গ্যাস্ট্রিক আলসারের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ও ঔষধ-Homeopathic treatment and medicine for gastric ulcer
সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত পরিচিত নাম পেপটিক আলসার। পেপটিক আলসার আসলে কী? পাকস্থলী থেকে নিঃসৃত হাইড্রোক্লোরিক এসিড এবং পেপসিনের ক্রিয়ার ফলে পরিপাকতন্ত্রের কোনো স্থানে ক্ষত বা ঘা সৃষ্টি হলে তাকে পেপটিক আলসার বলে। পেপটিক কথাটি মূলত এসেছে পাকস্থলীর প্রোটিন পরিপাকে সাহায্যকারী এনজাইম ‘পেপসিন’ থেকে। কোথায় কোথায় পেপটিক আলসার হয়।
পেপটিক আলসার সচরাচর বেশি হয় ডিওডেনাম ও পাকস্থলীতে। অতিরিক্ত এসিড নিঃসরণের জন্য ডিওডেনামে আলসার হয়। ডিওডেনাম হলো ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথম অংশ। এখানে আগে থেকে অগ্ন্যাশয়ের ক্ষারীয় রস এসে থাকে, যা পাকস্থলী থেকে আগত এসিড মিশ্রিত খাদ্য থেকে ডিওডেনামকে রক্ষা করে। কিন্তু যদি ক্ষারীয় অগ্ন্যাশয়ে রস পর্যাপ্ত না আসে তাহলে অতিরিক্ত এসিডের জন্য ডিওডেনামে ঘা হতে পারে। একে বলে ডিওডেনাল আলসার। ওই দিকে, পাকস্থলী থেকে অতিরিক্ত হাইড্রোক্লোরিক এসিড নিঃসৃত হলে পাকস্থলীর ঝিল্লি আবরণী পর্দাটি নষ্ট হয়ে সেখানে ঘা হতে পারে। একে বলে গ্যাস্ট্রিক আলসার। গ্যাস্ট্রিক আলসার এবং ডিওডেনাল আলসার- এ দুটোকে একত্রে পেপটিক আলসার বলে।
আরো পড়ুন: গ্যাস্ট্রিকের সহজ ঘরোয়া চিকিৎসা
আলসার ২ প্রকার যথা-
(১) গ্যাস্ট্রিক আলসার বা পাকস্থলীর আলসার এবং (২) ডিওডেনাল আলসার।
সাধারণ ভাবে খাদ্যথলি বা ক্ষুদ্রান্তের প্রথম ভাগে এই রোগ হয়। তবে এই রোগকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। খাদ্যথলির ভিতর যে আলসার হয় তাকে বলে গ্যাস্ট্রিক আলসার। ক্ষুদ্রান্তের প্রথম অংশে যে আলসার হয়, তাকে বলে ডিওডিনাম আলসার বলে। ডিওডেনাল আলসার ও পাকস্থলীর আলসার—এই দুই প্রকার আলসারকে অনেক সময় পেপটিক আলসারও বলা হয়।
পেপটিক আলসার হওয়ার কারণ
পেপটিক আলসারের প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত অ্যাসিড নিঃসরণ এবং পাকস্থলীর ঝিল্লি আবরণী বা মিউকাস মেমব্রেনের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া। বিভিন্ন কারণে এটা হতে পারে। পেপটিক আলসার হওয়ার পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো-
বংশগত
পেপটিক আলসারের রোগীদের ক্ষেত্রে বংশগত প্রভাব লক্ষ করা যায়। দেখা গেছে বাবা-মায়ের পেপটিক আলসার থাকলে তা সন্তান-সন্ততিরও হচ্ছে।
অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া
