
বাচ্চাদের পেট ব্যাথা কমানোর উপায়
শিশুদের একটা খুব পরিচিত সমস্যা হচ্ছে পেটে ব্যথা। এটা অনেক কারণেই হতে পারে। তাদের শরীর সংবেদনশীল। এজন্য তারা খুব সহজেই নানান রোগে আক্রান্ত হয়। রোগ জীবাণুর সংক্রমণ ছাড়াও খাবার, পরিবেশ ও নানান কারণে এসব রোগব্যাধি হতে পারে।
শিশুদের পেটে ব্যথা কী?
বাচ্চাদের মধ্যে কান্না খুব স্বাভাবিক কারণ এইভাবে শিশুরা তাদের অস্বস্তি প্রকাশ করে এবং তাদের প্রয়োজনীয়তার প্রতি তাদের পিতামাতার মনোযোগ আকর্ষণ করে। কিন্তু যদি আপনি দেখেন যে আপনার শিশু কোনো স্পষ্ট কারণ ছাড়াই অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁদছে তবে আপনার সেটা উপেক্ষা করা উচিত নয়, কারণ তার হয়তো কোথাও ব্যাথা থাকতে পারে।
কোলিক বা পেট ব্যাথা কোনো গুরুতর অসুস্থতা বা রোগ নয়, যার জন্য আপনাকে চিন্তিত হতে হবে। তবে আপনার বাচ্চা ছয় মাসের কম বয়সী হলে ও কাঁদতে থাকলে এবং কান্নাকাটি তিন সপ্তাহ বা তার বেশী সময় ধরে, প্রতি সপ্তাহে তিন বা ততোধিক দিন ধরে, এবং প্রতি দিন তিন বা তার বেশি ঘন্টা ধরে অবিরত কাঁদতে থাকলে, আপনার বাচ্চা হয়তো শূলবেদনাতে ভুগছে। এটি সাধারণত জন্মের দুই থেকে তিন সপ্তাহ পরে দেখা যায় এবং আপনার শিশুর তিন থেকে চার মাস বয়স হলে আর থাকে না। যদিও এই শূল ব্যাথা আপনাকে ভয় পাওয়াতে পারে, ভালো খবর হল, এটি ধীরে ধীরে নিজেই হ্রাস পাবে।
পেট ব্যাথার ধরণ ও কারন
শিশুদের পেট ব্যথা বিভিন্ন ধরণ হয়ে থাকে যেমন-
তিন মাসের অধিক পেটব্যথা
তিন মাসের অধিক পেট ব্যথা সাধারণত কোনো গুরুতর অসুস্থতা বা রোগের কারণে হয় না। তিন থেকে চার মাসের কম বয়সি শিশুরা তিন সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে কাঁদতে থাকলে এবং প্রতিদিন বা সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন সন্ধ্যার পর থেকে এবং প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা ধরে অবিরত কাঁদতে থাকলে তবে তা সাধারণত এ ধরনের পেটব্যথা হয়। এটি সাধারণত জন্মের দুই থেকে তিন সপ্তাহ পরে দেখা যায় এবং তিন থেকে চার মাস বয়স হলে আর থাকে না। পরিপাকনালিতে উপকারী ব্যাকটেরিয়া ‘গাট মাইক্রোবায়োম’ নামক ব্যাক্টেরিয়াল কলোনি গড়ে ওঠা সম্পূর্ণ হওয়ার আগে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে যা পরিপাকনালির অপরিপক্বতা নামে পরিচিত। এ ধরনের ব্যথার ক্ষেত্রে বুকে ও পিঠে হাত দিয়ে মালিশ করলে, তলপেটের দিকে চেপে ধরলে শিশুর আরামবোধ হয়।
গ্যাসজনিত ব্যথা
শিশুদের বিভিন্ন রকমের খাবার খাওয়ানো শুরু করলে গ্যাসজনিত ব্যথা বেশ প্রচলিত। এছাড়া পাকস্থলীর পরিপাকনালীতে গাট মাইক্রোবায়োম নামক ব্যাক্টেরিয়াল কলোনি গড়ে উঠা সম্পূর্ণ হবার আগে (ভয় পাবেন না, এরা উপকারী ব্যাকটেরিয়া) এ সমস্যা দেখা দিতে পারে যা গাট ইমম্যাচিউরিটি নামে পরিচিত।
এ ধরনের ব্যথার ক্ষেত্রে শিশুর বুকে ও পিঠে হাত দিয়ে মালিশ করলে, তলপেটের দিকে চেপে ধরলে আরাম বোধ হয়। তবে ব্যথা প্রকট হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ দিতে হবে।
কোষ্ঠকাঠিন্য
যেসব শিশু মাতৃদুগ্ধের পাশাপাশি সদ্য অন্য কঠিন খাবার খেতে শুরু করেছে তাদের পেটে ব্যথার অন্যতম কারণ কোষ্ঠকাঠিন্য। দুই কিংবা তিনদিন ধরে ঠিকমতো পায়খানা না হলে তা পেটের ভেতর জমে থেকে ব্যথার সৃষ্টি করে। এজন্য শিশুকে নরম খাবার দিতে হবে। অবস্থা জটিল হলে শক্ত খাবারের পরিবর্তে তরল জাতীয় খাবার যেমন- সাগুদানা, মাতৃদুগ্ধ বেশি বেশি খাওয়াতে হবে। এছাড়া কিছু ব্যায়াম করানো যেতে পারে যেমন সাইকেলের মতো শিশুর পা দুটোকে চালনা করা।
খাবার কিংবা দুধে অ্যালার্জি
