গর্ভাবস্থায় দাঁতের মাড়ি ফোলা ও রক্ত পড়ার কারণ
গর্ভাবস্থায় মুখ ও দাঁতের কিছু সমস্যা বেশি লক্ষ করা যায়। গর্ভধারণের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে কিছু স্বাস্থ্যগত বিষয়, যেমন চেকআপ ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া হয়। ঠিক তেমনিভাবে মুখের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতেও মুখের চেকআপ জরুরি।
গর্ভাবস্থায় শারীরিক ও হরমোনাল পরিবর্তন মুখ, দাঁত ও মাড়িকে প্রভাবিত করে। এ সময়ে শরীরে প্রজেস্টেরন ও ইস্ট্রোজেনের মতো কিছু হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। আবার এ সময় নারীর খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আসে। এদিকে গর্ভকালে নারীরা দাঁত ব্রাশ, ফ্লসিং আগের তুলনায় কমিয়ে দেন। কারও কারও ক্ষেত্রে বমি ভাব থাকায় ঠিকঠাক দাঁত ব্রাশও করতে পারেন না। এসব কারণে মুখের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে।
মাড়ি প্রদাহ বা মাড়ি ফোলা কী? এটি কীভাবে নির্ণয় করা যায়?
মাড়ি প্রদাহ বা মাড়ি ফোলা ব্যাপারটাকে ইনফ্লামেশন বললেই বুঝতে বেশি সুবিধা হয়। মাড়ি প্রদাহের মূল লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে মাড়ি ফুলে যাওয়া, ব্রাশ করতে গেলে রক্ত পড়া, কিছু খেতে গেলে রক্ত পড়া এবং মাড়ি থেকে পুঁজ বের হওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিলে বুঝতে হবে মাড়ি প্রদাহ হয়েছে।
এর উপসর্গ কী কী?
মাড়ি থেকে রক্ত পড়বে
মাড়ি লাল হয়ে ফুলে যাবে
ধরলেই ব্যথা করবে
পুঁজ বের হবে–এগুলোই হচ্ছে মূল উপসর্গ।
মাড়ি ফুলে যাওয়ার কারণ কী কী?
ভিটামিন ডি ও সি ডেফিসিয়েন্সি এবং প্রেগনেন্সির সময় প্রেগনেন্সি জিনজিভাইটিসের কারণে মাড়ি ফুলে যেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় মাড়ির সমস্যা হওয়ার কারণ
গর্ভাবস্থায় মাড়ির সমস্যা হওয়ার পেছনে কিছু কারণ থেকে থাকে। যেমন—
১. হরমোনের তারতম্য: গর্ভকালে আপনার শরীরে কিছু হরমোনের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। এর ফলে শরীরে নানান ধরনের পরিবর্তন হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো আপনার মুখের ভেতরের ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসা। একারণে দাঁতের মাড়িতে প্রদাহ হতে পারে এবং মাড়ি ফুলে যেতে পারে। এতে মাড়ি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দাঁত ও মাড়ির নানান ক্ষতি হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
২. খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন: গর্ভকালে আপনার চিনিযুক্ত খাবার ও শর্করা খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে দাঁতে প্ল্যাক হওয়া, দাঁত ক্ষয় ও ক্যাভিটি বা গর্ত তৈরির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৩. গর্ভাবস্থায় বমির প্রতিক্রিয়া: মর্নিং সিকনেস বা গর্ভাবস্থায় বমির সমস্যা হলে বমিতে থাকা এসিড দাঁতের ক্ষতি করতে পারে। এর প্রভাবে আপনার দাঁত ও মাড়িতে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
গর্ভের সন্তানের উপর প্রভাব
গবেষণায় গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের দাঁতের মাড়ির রোগের সাথে গর্ভের শিশুর অকাল প্রসব ও কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়ার যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে। তবে মায়ের দাঁত ও মাড়ির রোগ গর্ভের সন্তানকে কীভাবে প্রভাবিত করে সেই বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া প্রি-এক্লাম্পসিয়া নামক গর্ভকালীন মারাত্মক জটিলতার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়ার সাথেও গর্ভবতীর মাড়ির রোগের সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে। তবে এই বিষয়েও গবেষণার পরিমাণ অপর্যাপ্ত। সবমিলিয়ে আপনার মাড়ি অথবা দাঁতের রোগ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই শ্রেয়।
