ব্লাড ক্যানসার ও এর প্রতিকার
রক্তের তিন ধরনের কণিকা থাকে যেমন- রেড ব্লাড সেল (আরবিসি) বা লোহিত রক্ত কণিকা, হোয়াইট ব্লাড সেল (ডব্লিউবিসি) বা শ্বেত রক্ত কণিকা এবং প্লেটলেট (অনুচক্রিকা)। অস্থিমজ্জার ভেতরে এ রক্ত কণিকাগুলো তৈরি হয়ে শিরা-উপশিরার মাধ্যমে সব শরীরে প্রবাহিত হয়। ব্লাড ক্যান্সার হলো রক্ত বা অস্থিমজ্জার ভেতর শ্বেত রক্ত কণিকার (হোয়াইট ব্লাড সেল/ডব্লিউবিসি) অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। যেকোনো বয়সের পুরুষ বা নারীর লিউকেমিয়া বা লিম্ফোমা হতে পারে।
ব্লাড ক্যান্সার কি?
ব্লাড ক্যান্সার একটি মারাত্মক রোগ। এটি অস্বাভাবিক রক্তকণিকার অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির কারণে ঘটে। রক্ত বিভিন্ন ধরণের কোষ দ্বারা গঠিত যেমন, অক্সিজেন বহনের জন্য লোহিত রক্তকণিকা, রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করার জন্য প্লেটলেট এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে শ্বেত রক্তকণিকা। এগুলি সমস্তই স্টেম সেল থেকে উদ্ভূত হয়, যেগুলি বিভক্ত এবং পরিপক্ক হওয়ার সাথে সাথে যে কোনও ধরণের রক্তকণিকায় রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি পার্থক্য হিসাবে পরিচিত।
ব্লাড ক্যান্সারের ধরন নির্ভর করে কখন এবং কিভাবে এই সমস্যাগুলো হয় তার উপর। এই সমস্যাগুলি প্রায়শই শরীরে প্রচুর পরিমাণে অপরিণত রক্তকণিকা তৈরি করে যা তাদের কাজ সঠিকভাবে করতে ব্যর্থ হয়। তারা আপনার অস্থি মজ্জাকেও ‘ক্লোজ আপ’ করতে পারে, যা অন্যান্য ধরণের রক্তের কোষকেও তাদের কাজ করতে বাধা দেয়। এটি অনাক্রম্যতা দুর্বল হতে পারে।
ব্লাড ক্যান্সার প্রধানত ৩ প্রকার
লিউকেমিয়া: এটি একটি প্রধান ধরনের ব্লাড ক্যান্সার, যেখানে শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ লোহিত রক্তকণিকার তুলনায় অনেক বেশি। প্রায়ই, দেখা গেছে যে কিছু লোকের মধ্যে লিউকেমিয়া ক্যান্সার ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং কিছু সময়ের পরে, এটি বেশ মারাত্মক হয়ে ওঠে।
লিম্ফোমা: যখন কোনও ব্যক্তির শরীরে একটি লিম্ফোসাইট অস্বাভাবিকভাবে বিকশিত হয়, তখন সেই অবস্থাকে লিম্ফোমা বলে। তবে ওষুধ বা রেডিয়েশন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা সম্ভব, তবে দীর্ঘ সময় ধরে যদি এটি নিরাময়যোগ্য থাকে, তবে অস্ত্রোপচারই একমাত্র বিকল্প অবশিষ্ট থাকে।
মাইলোমা: মাইলোমা ক্যান্সার বলতে এমন ক্যান্সারকে বোঝায় যেখানে রক্তরস কোষ প্রভাবিত হয় এবং এর ফলে ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
ব্লাড ক্যানসারের উপসর্গ ও লক্ষণ
১. রক্তস্বল্পতার জন্য দুর্বলতা, খাবারের অরুচি, বুক ধড়ফড়, পায়ে পানি জমে যাওয়া, ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া।
২. দীর্ঘদিনের জ্বর বা ঘনঘন জ্বর
৩. অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ
৪. গ্লান্ড ফুলে যাওয়া, লিভার-প্লীহা বড় হওয়া
৫. কারো কারো ওজন কমতে পারে
৬. হাড়ে ব্যথাও হতে পারে।
৭. এছাড়া স্কিন লিভার বড় হয়ে যেতে পারে। ক্ষুধামন্দা, দুর্বলতা, কাজের মধ্যে অনীহা এবং ওজন কমতে পারে।
কীভাবে ব্লাড ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়
ব্লাড ক্যান্সারের উপসর্গ ও লক্ষণগুলোর সঙ্গে সঙ্গে রক্তের সিবিসি পরীক্ষায় অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। যেমন- হিমোগ্লোবিন ও প্লেটলেট কমে যাওয়া, ডব্লিউবিসি বেড়ে যাওয়া অথবা হিমোগ্লোবিন, প্লেটলেট ও ডব্লিউবিসি কমে যাওয়া। বোনম্যারো টেস্ট, ফ্লোসাইটোমেট্রি, সাইটোজেনেটিক স্টাডি করে ব্লাড ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়ে থাকে। কিছু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে গ্লান্ড বা টিস্যু বায়োপসি এবং পরবর্তী সময়ে ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি করা লাগে।
চিকিৎসা
১.সাধারণত কেমোথেরাপি দিয়ে ব্লাড ক্যানসারের চিকিৎসা করা হয়। কী ধরনের ওষুধ বা কেমোথেরাপি দিতে হবে এবং ফলাফল কী হবে, তা জানার জন্য লিউকেমিয়া বা লিম্ফোমাকে পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন উপভাগে ভাগ করা হয়।
