
গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যার কারণ এবং সমাধান
গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন জটিলতা এড়াতে গর্ভকালীন যত্ন বা অ্যান্টিনেটাল কেয়ার নেওয়া প্রয়োজন। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় হবু মায়েদের অন্যতম একটি সমস্যা ঠিকমতো ঘুম না হওয়া। গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তন ও শারীরিক নানা সমস্যার জন্য স্বাভাবিকভাবেই ঘুম ঠিক মতো হয় না। আর এসবের সাথে রয়েছে হবু মায়ের মানসিক দুশ্চিন্তা, অনাগত শিশুর আগমন নিয়ে উত্তেজিত থাকা, ক্রমাগত বাথরুমে যাওয়া আসা আরও আনুশাংগিক সব সমস্যা। আর এতো সব কিছু মিলিয়ে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় প্রতি ১০ জনের প্রায় ৮জন মহিলায় ঘুমজনিত সমস্যায় ভোগেন।
এটা সত্যি প্রেগন্যান্ট অবস্থায় সলিড ঘুম বা আরামদায়ক ঘুম যাই বলি সেটা হওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয় তবে কিছু কিছু ব্যাপার নিশ্চিত করলে বা মেনে চললে হয়তো আপনি শান্তিতে ঘুমাতে পারবেন। আসুন প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বার বার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ ও সমাধান সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
যে সব কারণে গর্ভাবস্থায় অনিদ্রা দেখা দিতে পারে, সেগুলি হল-
* গর্ভাবস্থায় শেষ ত্রৈমাসিকে গর্ভের ভেতর শিশু নড়াচড়া শুরু করে দেয়। এর ফলে অনেক সময় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। গর্ভের ভেতরে শিশু যতবার নড়াচড়া করে, ততবার আপনার ঘুম ভেঙে যেতে পারে। আবার ঘুম সহজে আসতে চায় না।
* গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন হরমোনের প্রভাবে মহিলাদের ওপর মানসিক চাপ ও উদ্বেগ অনেকটাই বেড়ে যায়। এর ফলেও রাতে সাউন্ড স্লিপ হতে চায় না। গর্ভাবস্থার শেষের দিকে ডেলিভারির কথা চিন্তা করেও টেনশন বাড়ে। এর ফলেও ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
* গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোনের তারতম্যর কারণে বুক জ্বালা পোড়া হতে পারে। বলতে গেলে গর্ভাবস্থায় বুক জ্বালা পোড়া অন্যতম সাধারণ সমস্যা। প্রেগন্যান্সি হরমোনের কারণে Lower esophagel sphincter শিথিল হয়ে যাই যার ফলে পাকস্থলীর অ্যাসিড গলনালির দিকে বের হয়ে আসে। এছারাও জরায়ুর বৃদ্ধির ফলে অনেক সময় পাকস্থলীতে চাপ সৃষ্টি হয়ে পাকস্থলীর অ্যাসিড উপরের দিকে উঠে আসতে পারে যার ফলে বুক জ্বালা পোড়া করে।
* গর্ভাবস্থায় পায়ে টান ধরা খুবই সাধারণ একটা সমস্যা। অনেক গর্ভবতী মহিলারই পায়ে টান ধরে। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক থেকে বিশেষত এই সমস্যা শুরু হয়। রাতে পায়ে টান ধরলে বারবার ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
*প্রেগন্যান্ট অবস্থায় আপনার শরীরে হুট করেই অনেক হরমোনের পরিবর্তন, শরীরে নানা অংশের আমূল পরিবর্তন ও ঘ্রাণ শক্তির প্রখর বৃদ্ধি সব মিলিয়ে একজন গর্ভবতী মহিলা বারবার বমি ভাবের সম্মুখীন হয়। রাতে ঘুমাতে এসেও এই বারবার বমি বমি ভাব ঘুমাতে বাধা সৃষ্টি করে।
* গর্ভাবস্থায় বারবার প্রস্রাব ত্যাগের প্রয়োজন দেখা দেয়। এর ফলেও বারবার ঘুম ভেঙে যায়।
গর্ভাবস্থায় অনিদ্রা কি ঝুঁকিপূর্ণ?