গর্ভাবস্থায় দাঁত ও মাড়ির যত্ন
খাবারের ছোটো ছোটো টুকরা দাঁতের ফাঁকে জমে থেকে অপরিচ্ছন্নতা তৈরি করে, যার প্রভাব আপনার দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্যের ওপর পড়তে পারে। তা ছাড়া গর্ভাবস্থায় অথবা এর আগেও আপনার দাঁত অথবা মাড়ির কোনো সমস্যা থাকতে পারে। গর্ভধারণের ফলে এসব সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে।
এসবের নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য আপনি কিছু ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করতে পারেন। যেমন—
১.লবঙ্গ
লবঙ্গ ঘরে থাকা সবচাইতে সহজলভ্য একটি বস্তু, যা দাঁতের ব্যাথা ও মাড়ির সমস্যা দূর করতে একটি কার্যকর প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপ্টিক। গোটা লবঙ্গ বা লবঙ্গ তেল অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাথা ও রক্ত ক্ষরণ রোধ করতে সাহায্য করে। লবঙ্গে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান মাড়ির রক্ত ক্ষরণ দ্রুত বন্ধ করে এবং দাঁতের ব্যাকটেরিয়া দূর করে। দ্রুত উপশম পেতে লবঙ্গকে চিবান অথবা দাঁত এবং মাড়িতে তুলোর সাহায্যে ব্যাথা জায়গাগুলিতে লবঙ্গ তেল ঘষুন।
২.হলুদ
হলুদে যেহেতু অনেকগুলি থেরাপিউটিক বৈশিষ্ট্য থাকে,এটিকে অন্যান্য উপাদানের সাথে সমন্বিত করে দাঁতের সমস্যার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।হলুদে আছে কারকিউমিন, যা প্রদাহ এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে উচ্চ মাত্রায় কার্যকর।আপনি 1 চা-চাম হলুদ গুঁড়োর সাথে 1/2 চা-চামচ করে সরষের তেল এবং নুন মিশিয়ে একটা পেষ্ট বানিয়ে নিতে পারেন।এবার সর্বোত্তম ফল লাভের জন্য আপনি এই পেষ্টটি ব্যবহার করে আপনার মাড়িতে ধীর প্রক্রিয়ায় মালিশ করুন কমপক্ষে দিনে দুবার।হলুদে কারকিউমিনের উপস্থিতির কারণে মুখে ক্যান্সারজনিত বৃদ্ধি কমাতেও এটি বিশেষভাবে কার্যকর।
অ্যালোভেরার নানা ঔষধি গুণাগুণের কথা আমরা সকলেই জানি। এই বহু গুণী শক্তিশালী উদ্ভিদটি গর্ভাবস্থায় দাঁতের ব্যথা ও রক্ত ক্ষরণের প্রতিকারে সাহায্য করে। অ্যালোভেরার রস বা জেল ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। অ্যালোভেরা পাতা থেকে জেল বের করে মাড়িতে ঘষে নিন এবং তা ৩ থেকে ৫ মিনিট মুখে রাখার পর কুলি করে ধুয়ে ফেলুন। দেখবেন মাড়ি ফুলে যাওয়া এবং রক্ত ক্ষরণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
৪.দুধ
প্রতিদিনের এই পানীয়ে আছে উচ্চ পরিমাণে ভিটামিন K এবং ক্যালসিয়াম।এগুলি মাড়িকে শক্তিশালী করতে এবং সেখান থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতেও সাহায্য করে।দুধ মাড়ির প্রদাহকে প্রশমিত করে এবং রক্তক্ষরণের কারণে হওয়া অস্বস্তি হ্রাসের জন্য অত্যন্ত সহায়ক।এক কাপ করে ঈষদুষ্ণ দুধ প্রতিদিন এক অথবা দুবার পান করুন অথবা যখন আপনার মাড়ি থেকে রক্ত ক্ষরণ হয়।প্রতিবার দুধ পানের পর আপনার দাঁত ব্রাশ করা নিশ্চিত করুন,অন্যথায় এটি থেকে দাঁতের ওপর জন্মানো মুখগহ্বরের ব্যক্টেরিয়া তৈরী হতে পারে।আরও ভাল প্রভাব পেতে সম্ভব হলে দুধের সাথে সামান্য পরিমাণ হলুদ গুঁড়ো যোগ করুন।
৫.নিম পাতা
মাড়ির প্রদাহজনিত সমস্যা ও রক্ত ক্ষরণের চিকিৎসায় নিম পাতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। নিম পাতার অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্যগুলি দাঁতের ভিতরে জন্মানো ব্যাক্টেরিয়া প্রতিরোধ করে এবং মাড়ি থেকে রক্ত ক্ষরণও বন্ধ করতে সাহায্য করে। দাঁত বা মাড়ির এই জাতীয় সমস্যা থেকে দূরে থাকতে প্রতিদিন খাবার পর দুটি বা তিনটি করে নিম পাতা চিবোতে পারেন। এর রস মাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করে। কেনা মাউথ ওয়াস ব্যবহার না করে বাড়িতেই বানিয়ে ফেলুন নিমের একটি মাউথ ওয়াস। রোজ রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অবশ্যই ব্যবহার করুন এটি। ফল পাবেন মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই।
