
গর্ভাবস্থায় পা ফুলে যাওয়ার কারণ কি? গর্ভাবস্থায় ফোলা প্রতিরোধের ঘরোয়া প্রতিকার-What is the cause of swollen feet during pregnancy? Home remedies for bloating during pregnancy
গর্ভাবস্থায় হবু মায়েদের শরীরে নানারকম পরিবর্তন দেখা দেয়। শারীরিক এবং মানসিক দুই দিকেই এই পরিবর্তন আসে। হরমোনের তারতম্যের কারণে শরীরে রক্ত এবং তরলের উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই গর্ভাবস্থার সময় দেহের বিভিন্ন অংশ ফুলে ওঠে।
প্রেগনেন্সির সময় একজন নারীর শরীরে প্রায় ২৫ শতাংশ ওজন বাড়ে, শুধু এই অতিরিক্ত তরলের কারণে। এজন্যই হাত, মুখ, পা এবং গোড়ালি ফোলা ফোলা দেখায়। সাধারণত গর্ভাবস্থায় এই শারীরিক সমস্যা হয়ে থাকে। এর মধ্যে ইডিমা বা পা ফুলে যাওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার। এর ফলে পা, পায়ের পাতা এবং গোড়ালির জায়গাগুলোতে ফুলে যায়। সাধারণত এটি হয়ে থাকে গর্ভাবস্থার শেষ কয়েক মাসে।
গর্ভাবস্থায় ফোলা কতটা সাধারণ?
গর্ভাবস্থায় ফোলা একটি সাধারণ সমস্যা, যা যেকোনো গর্ভবতী মহিলাকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রদাহের বিভিন্ন ওঠানামা দেখা যায়। যদিও প্রদাহজনক অবস্থা গর্ভাবস্থায় নিরাময় করা যেতে পারে, তবে মহিলা যদি অন্য কোনও শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন তবে ফোলা তীব্র হতে পারে। যাইহোক, গর্ভাবস্থায় শরীরের পরিবর্তনের কারণে এই সমস্যাটি দেখা দেয়।
আরও পড়ুন: গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
গর্ভাবস্থায় ফোলার কারণ কী?
গর্ভাবস্থায় ফুলে যাওয়া সম্পর্কে জানার পর এর কারণগুলোও জানা জরুরি। প্রকৃতপক্ষে, গর্ভাবস্থায় শরীরে মোট পানির পরিমাণ ছয় থেকে আট লিটারে বেড়ে যায় এবং এই অবস্থার ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে ফুলে যায়। এগুলি ছাড়াও, অনেকগুলি কারণ রয়েছে, যা গর্ভবতী মহিলা ফুলে যেতে পারে, যেমন:
হরমোনের পরিবর্তনঃ
গর্ভকালীন প্রথম তিন মাসে রক্তে প্রোজেস্ট্রেরন হরমোনের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। শরীরে পানি জমার এটি অন্যতম কারণ। শিশুর আকার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মায়ের শরীরে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি রক্ত ও তরল উৎপাদিত হয়।
জরায়ু বৃদ্ধিঃ
চতুর্থ মাসের শুরু থেকে জরায়ুর আকার বাড়তে থাকে। গর্ভের শিশু যখন বড় হয়, তখন তার মাথার চাপে মায়ের নিম্নাঙ্গের যে শিরাগুলো দিয়ে রক্ত হৃৎপিণ্ডে প্রবাহিত হয়, সেগুলোতে রক্তের চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে নিম্নাঙ্গ থেকে হৃৎপিণ্ডে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। শিরা থেকে তরল বের হয়ে শরীরের টিস্যুতে জমতে থাকে। এতে পায়ে পানি আসে বা ফুলে যায়।
প্রি-এক্লাম্পসিয়া বা গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপঃ
প্রি-এক্লাম্পসিয়ায় গর্ভবতী মহিলার হাত এবং মুখ ফুলে যেতে পারে। প্রি-এক্লাম্পসিয়া হল একটি মেডিকেল অবস্থা যা গর্ভবতী মহিলার গর্ভাবস্থার 20 তম সপ্তাহের পরে হঠাৎ রক্তচাপ বৃদ্ধি এবং প্রস্রাবে প্রোটিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। যেসব মহিলাদের দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাদেরও প্রি-এক্লাম্পসিয়া হতে পারে। প্রি-এক্লাম্পসিয়ায় গর্ভবতী মহিলাদের অবশ্যই সময়মত চেকআপ করাতে হবে। কারণ এই রোগ মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
আরও পড়ুন: গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার উপায়
উপরে উল্লিখিত কারণগুলি ছাড়াও, একজন গর্ভবতী মহিলার নিম্নলিখিত কারণেও ফুলে যেতে পারে:
দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাঃ
এক জায়গায় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে, গোড়ালি এবং পায়ের পাতা ফুলে যেতে পারে।
কিডনির সমস্যাঃ
যেসব গর্ভবতী মহিলাদের কিডনির সমস্যা আছে তাদেরও শরীরে ফুলে যাওয়ার সমস্যা হতে পারে। যখন কিডনি শরীর থেকে অতিরিক্ত সোডিয়াম এবং পানি অপসারণ করতে অক্ষম হয়, তখন রক্তের ধমনীর উপর চাপ বেড়ে যায় এবং ফলস্বরূপ পা ও চোখ ফুলে যেতে পারে।
লিভারের সমস্যাঃ
লিভারের রোগ বা অন্যান্য সমস্যা গর্ভাবস্থায় ফুলে যাওয়ার কারণ হতে পারে।
আরও পড়ুন: গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমি হলে করণীয়
গর্ভাবস্থায় ফোলা প্রতিরোধের ঘরোয়া প্রতিকার
এমন নয় যে গর্ভাবস্থায় ফোলা নিরাময় করা যায় না। নীচে জেনে নিন, গর্ভাবস্থায় ফোলা থেকে মুক্তি পেতে কিছু নির্বাচিত প্রতিকার।
স্থির থাকা এড়িয়ে চলুন – এক জায়গায় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে পা ফুলে যেতে পারে। অতএব, গর্ভাবস্থায় দীর্ঘ সময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা এড়িয়ে চলুন।
বাম দিকে ঘুমান- গর্ভাবস্থায় মহিলাদের বাম দিকে ঘুমানো উচিত। এভাবে ঘুমালে হৃৎপিণ্ড, জরায়ু ও লিভারসহ সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন ঠিক থাকে।
বায়ুচলাচল এবং আরামদায়ক জুতা পরুন – টাইট জুতা পায়ে রক্ত প্রবাহকে প্রভাবিত করতে পারে, যা ফুলে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। এই সময়, গর্ভবতী মহিলাদের আরামদায়ক এবং বায়ুচলাচলযুক্ত জুতা পরতে হবে, যাতে হাঁটাচলায় কোন বাধা না হয়।
পুষ্টিকর খাবার খান – গর্ভাবস্থায় পুষ্টিকর খাবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টিকর খাবার আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি প্রদাহের মতো সমস্যার সম্ভাবনা কমায়। আপনি গর্ভাবস্থায় ফোলা কমাতে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ খাবার খেতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে পালং শাক, বাদাম, মাছ যেমন স্যামন-টুনা, কমলা এবং নীল বেরি ইত্যাদি।
সোডিয়াম কম গ্রহণ – ফোলা হওয়ার পিছনে একটি কারণ হল শরীরে সোডিয়ামের আধিক্য। অতএব, গর্ভাবস্থায় সোডিয়াম গ্রহণ নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শরীরকে হাইড্রেটেড রাখুন – শরীরের ফোলাভাব এড়াতে শরীরকে যতটা সম্ভব হাইড্রেটেড রাখুন। একটি হাইড্রেটেড শরীর প্রদাহের অবস্থা নিরাময়ে কাজ করে।
