ইখওয়ানুল মুসলিমীন এর পরিচিতি - Introduction to ikhwanul muslimin
ikhwanul muslimin

ইখওয়ানুল মুসলিমীন এর পরিচিতি - Introduction to Ikhwanul Muslimeen

অষ্টাদশ শতাব্দীর সূচনা হইতে বর্তমানকাল পর্যন্ত ইসলামের পূনর্জাগরণ এবং রাজনৈতিক সচেতনতার ক্ষেত্রে আরব জগতে আল ইখওয়ানুল মুসলিমীন -এর অবদান সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য। হাসানুল বান্না (রহঃ) ছিলেন উহার প্রতিষ্ঠাতা। ১৯০৬ খৃ. মিসরের একটি ছােট্ট শহর মাহমূদিয়্যা-তে তাঁহার জন্ম। তাঁহার বাল্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইসলামী পরিবেশে হয়। কায়রাের এক শিক্ষা কেন্দ্র দারুল-উলুম হইতে তিনি ১৯২৭ খৃ. সমাপনী সনদ লাভ করেন। ইসলামী শিক্ষা তাসাওউফ এবং জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণা তাহার চরিত্র ও কর্মের উপর প্রভাব বিস্তার করে। শিক্ষালাভের পর ১৯২৭ খৃ. তিনি ইসমাঈলিয়ার এক সরকারী বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যােগদান করেন। ইসমাঈলিয়্যা ছিল ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্র। হাসান বান্না পাশ্চাত্য শক্তিসমূহের রাজনৈতিক এবং আর্থিক প্রতিপত্তি অর্জন এবং তাহাদের অত্যাচার ও নিপীড়ন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা এইখান হইতেই লাভ করেন।


আন্দোলনের ইতিহাস:

মার্চ ১৯২৯ খৃ. হাসানুল বান্না ইসমাঈলিয়্যাতে জামইয়াতুল-ইওয়ান আল-মুসলিমন নামে এই আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে উহার প্রতিষ্ঠার ঘােষণা ১১ এপ্রিল, ১৯২৯ খৃ. করা হয়। ১৯৩৩ খৃ. হাসানুল বান্না কায়রােতে বদলী হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনের শাখা বিভিন্ন শহরে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল এবং ইসমাঈলিয়্যা ছিল উহার কেন্দ্র।

কায়রােতে এই আন্দোলন সংগঠন ও বিস্তৃতির ক্ষেত্রে এক নব পর্যায়ে প্রবেশ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে এই সংগঠন কেবল মিসরেই নহে, বরং অন্যান্য দেশেও বিস্তার লাভ করে। এই সময় আন্দোলন এতই শক্তিশালী হইয়া উঠে যে, ইহার পক্ষ হইতে বেশ কিছু সামাজিক সংস্কারের দাবী-দাওয়া সরকারের নিকট পেশ করা হয়।

১৯৩৬ খৃ. ফিলিস্তীন সমস্যা দেখা দিলে আল-ইখওয়ান সম্ভাব্য সকল উপায়ে আরবদের সহযােগিতা করে। এই আন্দোলন ছিল তীব্র বৃটিশ-বিরােধী এবং এই বিরােধিতা শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। আরব ও ফিলিস্তীন-এর স্বার্থের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের কারণে ইখওয়ানুল মুসলিমীন আরব বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করে।


তৎকালীন মিশরের সামাজিক অবস্থা:

দেশপ্রেমের আড়ালে তখন মিশরের সমাজে প্রচারিত হচ্ছিল নাস্তিকতা, অশ্লীল চিন্তা ও পাশ্চাত্যপূজার বাণী। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে নির্বিঘ্নে ইসলাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রূপ চলছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠে যে সামাজিক বৈঠকগুলোতে ইসলামের নাম উচ্চারণ করা মানেই অপমানের শামিল হওয়া। নাস্তিকতার যে জোয়ার শুরু হয় তাতে প্রচুর যুবক এর প্রতি আকৃষ্ট ও অনুগত হচ্ছিল। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আড়ালে এমন ধরনের সংবাদপত্র ও বইয়ের আগমন ঘটতে থাকে যার প্রকৃত উদ্দেশ্যই ছিল মানুষের মন থেকে দীনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসাকে নির্মূল করা। পার্ক ও উদ্যানগুলোতে নিষ্ঠাবান মুসলমানরা নামায পড়তেও লজ্জা বোধ করত। এছাড়াও মুসলিমরা নানাভাবে বিভক্ত ছিল। পাশাপাশি সমাজে জাতীয় ও গোত্রীয় সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।


রাজনৈতিক অবস্থা:

