দাঁতের রোগ ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি - Dental diseases and modern treatment methods
সঠিকভাবে মুখ পরিষ্কার করার অভাবে প্রায়ই আমাদের মুখের নানান ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। মুখের বিভিন্ন রোগের মধ্যে বেশি দেখতে পাওয়া যায় দাঁত ও মাড়ির বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। তবে মুখ ও দাঁতের রোগ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে হৃদপিণ্ড, লিভার, মস্তিষ্কসহ শরীরের গুরুত্পূর্ণ অঙ্গ। তাই মুখ ও দাঁতের রোগ প্রতিরোধ করা জরুরি।
দাঁতের সমস্যা মূলত দু’ধরনের হয়- ১. দাঁতের সমস্যা ২. মাড়ির সমস্যা
দাঁতের সমস্যা
কেরিজ
সাধারণ মানুষ চলতি কথায় এই সমস্যাকে ‘দাঁতে পোকা লেগেছে’ বলে উল্লেখ করেন। সত্যি বলতে কী, দাঁতে পোকা বলে কিছু হয় না। আসলে হয় ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ। আর তার কারণে হয় দাঁতে ক্ষয়। দাঁতে ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। যেমন, দিনে দু’বেলা ঠিকমতো ব্রাশ না করা। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ইত্যাদি।
তবে হ্যাঁ, ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ছাড়াও দাঁতের ক্ষয় হতে পারে। বেশি চাপ দিয়ে খাদ্য চিবানোর অভ্যেসের কারণেও অনেকের দাঁত ক্ষয়ে যায়। এমনকী ভুল পদ্ধতিতে অতিরিক্ত চাপ দিয়ে ব্রাশ করার ফলেও দাঁতের ক্ষয় হতে পারে। আর হ্যাঁ, ব্রাশ করার সঠিক পদ্ধতি হল ওপর থেকে নীচের দিকে ও নীচ থেকে উপর দিকে।
মনে রাখতে হবে, দাঁতের ক্ষয় নার্ভ পর্যন্ত পৌঁছে গেলে প্রবল ব্যথা শুরু হয়। তখন চিকিৎসা বলতে রয়েছে একমাত্র রুট ক্যানাল। না হলে দাঁত তুলে ফেলতে হয়। এই প্রসঙ্গেই জানিয়ে রাখি, জেরোডন্টোলজির প্রিভেনটিভ প্রস্থোডন্টিকস-এর বিশেষ বিভাগে, রোগীকে এখন আসল দাঁত রেখে দিতেই উৎসাহ দেওয়া হয়। কারণ বাঁধানো দাঁতের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে।
তাই মুখে অন্তত একটি দাঁতও বেঁচে গেলে সেই দাঁতটির গোড়া না তুলে সেটিকেই খুঁটি করে বা সেই দাঁতের উপরে বাঁধানো দাঁত বসানো হয়। এই পদ্ধতিকে ওভার ডেঞ্চার ফ্যাব্রিকেশন বলে। এই উপায়ে বাঁধানো দাঁত মুখে আঁটসাঁটভাবে বসে থাকে। হুটহাট খুলে চলে আসে না। অবশ্য যাঁদের মুখে একটিও দাঁত নেই তাঁদের ক্ষেত্রে চোয়ালে ইমপ্লান্টও করা যায়।
অতএব বোঝাই যাচ্ছে দাঁতের ক্ষয় ঠিক কতখানি মারাত্মক আকার নিতে পারে। তাই রোগীর উচিত দাঁতে কেরিজ দেখা দিলে আগেভাগে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা। সময়ে চিকিৎসকের পরার্মশ মেনে ক্ষয়ের জায়গায় ফিলিং করিয়ে নিলে দীর্ঘদিন আসল দাঁতেই কাজ চালানো যায়। এছাড়া ছ’মাস অন্তর একবার করে স্কেলিং করিয়ে নিতে পারলেও দাঁত ভালো থাকে।
