গর্ভের পানি বা এমনিওটিক ফ্লুইড কমে যাওয়ার লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা
সাধারণত অ্যামনিওটিক মেমব্রেন রাপচার বা পানি ভাঙার ঘটনা হয় লেবার পেইন ওঠার পর। কোনো কারণে যদি এর আগেই মেমব্রেন রাপচার হয়ে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড বা গর্ভস্থ পানি বের হয়ে যায়, তবে তাকে প্রিম্যাচিওর রাপচার অব মেমব্রেন বলে। এটি গর্ভাবস্থায় একটি সাধারণ সমস্যা, যা নিয়ে অনেকে শঙ্কিত থাকেন।
এমনিওটিক ফ্লুইড কি?
এমনিওটিক ফ্লুইড হোল গর্ভের শিশুর লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম এর একটি অংশ। গর্ভধারণের সাধারণত ১২ দিনের মদ্ধেই এমনিওটিক থলি গঠিত হওয়ার সাথে সাথেই এমনিওটিক ফ্লুইড উৎপন্ন হওয়া শুরু হয়। প্রথম দিকে এটি পানি দ্বারা তৈরি হয়া যা মায়ের শরীর সরবরাহ করে। গর্ভের শিশুটি মায়ের পেটে যে থলিতে থাকে তা এমনিওটিক ফ্লুইড দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে। এই ফ্লুইড শিশুর গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।
পানি কেন ভাঙে বা ওয়াটার ব্রেক কেন হয়?
সোজা ভাষায় বললে, গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন বাচ্চা পানি ভর্তি একটা থলের মধ্যে বড় হয়। এই ব্যাগের পোশাকি নাম অ্যামনিওটিক স্যাক। আর এই ফ্লুয়িডকে বলে অ্যামনিওটিক ফ্লুয়িড। প্রসবের সময় হয়ে এলে এই স্যাক ভেঙে যায় এবং এর ভেতরের সমস্ত তরল হবু মায়ের ভ্যাজাইনা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। একেই ওয়াটার ব্রেক হওয়া বা চলতি কথায় “পানি ভাঙা” বলে।
গর্ভের পানি কমে যাওয়ার লক্ষণ
* সাধারণত ৩৪-৩৬ সপ্তাহের পর থেকে প্রসবের আগ পর্যন্ত এমনিওটিক ফ্লুইডের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে যেতে পারে
* প্রসবের সময়ের আগেই যোনিপথে ফোঁটায় ফোঁটায় অথবা তার থেকে বেশি পরিমাণে পানির মত তরল নির্গত হয়
* গর্ভধারণের সময়ের তুলনায় পেটের আকার ছোট থাকলে বা বাচ্চার নড়াচড়া কম হলে এ ফ্লুইড কম হতে পারে
* গর্ভধারণের সাথে মায়ের ওজন বৃদ্ধির হার কম হলে
* গর্ভস্থ শিশুর হার্ট রেট হঠাৎ কমে গেলে
গর্ভাবস্থায় পেটে পানি কমে যাওয়ার কারণ কি?
গর্ভাবস্তায় পেটে পানি (এমনিওটিক ফ্লুয়িড) কমে যাওয়ার কারণ নির্দিষ্ট করে সবসময় বলা যায়না। এটা খুব বেশী হয় তৃতীয় ট্রাইমেস্টারের শেষের দিকে বিশেষ করে যখন প্রসবের সময় পেড়িয়ে যায়।
* এমনিওটিক থলিতে কোন কারণে ছিদ্র হলে গর্ভাবস্থায় পেটে পানি কমে যায়।
* গর্ভফুলে কোন সমস্যা হলে গর্ভাবস্থায় পেটে পানি কমে যায়।
*মায়ের কোন অসুখ থাকলে গর্ভাবস্থায় পেটে পানি কমে যায়।
* গর্ভে একের অধিক বাচ্চা থাকলে গর্ভাবস্থায় পেটে পানি কমে যায়।
* ভ্রুনের কোন অস্বাভাবিকতা থাকলে গর্ভাবস্থায় পেটে পানি কমে যায়।
ওয়াটার ব্রেক হলে সেটা একজন গর্ভবতী বুঝবেন কীভাবে?