১৯১৮ সাল অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মিশরে ব্যাপক রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। খেলাফত বহনকারী তুর্কিদের মধ্যে যখন জাতীয়তাবাদ দেখা দেয় তখন তা মিশরেও ছড়িয়ে পড়ে। মিশর স্বীয় ইতিহাস, রাজনৈতিক মর্যাদা ও আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আরব বিশ্বের নেতৃত্ব লাভ করেছিল। যে কারনে সেখান থেকে আরবদের মধ্যেও জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা প্রসারিত হয়। এরপর পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে থাকে। মিশরের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বিষয় থেকে ধর্মকে আলাদা করা শুরু হয়। চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে আক্রমণ শুরু হয় ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি।


আলোকবর্তিকা হাতে হাসান আল বান্নার আবির্ভাব:

মিশরের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা যখন সম্পূর্ণ ইসলামের বিপরীত ঠিক তখনই আসা জাগানিয়া আলোর মশাল হাতে নিয়ে হাজির হন হাসান আল বান্না। এ হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় এ যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিন।


ইখওয়ানুল মুসলিমিন নামকরণ ও প্রতিষ্ঠা:

১৯২৮ সালে মার্চ মাসে সম্ভ্রান্ত ও ইসলামের প্রতি অনুরাগী ৬ জন ব্যক্তি হাসান আল বান্নার বাড়িতে উপস্থিত হন। মূল উদ্দেশ্য মিশরের সমাজকে কিভাবে জাহেলিয়াত থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসা যায় সে সম্পর্কে আলোচনা করা। দীর্ঘ আলোচনা ও পারস্পরিক মত বিনিময়ের পর তারা হাসান আল বান্নার নেতৃত্বে একটি সংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। মুসলিমদের রক্ষায় দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে এ দলটি। সেই বৈঠকেই এ সংগঠনটির নাম ইখওয়ানুল মুসলিমিন রাখা হয়। যার অর্থ মুসলমান ভাই। এরপর থেকে এ সংগঠনটি ইখওয়ানুল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড নামে পুরো বিশ্বে পরিচিতি পায়।


ইখওয়ানুল মুসলিমিনের মূলনীতি:

ইখওয়ানুল মুসলিমিনের মূলনীতি সম্পর্কে ইমাম হাসান আল বান্না বলেন “ইখওয়ানের কাছে ইসলাম কেবল আকিদা-বিশ্বাসের নাম নয় অথবা কেবল আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগিও নয়। ইখওয়ানের কাছে ইসলাম কেবল চারিত্রিক সৌন্দর্যেরও নাম নয় কিংবা শুধু তরিকত ও পীর-মুরিদিও নয়। বরং ইখওয়ানের কাছে ইসলাম এর চেয়েও ব্যাপক এবং আরও বিস্তৃত বিষয়।”


ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রাথমিক যাত্রা:

ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয় মিশরের ইসমাঈলিয়া থেকে। মসজিদ ছিল সংগঠনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু। যার মূল উদ্দেশ্য সমাজে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া। দরস, প্রশিক্ষণ, আলোচনা ও বক্তৃতা ছিল দাওয়াত প্রচারের মাধ্যম। দাওয়াতের মূল বিষয়বস্তু ছিল তাওহীদ ও আখিরাত। ইসমাঈলিয়ায় তারা সতর্কতার সাথে অত্যন্ত গোপনে সংগঠনটির কার্যকলাপ চালাতে থাকে। মাঝে মাঝে তারা ইসমাঈলিয়া ছেড়ে আশেপাশের এলাকাতেও দাওয়াতি কাজ করতেন। এইভাবেই কেটে যায় সংগঠনটির ৫ বছর। এ ৫ বছরে তারা সুয়েজ, আবু সবীর, পোর্ট সায়ীদ ও বিলাহু এলাকায় মোট ১০ টি শাখা স্থাপন করে।


রাজধানী কায়রোতে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের কার্যক্রম:

১৯৩৩ সালে হাসান আল বান্না কায়রোতে স্থানান্তরিত হন। যার ফলে দাওয়াতি কার্যক্রম এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। প্রাথমিকভাবে কায়রোতে তিনি আগের মতোই নীরব ও প্রচ্ছন্নতার সাথে দাওয়াতি কাজ চালাতে থাকেন। এর এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৩৪ সালে মিশরের পঞ্চাশের অধিক শহর ও গ্রামে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা হতে থাকে। আউফু থেকে ইস্কান্দারিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের কার্যক্রম ।