সাধারণত ৭–৯ ঘণ্টার ঘুমকেই আদর্শ বলে ধরা হয়। এর চেয়ে কম ঘুম হলে সেটি আপনার ও গর্ভের শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে দিনে ক্লান্তি ও বেখেয়ালি বোধ হতে পারে। ফলে দৈনন্দিন কাজ করতে সমস্যা তৈরি হতে পারে।
ঘুমের সমস্যা হলে প্রসবের সময়ে সিজারিয়ান অপারেশনের প্রয়োজন বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া অনিদ্রার সাথে সঠিক সময়ের আগে প্রসব হয়ে যাওয়ার মতো প্রসব সংক্রান্ত জটিলতা, প্রিএক্লাম্পসিয়া ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে।
এসবের পাশাপাশি জন্মের পর ১ মাস বয়সে শিশুর ঘুম ও বেশি কান্নাকাটি করার সাথেও মায়ের অনিদ্রার সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে। তাই অন্যান্য সময়ের মতো গর্ভাবস্থায়ও মায়ের পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যার সমাধান
এমন সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার পাশাপাশি কিছু মূল নিয়ম মেনে চললে রাতে ঘুমের সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে।
• সন্ধ্যার পর থেকে চা-কফি-কোল্ড ড্রিংকস খাবেন না।
• রাতে ঘুমানোর ঘণ্টা দুয়েক আগে কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন সমৃদ্ধ হালকা খাবার খান। এতে রক্তে সুগারের মাত্রা ঠিক থাকে বলে সমস্যা কম হয়।
• ঘুমানোর আগে গরম দুধ খেলে শরীরে ট্রিপটোফান নামে অ্যামিনো অ্যাসিড ক্ষরিত হয়ে ঘুম নিয়ে আসে। ওটমিল, বিস্কুট ও কলাও খেতে পারেন। এতে মেলাটোনিন ও সেরেটোনিন হরমোনের প্রভাবে চটপট ঘুম আসবে। তাছাড়া এর প্রভাবে রক্তে সুগারের মাত্রা ঠিক থাকে বলেও কাজ হয় সহজে।
• মানসিক চাপ কমাতে শোওয়ার আগে গরম পানিতে স্নান করে হালকা বই পড়ুন বা গান শুনুন। ডিপ ব্রিদিং, যোগা, মেডিটেশন করুন নিয়মিত। ম্যাসাজ করালেও শরীর ও মন হালকা হয়ে যাবে।
• কোনো কারণে মনে অশান্তি দানা বাঁধলে যুক্তি দিয়ে তাকে কাটাছেঁড়া করুন। প্রয়োজনে কারও সঙ্গে আলোচনা করুন। সমাধান হলে তবে শুতে যান। না হলে দুশ্চিন্তার চোটে ঘুম বরবাদ হবে। আর এই সময় বাড়তি দুশ্চিন্তা শরীরের পক্ষে সুখকর নয়।
• সকালে বা বিকালে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো হালকা ব্যায়াম করুন। শোওয়ার আগে ঘণ্টা চারেকের মধ্যে করবেন না।
• কোলবালিশ জড়িয়ে পাশ ফিরে ঘুমান। প্রয়োজন পড়লে পেটের নীচে একটা বালিশ রাখুন। একটা রাখুন পিঠে হেলান দিয়ে।
• ৬ মাসের পর থেকে শরীর ভারী হওয়ার কারণে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মাথার নীচে ২-৩টি বালিশ দিয়ে আধশোওয়ার মতো করে ঘুমালে আরাম পাবেন। শিশুও ভালো থাকবে।
• যত অসুবিধাই হোক, ঘুমের ওষুধ খাবেন না। কারণ কম ঘুমালে সন্তানের কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু ঘুমের ওষুধে হতে পারে। তবে বাড়াবাড়ি হলে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো ওষুধ খেতে পারেন।
তথ্যসূত্র: কালের কণ্ঠ,shohay.health