শিশুর কোনও খাবারে অ্যালার্জি থাকলে তা খাওয়ানোর ফলে পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, বমি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অনেক শিশুর ক্ষেত্রে গরুর দুধ বা গুড়ো দুধের ল্যাক্টজেনের প্রতি অ্যালার্জি থেকে থাকে। অ্যালার্জি আছে বিষয়টা সন্দেহ হলে বা নিশ্চিত হলে তা খাওয়ানো বন্ধ করে দেয়া উচিত। এ ধরনের জটিলতায় অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।
ইনফেকশন
পাকস্থলীতে নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসজনিত কারণে ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। এগুলোর মধ্যে আছে রোটাভাইরাস যা পেট ব্যথার সাথে ডায়রিয়ার কারণ।
এছাড়া স্ট্রেস্পটোকক্কাসনামক ব্যাকটেরিয়া, অ্যাডেনোভাইরাস, বটুলিজম এসবের মাধ্যমেও শিশু পেটব্যথা এবং পেটের সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। ইনফেকশনজনিত সমস্যায় বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসায় এসব ইনফেকশন পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়।
কৃমি
কৃমি হলে বমি বমি ভাব, পেটব্যথা, পেট মোটা বা ভারি হওয়া, খাবারে অরুচি, মুখে থুথু ওঠা এবং কোনো কোনো কৃমিতে পায়ুপথের আশপাশে চুলকানি হতে পারে। কৃমি হলে সাধারণত অপুষ্টি ও রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। নোংরা পরিবেশ, অনিরাপদ পানি পান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, খালি পায়ে হাঁটা কৃমি সংক্রমণের জন্য দায়ী। ওষুধ নিয়ম মেনে খেলে আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সহজেই কৃমি দূর করা যায়। প্রতি তিন মাস পরপর পরিবারের সবাই একটি করে অ্যালবেনডাজল বড়ি সেবন করলে অথবা মেবেনডাজল পরপর তিন দিন খেতে হয়। সাত দিন পর দ্বিতীয় ডোজ খেতে হয়। শিশুদেরও একইভাবে সিরাপ খাওয়াতে হবে। তবে, দুই বছরের নিচে কোনো শিশুকে খাওয়াতে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ভ্রমণজনিত অসুস্থতা
অনেক শিশুর মাঝেই ভ্রমণের ফলে খাওয়ায় অরুচি, বমিভাব, পেটব্যথা এসব লক্ষণ দেখা দেয়। এ ধরনের সমস্যায় শিশুকে ভ্রমণের চাপ কাটিয়ে উঠার জন্য সময় দিতে হবে। এছাড়া খেয়াল রাখতে হবে যাতে একেবারে খালি পেটে কোথাও ভ্রমণ করা না হয়।
ফিডের পর ঢেঁকুর তোলান
প্রতি খাওয়ানোর সেশনের পরে বাচ্চার ঢেঁকুর তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চাদের খাওয়ার সময় বাতাস গিলে ফেলার ঝোঁক থাকে। এই বায়ুটি আটকে যায় এবং তীব্র পেট ব্যথার কারণ হতে পারে। এটি এড়ানোর জন্য, শিশুকে সোজা অবস্থানে রাখুন এবং প্রতিবার খাওয়ানোর পরে আস্তে আস্তে তার পিঠে ও পেটে টোকা দিন।
করণীয়
♦ নবজাতক ও ছোট শিশুদের প্রতিবার দুধ খাওয়ানোর পর শিশুর ঢেঁকুর তোলানোর চেষ্টা করুন। শিশুর মাথা উঁচু করে সোজা করে খাওয়ানোর চেষ্টা করুন এবং প্রতিবার খাওয়ানোর পর কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে তার পিঠে থাপ্পড় দিতে থাকুন। এতে বাতাস বের হয়ে যায়।
♦ গ্যাসের সমস্যা এবং শিশুদের পেট ব্যথা উপশম করাতে হাঁটু বাঁকানো ব্যায়াম খুব কার্যকর। আপনার শিশুকে চিত করিয়ে শোয়ানোর পর পা দুটি হাঁটুর দিকে ভাঁজ করে পেটের দিকে ঠেলে দিন। এই ব্যায়ামটি দৈনিক চার থেকে পাঁচবার করালে ভালো হয়।
♦ ছোট শিশুদের প্রথম খাবারে অভ্যাস করার সময় ধীরে ধীরে একেবারে তরল, নরম খাবার, খিচুড়ি বা চাল, ডাল, সবজি, ছোট মাছ, মুরগির মাংস, ডিম মিশ্রিত খাবার দিন। কোনো খাবারে অ্যালার্জি আছে কি না খেয়াল করুন এবং প্রয়োজনে সেটি বাদ দিন। খাদ্য প্রস্তুত ও পরিবেশনে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন। এখন করোনাকালে শিশুদের ঘন ঘন হাত ধোয়ার অভ্যাস করান।
কখন হাসপাতালে নেবেন
ব্যথা যদি খুব তীব্র হয়, সঙ্গে জ-র থাকে, অনবরত বমি হয়, পেট শক্ত হয়ে যায়, মলের বা বমির সঙ্গে রক্ত দেখা দেয় বা পিত্ত বমি হয়, সে ক্ষেত্রে শিশুকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। সুনির্দিষ্ট কারণ জানার আগে শিশুকে কিছুই খাওয়ানো উচিত নয়।