* হঠাৎ ভ্যাজাইনা থেকে সরু স্রোতের মতো বর্ণহীন তরল বেরিয়ে আসে।
* অস্বাভাবিক ভাবে প্যান্ট ভিজে যাওয়া।
* তরলটির গন্ধ কিন্তু ইউরিনের মতো একেবারেই হয় না। বরং, সেটা একটু মিষ্টি গন্ধযুক্ত হতে পারে।
* ইউরিন হওয়ার সময় আমরা কিন্তু চাইলে তার বেগ কমাতে পারি, কিন্তু এই তরল যোনিপথ দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে এবং যখন বের হয় তখন এর বেগ কন্ট্রোল করা যায় না।
সময়ের আগেই পানি ভাঙলে কি করবেন?
যদি পানি ভাঙ্গার বিষয়টি সময়ের আগেই ঘটে যায় তাহলে একে বলে প্রিম্যাচিউর রাপচার অফ মেমব্রেন (PROM)। এটি সাধারণত ৮-১০ ভাগ নারীর ক্ষেত্রে ঘটে এবং ঘটলে প্রেগনেন্সির ৩৭তম সপ্তাহের ভেতরই ঘটে। এর কারণ গুলো হল:
* পূর্ববর্তী গর্ভাবস্থায় PROM এর ইতিহাস
* গর্ভাবস্থায় ধূমপান বা কোন ড্রাগ নেয়া
* জরায়ুর ছোট দৈর্ঘ্য
* জরায়ুর ইনফেকশন
* পুষ্টির অভাব
* কম ওজন
* ভ্রূণের মেমব্রেন বা ঝিল্লিতে প্রদাহ
* দ্বিতীয় বা তৃতীয় ট্রাইমেস্টারের সময় যোনিতে রক্তপাত
* গনোরিয়া, ক্লেমাইডিয়া সহ বিভিন্ন যৌনরোগ
* অপর্যাপ্ত বিশ্রাম ও যত্ন।
গবেষণায় দেখা গেছে যাদের সময়ের আগেই পানি ভেঙে গিয়েছে (অর্থাৎ PROM), তাদের শতকরা ২৮ ভাগই সি-সেকশন এর মধ্য দিয়ে গেছে। তাদের ক্ষেত্রে হয় ইন্ডাকশন কাজে লাগেনি, বা মা ও শিশু ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া PROM এর পর ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে বাচ্চার মৃত্যুও হতে পারে।
প্রতিকার ও চিকিৎসা
১) সাধারণত গর্ভাবস্থায় পানি কমে যাওয়া রোধ করার কোনো উপায় নেই, তবে নিয়মিত চেকআপ এ থাকলে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মত চললে যে কোনোরকম দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলা যায়।
২) গর্ভাবস্থায় পানি কমে যাওয়া বা পানি ভাঙার চিকিৎসা গর্ভাবস্থার পর্যায়ের উপর নির্ভর করে। যদি ৩৭ সপ্তাহ সম্পূর্ণ হওয়ার পর পানি ভাঙা শুরু হয় তাহলে শিশুর নিরাপত্তার খাতিরে অনেক সময় চিকিৎসক ডেলিভারি করিয়ে ফেলার পরামর্শ দেন।
৩) ২৪ সপ্তাহের আগে পানি ভাঙা শুরু হলে সেটি শিশুর জন্য খুব ঝুঁকির হয়ে দাঁড়ায়। সে ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ক্লোজ মনিটরিং এ থাকতে হয়।
৪) ২৪ থেকে ৩৪ সপ্তাহের মধ্যে পানি ভেঙে গেলে অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়। স্টেরয়েড শিশুর ফুসফুস বিকাশে সাহায্য করে।
৫) ৩৪ সপ্তাহের পর পানি ভাঙা শুরু হলে গর্ভাবস্থা বিবেচনা করে যদি সম্ভব হয় মাকে সম্পূর্ণ বেড রেস্ট এ রেখে ৩৭ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করার চেষ্টা করা হয়। তারপর ডেলিভারি করা নিরাপদ কারণ ততদিনে শিশুর পৃথিবীতে টিকে থাকার মত বিকাশ হয়ে যায়।
৬) বর্তমানে বাংলাদেশে জরুরী কারণে ২৮ সপ্তাহের পর ডেলিভারি করেও শিশুকে বাঁচানো সম্ভব যদি তাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে ক্লোজ মনিটরিং এ রেখে চিকিৎসা দেওয়া যায়।
তথ্যসূত্র: মাতৃত্ব,সাজগোজ,