প্রতিটি শাখায় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চলতে থাকে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল মসজিদ নির্মাণ, ক্লাব গঠন, শিশুদের স্কুল, হিফয ও নাযেরার জন্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এছাড়াও বালকদের প্রশিক্ষণের জন্য হেরা নামে ও বালিকাদের জন্যে ‍উম্মাতুল মুমিনীন নামে বিদ্যালয় খোলা হয়। মাহমুদিয়ায় বস্ত্র ও কার্পেট তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়।


সরকারের কাছে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সংস্কারের দাবি জানিয়ে চিঠি প্রদান:

মাহমুদ পাশা থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্ন পর্যন্ত প্রত্যেক মন্ত্রীকে ইখওয়ানুল মুসলিমিন থেকে চিঠি প্রেরণ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মাদ মাহমুদ পাশার কাছে এক পত্রে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের দাবি জানানো হয়। এছাড়াও চিঠিতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কারের পাশাপাশি ইসলামী শরীয়ত চালু করারও দাবী জানানো হয়।

১৯৩৬ সালে ইখওয়ানুল মুসলিমিন থেকে মিসরের প্রেসিডেন্ট ফারুক, প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা নাহাস পাশা ও মুসলিম দেশগুলোর নেতৃবৃন্দের কাছে একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়। এ চিঠিতে ইসলামী জীবন দর্শন ও পাশ্চাত্য জীবন দর্শনের তুলনামূলক পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। এছাড়াও চিঠিতে ৫০টি বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব পেশ করা হয়। যার মধ্যে ১০ টি রাষ্ট্রীয় নীতি, ৩০ টি সামাজিক ও শিক্ষা বিষয়ক এবং ১০ টি অর্থনৈতিক বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট।

এর দুই বছর পর ১৯৩৮ সালে মিশরের আইনমন্ত্রী আহমদ খাসাবা পাশাকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, “৫০ বছর ধরে ইসলাম বহির্ভূত আইন পরীক্ষা করা হয়েছে যা চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এবার ইসলামী শরীয়তের পরীক্ষা করা হোক।”

একই বছর, মুস্তফা নাহাস পাশাকে হাসান আল বান্না আবার চিঠি প্রেরণ করেন। যখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচিত হয়েছেন। এবার তিনি চিঠিতে মিসরের বৈদেশিক নীতিতে ইসলামী দেশগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হওয়া উচিত বলে জানান

এর পরের বছর ১৯৩৯ সালে নাহাস পাশাকে আরো একটি পত্র লেখেন হাসান আল বান্না। যেখানে তিনি তার নেতৃত্বাধীন ওয়াফদ পার্টির উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম ইসলামের মূলনীতির আলোকে গঠন করা উচিত বলে জানান।

শুধুমাত্র পত্র লেখাতেই থেমে থাকেনি হাসান আল বান্না। ১৯৬৩ সালে তিনি নাহাস পাশার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। শাসক গোষ্ঠীকে নসিহত ও বোঝানোর যত সর্বোত্তম পন্থা আছে তার সবই অবলম্বন করেন তিনি।


জনগণের কাছে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রভাব:

রাজধানী কায়রোসহ মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলে ধীরে ধীরে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রভাব বাড়তে থাকে। ইখওয়ানের চেষ্টা, সংগ্রাম ও গঠনমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা প্রভাবিত হয়ে এর বৈঠকসমুহে যোগদান করতে থাকেন। এছাড়াও ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, প্রকৌশলী, ডাক্তার, শিক্ষক, উকিল, মোটকথা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এতে যোগদান করে। যার ফলে একদিকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পায় অন্যদিকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি সাধিত হয়। সমাজ ও জনগণের মাঝে প্রভাব বিস্তার করার সাথে সাথে যখন শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি করা হয় তখন শাসকগোষ্ঠীর বদ নজর পড়ে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের দিকে।


ইখওয়ানুল মুসলিমিনের নীতি ঘোষণা ও ইংরেজদের মনে ভীতি সঞ্চার:

ইখওয়ানুল মুসলিমিনের নীতি ও নৈতিকতা ইংরেজদের মনে ভীতি সঞ্চার করে। হাসান আল বান্না ইখওয়ানুল মুসলিমিনের বিভিন্ন নীতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন । এসব নীতির মধ্যে তিনি জাতীয়তাবাদকে দূরে সরিয়ে সমস্ত মুসলমানদেরকে এক জাতি বলে উল্লেখ করেন। এছাড়াও তিনি ইসলামী খেলাফতকে মুসলিম জাতির ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেন। ইউরোপীয় দখলদার রাষ্ট্রগুলিকে বল প্রয়োগে প্রতিহত করার কথা বলেন। যার ভিত্তিতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, আলজেরিয়ার স্বাধীনতাসহ আধিপত্যবাদের জঘন্য থাবা যেসব মুসলিম দেশের উপর পড়েছে তাদের বিরুদ্ধে মুসলমান জাতিকে জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের ধারণা ছিল ইখওয়ানুল মুসলিমিনের এ নীতি ও আন্দোলন সমগ্র আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে ও ইংরেজদের স্বাধিকার বিঘ্নিত হবে।