ঢিলেঢালা এবং আরামদায়ক পোশাক পরুন – ফুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঢিলেঢালা এবং আরামদায়ক পোশাক পরুন। টাইট পোশাক আপনার ফোলা জায়গার জন্য বেদনাদায়ক হতে পারে।
থেরাপি – আপনি শরীরের ফোলা কমাতে থেরাপি অবলম্বন করতে পারেন। এই জন্য, আপনি একজন অভিজ্ঞ থেরাপিস্টের সাথে পরামর্শ করুন। থেরাপিস্ট আপনার প্রদাহের পর্যায় অনুযায়ী থেরাপি এবং অন্যান্য ব্যায়াম করতে সাহায্য করবে।
কম্প্রেস স্টকিং – পায়ের ফোলাভাব কমাতে আপনি কম্প্রেস স্টকিংয়ের সাহায্য নিতে পারেন। এগুলি হল এক ধরনের ইলাস্টিক মোজা, যা ফোলা পায়ে সংকুচিত করে ফোলা কমাতে কাজ করে।
ব্যায়াম – শরীরের ফোলাভাব কমাতে ব্যায়ামের সাহায্য নিতে পারেন। ব্যায়াম ফোলা জায়গা থেকে তরল প্রবাহ স্বাভাবিক করতে সাহায্য করবে। গর্ভাবস্থায় যেকোনো ধরনের শারীরিক ব্যায়াম করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
পুলে আরাম করুন – শরীরের ফোলাভাব থেকে মুক্তি পেতে, আপনি পুলে শরীরকে শিথিল করতে পারেন। কিছু সময়ের জন্য পানিতে থাকা ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং ফোলা উপশম করে।
ধূমপান এড়িয়ে চলুন – শরীরের প্রদাহের সময় আপনার ধূমপান এড়ানো উচিত। এই সময়ে ধূমপান আরও প্রদাহ বাড়াতে পারে।
ক্যাফেইন গ্রহণ কম করুন – প্রদাহের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব ক্যাফেইন গ্রহণ কমিয়ে দিন। ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় (চা এবং কফি) শরীরকে ডিহাইড্রেট করতে কাজ করবে, যা শরীরের ফোলা অংশকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
রিফ্লেক্সোলজি – আপনি প্রদাহ থেকে মুক্তি পেতে রিফ্লেক্সোলজির সাহায্য নিতে পারেন। এটি একটি বিকল্প ঔষধ পদ্ধতি, যাতে আক্রান্ত স্থান টিপে দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। প্রদাহের ক্ষেত্রে এটি কতটা কার্যকর তা নিয়ে আরও গবেষণা করা বাকি। এই থেরাপি গ্রহণ করার আগে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
পায়ে সাপোর্ট – পায়ের পাতায় ফোলাভাব থাকলে পায়ের নিচে বালিশও রাখতে পারেন। এতে করে পা উঁচু থাকবে এবং আপনি আরাম বোধ করতে পারবেন।
আরও পড়ুন: গর্ভবতী অবস্থায় রক্তপাত হলে করণীয়
কখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেনঃ
নিচের পাঁচটি লক্ষণের যেকোনোটি দেখা দিলে গর্ভবতী মাকে দেরি না করে ডাক্তার দেখাতে হবে—
* হঠাৎ করেই মুখ, হাত অথবা পা ফুলে যাওয়া
* তীব্র মাথাব্যথা হওয়া
* দৃষ্টিশক্তির সমস্যা হওয়া। যেমন: দৃষ্টিশক্তি ঘোলাটে হয়ে যাওয়া অথবা চোখে আলোর ঝলকানির মতো কিছু দেখা
* বুকের পাঁজরের ঠিক নিচে তীব্র ব্যথা হওয়া
* ওপরের যেকোনো লক্ষণের পাশাপাশি বমি হওয়া
* এগুলো প্রি-এক্লাম্পসিয়া এর লক্ষণ হতে পারে। সেক্ষেত্রে রোগীকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।