২.অ্যাকিউট লিউকেমিয়া খুবই মারাত্মক। এর চিকিৎসা দ্রুত শুরু করাতে হয়।
৩.যে ধরনেরই অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া (এএলএল) হোক না কেন, চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি। শুধু কেমোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করালে দুই থেকে আড়াই বছর সময় লাগে।
৪.এম-৩ বা এপিএল নামক ব্লাড ক্যানসারকে পর্যায় বুঝে শুধু ওষুধ বা কেমোথেরাপি দিয়ে টানা ছয় মাস থেকে দুই বছর চিকিৎসা করলে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ৮০ ভাগের বেশি।
৫.কিছু ব্লাড ক্যানসারের জন্য বিএমটি বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ছাড়া কার্যকর চিকিৎসা নেই।
৬.ক্রনিক লিউকেমিয়ারও প্রকারভেদ আছে। চিকিৎসার ধরনও ভিন্ন ভিন্ন। ক্রনিক লিউকেমিয়ার রোগী সঠিক চিকিৎসা নিয়ে অনেক দিন ভালো থাকতে পারেন।
৭.মলিকিউলার টার্গেটেড থেরাপি আবিষ্কার হওয়ায় অনেক ক্যানসার সারানো সম্ভব। ক্রনিক মায়েলোয়েড লিউকেমিয়া (সিএমএল) এর মধ্যে অন্যতম।
৮.ব্লাড ক্যানসার মানেই মরণব্যাধি নয়। সঠিক সময়ে নির্ভুল রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা নিলে অনেক ব্লাড ক্যানসার ভালো হয় ও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
ব্লাড ক্যান্সারের ঝুঁকি
প্রায়ই দেখা গেছে যে এই ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি এর লক্ষণগুলি জানেন না এবং এই কারণে, তিনি এটি সঠিকভাবে করতে সক্ষম হন না এবং তারপরে তাকে এই 5টি ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হয়-
হাত-পা ফুলে যাওয়া– এটি ব্লাড ক্যান্সারের প্রধান ঝুঁকি, যেখানে একজন ব্যক্তির হাত ও পায়ে ফোলাভাব দেখা দেয়। মূলত হাত-পায়ে রক্তপ্রবাহ না পৌঁছায় বলেই এমনটা হয়। তবে হাত ও পায়ের সাহায্যে এই ফোলা কমানো যায়।
অনাক্রম্যতার দুর্বলতা – উপরে বর্ণিত হিসাবে, ব্লাড ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ার কারণে হয়। এ কারণে দীর্ঘদিন চিকিৎসা না করলে এই সমস্যা অনেক বেড়ে যেতে পারে।
দুর্বলতা অনুভব করা– যেহেতু ব্লাড ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে এবং এর কারণে ব্যক্তি দুর্বলতা অনুভব করে।
বেডিং– ব্লাড ক্যানসার যখন শেষ ও চতুর্থ পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন তার শরীরের গঠন ভেঙে যায় এবং ব্যক্তি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। বেডিড্রিন এমন একটি পরিস্থিতিকে বোঝায় যখন একজন ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে শয্যাশায়ী হয় এবং ছোট ছোট কাজ করার জন্য অন্য লোকের সাহায্যের প্রয়োজন হয়।
মৃত্যু – এটি ব্লাড ক্যান্সারের চূড়ান্ত ঝুঁকি, যাতে একজন ব্যক্তি মারা যায়। যাইহোক, এটি খুব কম ক্ষেত্রেই ঘটে, তবে এখনও, লোকেদের এটি উপেক্ষা করা উচিত নয়।
বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসার প্রতিবন্ধকতা
* ক্যান্সার চিকিৎসার পূর্ব শর্ত হলো সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়। কারণ ব্লাড ক্যান্সারের অনেক উপভাগ আছে এবং এই উপভাগের চিকিৎসা ও ফলাফল ভিন্ন ভিন্ন। আমাদের গুণগত মানের উন্নত ল্যাব ও দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে।
* ক্যান্সার চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। অনেকের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ের পরে চিকিৎসা নেওয়ার মতো সামর্থ্য থাকে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্যান্সার রোগীর আর্থিক সহায়তা বাড়ানো দরকার।
* টিম ওয়ার্ক: দক্ষ টেকনোলজিস্ট, নার্স ও চিকিৎসক ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য অত্যাবশ্যক। তাই দক্ষ জনবলের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ভালো টিম ওয়ার্ক বাড়াতে হবে। চিকিৎসার জন্য শুধু চিকিৎসক একমাত্র উপাদান নয়।
* ওয়ান স্টপ সার্ভিস: বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসার ওয়ানস্টপ সার্ভিস নেই। সব পরীক্ষা ও চিকিৎসা একই হাসপাতালে করা যায় না। পরীক্ষা করাতে হয় দুই-তিন জায়গায় (দেশে-বিদেশে), কেমোথেরাপি এক জায়গায় তো রেডিওথেরাপি অন্য জায়গায়।