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় লিচুতে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাগনেশিয়াম আছে। হাড়ের ক্ষয়রোধেও লিচুতে কিছু মিনারেল বিদ্যমান।
দাঁত ও মাড়ি সুস্থ রাখা আর মুখের কমন ক্ষত বা আলসার প্রতিরোধে জাম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। ডায়াবেটিস রোধেও এর ভূমিকা রয়েছে। এ ফল চোয়ালের হাড় ও হাড়ের সন্ধিকে ভালো রাখে।
তালের শাঁস
এতে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে, যা আমাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়, মাড়িকে সুস্থ রাখে। তালের শাঁসে রয়েছে ক্যালসিয়াম, যা দাঁতের ক্ষয় রোধ করে।
পনির
ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ডা. বার্গ বলেন, “পনির মুখের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এতে কার্বোহাইড্রেইট-এর মাত্রা কম থাকায় তা মুখের ব্যাক্টেরিয়া বায়োফিল্মকে কার্বোহাইড্রেইট থেকে শর্করা এবং শর্করা থেকে এসিডে পরিণত হওয়াতে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে দাঁতের ক্ষয় রোধ হয়।”
মুখের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিলে, অম্লের মাত্রা খুব বেশি হয়ে গেলে ক্যাভিটি দেখা দেয়। ফলে দাঁতের ক্ষয় হতে থাকে। পনিরে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে যা হাঁড় ও দাঁতের সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মুখের স্বাস্থ্য রক্ষা কেন জরুরি
জাপানের মানুষের মধ্যে একটা প্রবাদ আছে, সার্বিক সুস্থতার জন্য আশি বছর বয়সে কমপক্ষে ৮টি সুস্থ দাঁত সংরক্ষণ করতে হবে, আমাদেরও মুখের স্বাস্থ্য রক্ষার গুরুত্ব বুঝতে হবে, সচেষ্ট হতে হবে স্বাস্থ্য রক্ষায়। সুস্থ ও সুন্দর দাঁত হোক আমাদের গর্ব।
মুখ আমাদের শরীরের প্রধান প্রবেশদ্বার, বাড়ির প্রবেশ দ্বার অরক্ষিত থাকলে যেমন বাড়িটি নিরাপত্তাহীন, তেমনি মুখের স্বাস্থ্য ভালো না রাখলে মুখসহ সমগ্র শরীর ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ মুখের রোগ শুধু মুখের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, রক্ত সঞ্চালনের সঙ্গে মিশে ছড়িয়ে যেতে পারে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে। আবার শারীরিক অনেক রোগের প্রাথমিক লক্ষণ মুখের মধ্যে প্রকাশ পায়।
সুস্থ দাঁতের অভাবে অপুষ্টি, খাবারে স্বাদ না পাওয়া, পর্যাপ্ত চর্বণ না হওয়া, চোয়ালের অস্থি ও অস্থি সন্ধিতে সমস্যা, মানসিক শক্তি ও প্রাণচাঞ্চলতা কমে যাওয়া, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বহানি, স্পষ্ট উচ্চারণে বাধাসহ নানা সমস্যা দেখা যায়। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি মুখের রোগ থেকে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসে রোগ, ক্যান্সার, অপরিণত গর্ভপাত, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য রোগের জটিলতা বেড়ে যাওয়াসহ নানা জটিলতার যোগসূত্র পাওয়া যায়। বর্তমানে কোভিডের জটিলতার সঙ্গেও মুখের স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টি উঠে আসছে, মুখের সঠিক পরিচর্যায় শরীরে করোনাভাইরাস প্রবেশের অন্যতম বড় পথ, মুখগহ্বর অনেকটা নিরাপদে থাকে।
মুখ ও দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষায় করণীয়
নাস্তার পরে দাঁত ব্রাশ
আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করি। এটা প্রাচীন কালের অভ্যাস। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, আমরা সকালের নাস্তার পরে যেন দাঁত ব্রাশ করি। কারণ, সকালের নাস্তায় মুখের খাবার লেগে থাকে। দাঁত ব্রাশ না করলে সেটা নিয়ে আমরা অফিসে বা কর্মক্ষেত্রে চলে যাই, ছেলে মেয়েরা স্কুলে চলে যায়। ফলে সারাদিন মুখে খাবার লেগে থাকে ও ব্যাকটেরিয়া উৎপাদিত হয়। এর ফলে মুখে প্রদাহ হয়, দাঁতে ক্যাবিজ হয়।
রাতে ঘুমানোর আগে দাঁত ব্রাশ
আরেকটি কথা বিজ্ঞান খুব জোর দিয়ে বলছে। সেটি হল রাতে খাবারের পর ও ঘুমানোর আগে যেন অবশ্যই দাঁত ব্রাশ করি। ব্রাশ করে বিছানায় যাওয়ার পরে আমরা আর কিছুই খাবনা। ছেলে মেয়েদেরকেও এ ব্যাপারে সচেতন করব। এ নিয়ম মানলে অন্তত ৩০ ভাগ দাঁতে যে ক্যারিজ হয় তা আমরা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হব।
ধূমপান, জর্দা ও তামাক পাতা বর্জন
না বললেই নয়, মুখের রোগের সঙ্গে জর্দা, সাদা পাতা, ধূমপান এসবের সম্পর্ক রয়েছে। বিজ্ঞান বলছে, ধূমপায়ী, তামাক পাতা ও জর্দা যারা খেয়ে থাকেন তাদের মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। সুতরাং এখন থেকে যদি আমরা তামাক পাতা ও জর্দা খাওয়া বন্ধ করি, ধূমপান বন্ধ করি তাহলে ক্যান্সারের যে ঝুঁকি তা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি।
নিয়মিত সালাদ খাওয়া
আরেকটি কথা বলে আমি শেষ করব সেটা হলো আমাদের মুখের স্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিন কিছু পুষ্টিকর খাদ্য প্রয়োজন। আমরা ছেলেমেয়েদের শুধু ফার্স্টফুড খাওয়ানোর অভ্যাস করি। সেটা না করে আমরা তাজা ফল মূল ও শাক-সব্জি খাওয়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি। তাহলে তাদের দাঁত ও মাড়ি সুস্থ থাকবে। যেমন ধরুন, প্রতিদিন একবাটি সালাদ আমরা দিতে পারি। এই সালাদে থাকবে শসা, গাজর, টমেটো, লেটুস পাতা। একটি লেবু চিপে তার পুরো রসটি সালাদের উপর দেওয়া যেতে পারে। তাহলে মুখে ও মাড়ীতে যে রোগগুলো হয়, মাড়ীর রক্তক্ষরণ হয় তা থেকে রক্ষা পাব। ভিটামিন সি ও ডি- এর অভাবে দাঁতে কেরিজ হয় সেগুলো আমরা প্রতিরোধ করতে পারি। তাই প্রতিদিন কিছু তাজা ফল পেয়ারা, আমলকি, জাম্বুরা, কমলালেবু- এই ধরনের ফল যদি খাই তাহলে আমাদের শরীরে ভিটামিন সি- র অভাব দূর হবে এবং দাঁত ও মাড়ী সুস্থ থাকবে।
টক ফল খাওয়া
ভিটামিন সি জাতীয় খাবার দাঁত ও মাড়ির জন্য অত্যন্ত উপকারী। লেবু, আমলকী, কমলা, টমেটো ও বিভিন্ন ধরনের শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ও অন্যান্য ভিটামিন থাকে। তাই দাঁত ও মাড়ির সুরক্ষায় খাদ্যতালিকায় রাখুন এসব খাবার।
আঁশযুক্ত ও শক্ত খাবার খাওয়া
গাজর, পেয়ারা, আমড়া, ইক্ষু, আনারস, নাশপাতি, আপেল, নারকেল ইত্যাদি দাঁত ও মাড়ি সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। চোয়ালের স্বাভাবিক গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
দাঁত ব্যথা হলে তা তুলে ফেলার খরচ সামান্য হলেও এর ফলে শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে যে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা দেখা দিতে পারে তার চিকিৎসা খরচ অনেক বেশি। মনে রাখবেন, একটি অসুস্থ দাঁতকে উন্নত টেকনোলজির মাধ্যমে সুস্থ করতে যে খরচ হয়, তা পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দুর্ভোগ ও চিকিৎসার বিপুল খরচের বহুগুণ কম। এজন্য আমাদের আগে থেকে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন এবং কোনো কারণে দাঁত তুলতে হলে যত দ্রুত সম্ভব তা প্রতিস্থাপন করে নেওয়া প্রয়োজন।