মাড়ির সমস্যা
মুখের মধ্যে দাঁতের যেটুকু অংশ দেখা যায়, তার প্রায় দেড় গুণ অংশ মাড়িতে গাঁথা থাকে, যাকে দন্ত চিকিৎসাশাস্ত্রে রুট বলে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাড়ির ক্ষয় হয়। ফলে রুটের কিছু অংশ বেরিয়ে আসে। এইভাবে দাঁতের গোড়ার মাড়ি সরে গেলে দাঁত আলগা হয়ে নড়ে যায়।
এছাড়া পান, বিড়ি, সিগারেট, গুটকা খাওয়ার বদভ্যাসেও দাঁতের গোড়া থেকে মাড়ি ক্রমশ নীচের দিকে নামতে থাকে। দাঁতের গোড়ায় পাথর জমার সম্যসাও দেখা যায়। মুখ থেকে দুর্গন্ধও বের হতে থাকে। মাড়ি থেকে রক্তপাতও হয়। মাড়ি থেকে রক্ত হওয়া মোটেই ভালো বিষয় নয়। রক্ত বের হওয়া মানেই বুঝতে হবে ইতিমধ্যেই দাঁতের গোড়া দুর্বল হতে শুরু করেছে। এমনকী সংক্রমণের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
মনে রাখবেন, মাড়ির রোগে সমগ্র দাঁতই দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে খাদ্য চিবিয়ে খেতে অসুবিধা হয়। মাড়ির সমস্যার চিকিৎসা সঠিক সময়ে না করলে দাঁতের গোড়াতেও ক্ষয় হতে থাকে। দ্রুত এবং কমবয়সে সব দাঁত পড়ে যায়। অতএব মাড়ি ফুললে, মাড়ি থেকে রক্ত বেরলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
অন্যান্য সমস্যা
অনেকের কষের দাঁত ক্ষয়ে যায়। তাই খাদ্য চিবানোর জন্য অন্যদিকের কষের দাঁত ব্যবহার করেন। চিকিৎসা না করালে এরপর মুখের সামনের দিকের দাঁতগুলিও ক্ষয়ে যায়। সমস্যা হল, দাঁত ক্ষয়ে গিয়ে বা দুর্বল হয়ে ভেঙে গেলে ধারালো হয়ে যায়। এর ফলে জিভ কেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এইভাবে জিভে ঘা তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে ধারালো অংশ গ্রাইন্ডিং করে মসৃণ করে না নিলে ভবিষ্যতে ঘা থেকে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই সমস্যাকে একেবারেই অবহেলা করবেন না।
দাঁতের রোগ ও অন্য শারীরিক সমস্যা
মনে রাখবেন ডায়াবেটিস হলে হাড়ের ক্ষয় বেড়ে যায়। দাঁত আর হাড় একইরকম উপাদানে তৈরি। ফলে ডায়াবেটিস রোগীর দাঁতের ফাঁক বাড়তে দেখা যায়। দাঁত ক্রমশ আলগা হতে থাকে। দাঁতের ফাঁকে খাবার আটকে কেরিজের আশঙ্কা বেড়ে যায়। এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে উচ্চ রক্তচাপের রোগীরও ওষুধের প্রভাবে দাঁত ও মাড়িতে কিছু কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে। অতএব এই ধরনের রোগীর উচিত বছরে অন্তত একবার করে দন্তরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া।
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি
কৃত্রিম দাঁত হিসেবে খোলাযোগ্য ডেনচার পদ্ধতির জনপ্রিয়তা ছিল অনেক, কিন্তু অপেক্ষাকৃত অনেক কম চিকিৎসা খরচ হলেও এর সঙ্গে বাড়তি প্লেট, তার, প্রতিদিন খোলার ঝামেলা, কথা বলতে জড়তা ইত্যাদি নানা কারণে এর জনপ্রিয়তা এখন নেই বললেই চলে।
পরবর্তীকালে ব্রিজ পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বাড়ে, কৃত্রিম দাঁতটি পাশের সুস্থ দাঁতকে পিলার হিসেবে কাজে লাগিয়ে শক্তভাবে লেগে থাকে। তবে পাশের সুস্থ দাঁতকে কাজে লাগানোর বিষয়ে অনেকের অনীহা থাকায় জনপ্রিয়তা বাড়ছে ইমপ্ল্যান্ট পদ্ধতির, যদিও ব্রিজ পদ্ধতি বৈজ্ঞানিকভাবে নিরাপদ।
ইমপ্ল্যান্ট পদ্ধতির সুবিধা
* দাঁতটি অনড়ভাবে প্রতিস্থাপিত হবে
* অন্য কোনো দাঁতের সাহায্য লাগে না বা বাড়তি কোনো অংশ থাকে না
* দেখতে ও কাজে স্বাভাবিক দাঁতের মতো
* চিকিৎসা খরচ বেশি হলেও স্থায়িত্ব অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে বেশি ও আরামদায়ক
আধুনিক চিকিৎসায় লেজার
দাঁত ক্ষয় :যেসব দাঁতে ক্যাভিটি বা গর্ত থাকে সেসব দাঁতের চিকিৎসায় লেজার ব্যবহার হয়।
মাড়ি প্রদাহ : মাড়িতে ক্যালকুলাস বা পাথর দূর করতে এর ব্যবহার হয়। মাড়ি ফুলে যাওয়া বা দাঁতের ওপর মাড়ি উঠে এলে তাকে পূর্বাকৃতি দিতে লেজারের ব্যবহার হয়। এ চিকিৎসার নাম জিনজিভেকটমি।
রুট ক্যানেল থেরাপি :এ চিকিৎসায় রোগীরা একটু ভয়েই থাকেন ব্যথাদায়ক হওয়ায়। লেজারের আওতায় ভয়ের কোনো কারণই নেই।
বায়োপসি :ক্যান্সার নির্ণয়ে বায়োপসি পরীক্ষা করা হয় ক্ষত স্থান থেকে সামান্য অংশ কেটে নিয়ে। এতে প্রয়োজন হয় অ্যানেস্থেশিয়ার। লেজারে পদ্ধতিতে অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়াই বায়োপসি সম্ভব।
দাঁত সাদা করা : হলদেটে দাঁত সাদা করতে লেজারে ব্লিচিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
মাড়ির স্বাভাবিক রং ফেরাতে :ধূমপায়ী হলে বা রক্তবাহিত রোগ থাকলে মাড়ির রং কালো বা বাদামি হতে পারে। লেজারে ব্যথামুক্তভাবে ডিপিগমেন্টেশন করে স্বাভাবিক রং ফিরিয়ে আনে।
সেনসিটিভিটি রোধে :দাঁত শিরশির করা বা সেনসিটিভিটি দূর করতে লেজারের ব্যবহার হয়।
মুখের ক্ষত :অ্যাপথাস আলসার নামক একটি ক্ষত অনেকের মুখে দেখা যায়। জিহ্বা, ঠোঁট, মাড়ি বিভিন্ন জায়গাতে দেখা যায় যা প্রচণ্ড যন্ত্রণাদায়ক। লেজার পদ্ধতিতে অতি দ্রুত এ যন্ত্রণা কমিয়ে আনা সম্ভব।
ইমপ্ল্যান্ট সার্জারিতে :ডেন্টাল ইমপ্ল্যান্টের শেষ ধাপে মাড়ি প্রস্তুত করতে লেজার ব্যবহার হয়।
চিকিৎসা ব্যয় :কোন পদ্ধতি এবং কী ধরনের যন্ত্রপাতির ব্যবহার হচ্ছে এর ওপর ভিত্তি করে খরচের তারতম্য হতে পারে। দাঁতের অন্য পদ্ধতির চিকিৎসার তুলনায় সেশন কম লাগে। তাই ব্যয়ও কম হয়ে থাকে। তবে এ দেশে লেজার চিকিৎসা অতটা সম্প্রসারিত না হওয়ায় খরচ কিছুটা বেশি বলে ধরে নেওয়া যায়।