ইখওয়ানুল মুসলিমিনের নেতাকর্মীদের উপর জুলুম ও নির্যাতন:

ইখওয়ানুল মুসলিমিনের দৃষ্টিভঙ্গি ইংরেজদের জন্য অসহনীয় ছিল। যার ফলে ক্ষমতাসীন হুসাইন সিররী পাশার ওপর ইংরেজ দূতাবাস ও ইংরেজ সেনাপ্রধানের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে সর্ব প্রথম ইখওয়ানের পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর সদস্য ও নেতাকর্মীদের গ্রেফতার শুরু হয়। গ্রেফতার হন স্বয়ং হাসান আল বান্না ও ইখওয়ানের সেক্রেটারি। যদিও প্রচণ্ড চাপের মুখে তাদের মুক্তি দেয় সরকার। কিন্তু এই নির্যাতন ও দমন-পীড়ন সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে আন্দোলনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে ও এর পৃষ্ঠপোষকের সংখ্যা অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৩৮ সালে আন্দোলনের সময় সদস্য ছিল ২ লাখ কিন্তু ১৯৪৮ সালে তা অর্ধ মিলিয়নে পরিণত হয়।


ইখওয়ানের রাজনীতিতে আগমন:

১৯৪১ সালে হাসান আল বান্না ইসমাঈলিয়া থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু মিশর সরকার ইংরেজদের সন্তুষ্টি ও দাসতুর পার্টির প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য ধোঁকা, প্রতারণা, চাপ প্রয়োগ ও সন্ত্রাসমূলক কৌশল বেছে নেয়ার পরেও হাসান আল বান্না বিজয় লাভ করেন। কিন্তু মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে নির্বাচন বাতিল করা হয়। পুনরায় নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এবার সেনাবাহিনীর সহায়তায় হাসান আল বান্নাকে কৌশল ও ধূর্ততার সাথে পরাজিত করা হয়। একই আচরণ করা হয় ইখওয়ানের অন্য প্রার্থীদের সাথেও তাই উক্ত নির্বাচনে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের কোন প্রার্থীকেই বিজয়ের মুখ দেখতে হয়নি।


বিভিন্ন দেশে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের ছড়িয়ে পড়া:

রাজনীতিতে প্রবেশের পর ইখওয়ানুল মুসলিমিন মিশর ছাড়িয়ে অন্যান্য মুসলিম দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। সিরিয়ায় ১৯৩৭ সালে মোস্তফা সাবায়ীর নেতৃত্বে ইখওয়ানের শাখা প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৪৬ সালে ফিলিস্তিন, জর্ডান ও সুদানে শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে ইরাকেও এ দাওয়াতী কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও

লেবাননসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশে শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি পাশ্চাত্য দেশগুলোর কনফারেন্স ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও ইখওয়ানের প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করে।


১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইখওয়ান সদস্যদের অংশগ্রহণ:

১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইহুদীদের বিরুদ্ধে আরব সেনাবাহিনী যুদ্ধে অবতরণ করে। এ যুদ্ধে ইখওয়ানের সদস্যরাও অংশগ্রহণ করে। যার ফলে আমেরিকা ও ব্রিটেনের ইহুদী পত্রিকাগুলো এ নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে।


ইখওয়ানুল মুসলিমিনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও নাকরাশী পাশার মৃত্যু:

১৯৪৮ সালের ৮ ডিসেম্বর সামরিক অর্ডিন্যান্সের ৬৩ ধারা মোতাবেক ইখওয়ানকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। মিশর জুড়ে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়। সংগঠনের কেন্দ্র ও অফিসগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। হাজার হাজার যুবককে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তাদের উপর বয়ে যায় নির্যাতনের স্ট্রিম রোলার। নির্যাতনের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেলে নাকরাশী পাশা এক যুবকের হাতে নিহত হন।


ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতার শাহাদাত বরণ:

১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত সময়ে শুব্বানুল মুসলিমীনের অফিসে পৌঁছান ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্না। অফিস শেষে তিনি ট্যাক্সি ডাকেন। ট্যাক্সিতে উঠার সময় লম্বা ও হালকা পাতলা গড়নের এক যুবক তাকে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে পৌঁছানোর পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যু শয্যায় শায়িত অবস্থায় হাসান আল বান্নার মুখে অবিরাম কালিমা শাহাদত উচ্চারিত হচ্ছিল। শাহাদাত বরণ করে দ্বীনের মশালবাহী ও ঈমানের পথে আহ্বানকারী এক অসাধারণ ব্যক্তির। তার জানাজার নামায পড়ান তার পিতা আব্দুর রহমান আহমদ বান্না।


মুহাম্মাদ মুরসির ক্ষমতা গ্রহণ:

২০১২ সালের ৩০ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫১.৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে মিশরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইসলামপন্থী নেতা মোহাম্মাদ মুরসি। সাংবিধানিক আদালতে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে মিশরের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। হাসান আল বান্নার নেতৃত্বে ১৯২৮ সালে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের যাত্রা শুরু হলেও ২০১২ সালে সংগঠনটির কোনো নেতা দেশটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।


মুহাম্মাদ মুরসির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র:

ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন ড. মুহাম্মদ মুরসি। সেটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ মুরসির বিরোধী ও মিসরের প্রগতিশীলেরা ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদির সহায়তায় বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ডেমোক্র্যাটপন্থী মিডিয়া মুরসির বিরুদ্ধে কঠিন অপপ্রচার শুরু করে এবং তাদের অনুসারীদের মুরসির বিরুদ্ধে মাঠে নামিয়ে দেয়।


মুহাম্মাদ মুরসির বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান ও গ্রেফতার:

ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের পরপরই প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবদুল ফাত্তাহ সিসি মুরসির বিরুদ্ধে চলে যান। ২০১৩ সালে মুরসির বিরুদ্ধে তাহরির স্কয়ারে জড়ো হয় আন্দোলনকারীরা। আর এই সুযোগে মুরসিকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জনগণের দাবি দাওয়া মেনে নিতে বলে সেনাবাহিনী। যার ফলে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন মুহাম্মাদ মুরসি। ক্ষমতায় বসেন মিশরের সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। তারই নির্দেশে গ্রেফতার করা হয় মুহাম্মাদ মুরসিকে।


মুরসির গ্রেফতার পরবর্তী নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন:

মুহাম্মদ মুরসিকে গ্রেফতারের পর তাকে মুক্তি প্রদান ও পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার দাবিতে কায়রোর রাস্তায় নেমে আসেন তার দলের সমর্থকেরা। এ বিক্ষোভটি গুলি চালানোর মাধ্যমে ভেঙ্গে দেওয়া হয় ও মুসলিম ব্রাদারহুডের কয়েকজন শীর্ষ নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। ইখওয়ানুল মুসলিমিনকে দমনের নামে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে সেনাবাহিনী। মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। হাজার হাজার ব্রাদারহুড কর্মিকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে তাদের ওপর জেলখানায় চালানো হয় ব্যাপক অত্যাচার ও নির্যাতন। যার ফলে হাজার হাজার ইখওয়ান সদস্য নিহত হয়। অনেকে এ নির্যাতন থেকে বাচতে কাতার ও তুরস্কে পালিয়ে যান।


মুহাম্মাদ মুরসির বিচার ও মৃত্যু:

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা, সন্ত্রাসে মদদদান, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘনসহ ৬টি মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। কাতারের কাছে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস করার দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে থাকাকালীন অবস্থায় তার তার মৃত্যু হয়।


মুরসির মৃত্যুতে প্রতিক্রিয়া:

ড. মুরসির মৃত্যুকে ঘিরে আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি উঠে। তাকে শহীদ আখ্যা দেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান। মিশরের সামরিক শাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দেয়।


ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতি তুরস্কের অবস্থান:

মিশরের স্বৈরশাসক আল সিসি মুহাম্মাদ মুরসিকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেন। পশ্চিমা দেশগুলো মুসলিম ব্রাদারহুুডকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিলে সিসি ও একই পথে এগিয়ে যান। তবে তুরস্ক থেকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় মুসলিম ব্রাদারহুড কোন সন্ত্রাসী সংগঠন নয়, এটি একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। তাই তুরস্ক মুসলিম ব্রাদারহুড কে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়ার বিরোধী।


ইখওয়ানুল মুসলিমিন যাদের কাছে সন্ত্রাসী সংগঠন:

২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ইখওয়ানুল মুসলিমিন বাহরাইন, মিশর, রাশিয়া, সিরিয়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকার দ্বারা একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর বই - Books of Islamic Movement Bangladesh
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এর গঠনতন্ত্র - Constitution of Jamaat Islami Bangladesh
জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস - History of Jamaat-e-Islami
ফাতাহ এর পরিচিতি - Introduction to Fatah