ঠিকমতো খাবার চিবিয়ে না খেলে কিংবা অনিয়মিত খাবার খেলে পেপটিক আলসার হয়। আমাদের শরীর মূলত বায়োলজিক্যাল ঘড়ি। খাওয়া-দাওয়ার বেলায় সাধারণত আমরা একটা নিয়ম মেনে চলি। অর্থাৎ সকালে নাশতা, দুপুরে ভাত, বিকেলে নাশতা, আবার রাতে ভাত। এই খাদ্যাভ্যাস অনুসারে পাকস্থলীতে এসিড নিঃসৃত হয়। অর্থাৎ যে যেভাবে খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলবেন তার এসিড নিঃসরণের ব্যাপারটা সেভাবে ঘটবে। যারা উপরি উক্ত অভ্যাসে অভ্যস্ত তারা যদি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটান অর্থাৎ দুপুরের খাবার বিকেলে কিংবা রাতের খাবার নির্দিষ্ট সময়ে না খেয়ে আরো পরে খান, তাহলে এসিড নিঃসরণের ফলে দেখা দেবে জটিলতা। এভাবেই সৃষ্টি হয় আলসারেরর।
ধূমপান
ধূমপানের প্রভাবে পাকস্থলীর আবরণী ঝিল্লি নষ্ট হয় এবং এসিড নিঃসরণের মাত্রাও বেড়ে যায়। ফলে অনিবার্যভাবে সৃষ্টি হয় আলসার।
মসলাযুক্ত খাবার
অতিরিক্ত তেল, ঝাল এবং মসলাযুক্ত খাবার এসিড নিঃসরণের মাত্রা বাড়িয়ে পেপটিক আলসার তৈরিতে সাহায্য করে। বাসি খাবারও তাই।
চা, কফি কিংবা অ্যালকোহল পান
এসব পানীয় পেপটিক আলসারের অন্যতম কারণ। যারা চা, কপি কিংবা অ্যালকোহলে আসক্ত তাদের পেপটিক আলসার হবেই।
ব্যথার ওষুধ
পেপটিক আলসারে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো দীর্ঘ দিন ব্যথার ওষুধ খাওয়া। ব্যথার ওষুধ খালিপেটে খেলে কিংবা এই ওষুধের সাথে অ্যান্টাসিড বা রেনিটিডিন জাতীয় ওষুধ না খেলে পেপটিক আলসারে আক্রান্ত হতে হয়।
আরো পড়ুন: পেট কামড়ানোর ঘরোয়া চিকিৎসা
পেপটিক আলসারের লক্ষণ
# আলসারের লক্ষণ কম থেকে বেশি সব ধরনের হতে পারে। অনেক সময় খুব কম সময়ের জন্যে এই লক্ষণগুলো দেখা যেতে পারে। আবার অনেক সময় বেশ কয়েকমাস ধরে এই ধরনের সমস্যা দেখা যেতে পারে।
# খাওয়ার আগে বা পরে পেটের উপর দিকে ব্যথা বা অস্বস্তি হয়। খাওয়ার পরে ব্যথা বা অস্বস্তি বেড়ে যায় বা কমে যায়।
# এছাড়া বুকের নীচে ব্যথা, পেটে জ্বালা, গ্যাস, অম্বল, পেটভার, পেট ফুলতে থাকা, গা বমিভাব ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়।
# অনেক সময় আলসারের কারণে মুখ থেকে রক্ত পড়ে বা অনবরত বমির সঙ্গে বা স্টুলের সঙ্গে রক্ত পড়ে।
# ডিপ আলসারের কারণে অন্ত্রে ফুটো হলে প্রথমে প্রচণ্ড রকমের অ্যাবজেমিনাল পেন দেখা যায়।
গ্যাস্ট্রিক আলসারের হোমিওপ্যাথিক ঔষধ
গ্যাস্ট্রিক আলসারের কার্যকরী হোমিওপ্যাথিক ঔষধ তৈরি করতে তিনটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ লাগবে ১। সিমফাইটাম মাদার টিংচার ২। হাইড্রাসটিস ক্যান মাদার টিংচার ৩। রুবিনিয়া মাদার টিংচার।
এই ঔষধ গুলি ১০ এমএল করে নিয়ে ৩০ এমএল মিক্সার তৈরি করে আধা কাপ পানিতে ২৫ ফোঁটা করে দিয়ে দিনে তিনবার খাবার আধা ঘন্টা পূর্বে খেতে হবে।
এছাড়াও গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণ অনুযায়ী যেমন রোগী যদি পেটে জ্বালা অনুভব করে, বমি হয়, বমি ভাব থাকে, রোগীর মৃত্যু ভয় থাকে বা রোগী যদি দুর্বল হয় তবে আর্সেনিক ৩০ তিন ফোঁটা করে জিভে দিয়ে দিনে তিনবার খাবার আধা ঘন্টা পর খেতে হবে।
যদি রোগীর কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে, যদি নেশা করার ফলে গ্যাস্ট্রিক আলসার হয়ে থাকে তাহলে নাক্স ভমিকা ৩০ তিন ফোঁটা করে দিনে তিনবার খাবার ৩০ মিনিট পর খেতে হবে।
যদি বারবার ঢেকুর উঠে তাহলে কার্বোভেজ ৩০ তিন ফোঁটা করে দিনে তিনবার খেতে হবে। গ্যাস্ট্রিক আলসারের একটি কার্যকরী বায়োকেমিক কম্বিনেশন ঔষধ হলো বিসিবি ২৫।
এই ঔষধটি গ্যাস, অম্বল, বদহজম, বুক জ্বালা, গ্যাস্ট্রিক আলসারের ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী একটি বায়োকেমিক কম্বিনেশন ঔষধ। পাঁচটি করে বড়ি দিনে তিনবার চিবিয়ে খেয়ে হালকা গরম পানি খেতে হবে। এতে আশা করা যায়, গ্যাস্ট্রিক আলসার থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনও ঔষধ সেবন করা ঠিক হবে না।
আরো পড়ুন: গ্যাস্ট্রিকের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ও ঔষধ
ডিওডেনাল আলসার:
খাদ্য পাকস্থলী হতে নিচের দিকে অপেক্ষাকৃত সরু যে নালিতে প্রবেশ করে সেই বাকা অংশ টিকে ডিওডেনাল বলে। সেই ডিওডেনালের মিওকাস মেমব্রেন ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে ক্ষতের সৃষ্টি হলে তাহাকে ডিওডেনাল আলসার বলে। সাধারণত ৩০-৪০ বছর বয়সের মানুষ এ রোগে বেশী আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে যে সকল পুরুষ মানুষের রক্তের গ্রুফ ০(+) তাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
রোগের মূল কারণ এবং আনুষঙ্গিক কারণ: গ্যাস্ট্রিক আলসারের ন্যায়।
ডিওডেনাল আলসারের লক্ষণগুলো:
খাবার গ্রহণের ১-৩ ঘণ্টা পর পেটে ব্যথা শুরু হয়। রক্ত বমি খুব একটা হয় না, কখনও হলেও রক্তের বর্ণ কালো দেখায়। পায়খানার সহিত কালো বর্ণের রক্ত যায় বা রক্ত পায়খানা। জ্বালা যুক্ত ব্যথা। রোগীদেও পেটে ক্ষিদে পেলেই ব্যথা বৃদ্ধি হয়। পেটে ব্যথার সময় মুখে পানি আসে বুক জ্বালা করে।
ডিওডেনাল আলসাররের চিকিৎসা: আর্সেনিকাম এলবাম, এনার্কাডিয়াম, আর্জেন্টাম নাইট্রিকাম, ক্যাডমিয়াম সালফ, ক্রিয়োজোটাম, সিকেলিকর।
করনীয়
* হালকা, সহজপাচ্য খাবার খান।
* খুব বেশি ঝাল ও তেল- মশলাদার খাবার না খেলেই ভাল।
* নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়ার চেষ্টা করুন।
* স্মোকিং, অতিরিক্ত অ্যালকোহল এরিয়ে চলুন।
* মানসিক চাপ, অতিরিক্ত পরিশ্রমের চাপ পরিহার করা প্রয়োজন।