৬.বেকিং সোডা
প্রতি রান্নাঘরে ব্যবহৃত অত্যন্ত সাধারণ এই উপকরণটি বিভিন্ন অ্যাসিডের এক বিস্ময়কর প্রতিরোধক,যেগুলির ফলে মুখের মধ্যে মাড়ি সংক্রমণ ঘটে।এটির ব্যবহারটিও খুবই সহজ-আপনাকে যা করতে হবে তা হল আপনার ভিজে টুথ ব্রাশটিকে সামান্য বেকিং সোডার মধ্যে বুলিয়ে নিন এবং সেটি দিয়ে আপনার দাঁত ব্রাশ করুন।বিকল্প হিসেবে,আপনি আবার আপনার টুথপেষ্টের সাথেও বেকিং সোডা মিশিয়ে নিতে পারেন, তবে বেকিং সোডা এবং জল দিয়ে আপনার মুখ ভাল করে কুলকুচি করে ধুয়ে নেওয়ার জন্য এবং সেটি দিয়ে আপনার দাঁত ব্রাশ করার জন্য উচ্চ মাত্রায় সুপারিশ করা হয়।সর্বোত্তম ফলাফলের জন্য খাবার গ্রহণের পর এটি দিনে 2-3 বার করে করুন।
বেদানা স্বাস্থ্য রক্ষায় এবং শক্তিশালী অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্যের জন্য খুব পরিচিত। বেদানার রস দাঁতের ওপর জন্মানো ব্যাক্টেরিয়া বা ডেন্টাল প্ল্যাকের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং দাঁত ও মাড়িকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। গর্ভাবস্থায় বেদানার রস পান করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এই রস ব্লিডিং পার গামের মত রোগকে সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। যেকোনও সময় বা খাওয়ার পর বেদানার রস নিয়ে কুলকুচি করে পরিষ্কারভাবে মুখ ধুয়ে ফেলুন। খেয়াল রাখবেন, এই রসটি যেন তাজা থাকে এবং এটির সাথে যেন কোনও কিছুই যোগ না করা হয়।
৮.চা গাছের তেল বা টি ট্রী অয়েল
দাঁতের সমস্যার জন্য অন্যতম নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা হিসেবে প্রসিদ্ধ,চা গাছের তেল গর্ভাবস্থায় ঘটে থাকা মাড়ি এবং দাঁতের সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করা যেতে পারে।এটির মধ্যে আছে প্রদাহ বিরোধী এবং জীবাণু বিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলি,যা এটিকে জনপ্রিয় পছন্দের তালিকায় উত্থিত করেছে।যদি আপনার মাড়ির প্রদাহ থাকে,যে অণুজীবগুলির কারণে আপনি সংক্রমিত সেগুলির বিনাশ করতে আপনি জল এবং চা গাছের তেল দিয়ে কুলকুচি করে মুখ দিয়ে নিতে পারেন।ভাল মানের একটি টি ট্রী অয়েল কিনুন এবং এই তেলের থেকে চার ফোঁটা নিয়ে প্রায় 90 মলিলিটার জলের সাথে মেশান।সেরা ফলার্জনের জন্য এই দ্রবণটি দিয়ে মুখ কুলকুচি করে ধুয়ে নিন।
৯.রসুন
গর্ভাবস্থায়,পেইনকিলার এবং অ্যান্টিবায়টিকগুলির থেকে দূরে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রসুন নিজে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য অত্যন্ত কার্যকর প্রতিকারক হিসেবে প্রমাণিত।এই প্রাচীন প্রতিকারটি ব্যবহার করা খুব সহজ।এক কোঁয়া রসুনের খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে সেটিকে সরাসরি হয় চিবিয়ে নিন অথবা প্রভাবিত এলাকার উপরে সেটিকে প্রয়োগ করুন।রসুনে অ্যালিসিন নামক প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক থাকায়,এটি সংক্রামিত এলাকায় ব্যাকটেরিয়াগুলিকে মেরে ফেলে,যা যন্ত্রণা কমায়।এটি তৎক্ষণাৎ আপনার দাঁত ব্যথা কমাবে এবং কোনওরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই দ্রুত উপশম দেবে।
১০.মধু
মধুতে থাকা অ্যান্টিসেপটিক ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার সমস্যাকে সমাধান করতে সাহায্য করে। রোজ যেকোনও সময় আঙুলের ডগায় মধু নিয়ে তা মাড়ির ক্ষত স্থানে হালকা মালিশ করলে উপকার পাবেন। তবে খেয়াল রাখবেন, মধু যেন দাঁতে না লাগে। কারণ, এতে ক্যাভিটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
গর্ভাবস্থায় চিকিৎসা কী?
এ ক্ষেত্রে গাইনি ডাক্তারের উচিত পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম দেওয়া ও রোগীকে তার মুখ ভালোভাবে পরিষ্কার রাখার পরামর্শ দেওয়া। যাতে মাড়িটা ফুললেও ক্ষতি করতে না পারে। এ ছাড়া ক্যালসিয়ামের জন্য প্রতিদিন এক লিটার পরিমাণ দুধ খেতে হবে। পেয়ারার পাতা ও নিমপাতা সেদ্ধ করে কুলি করার মতো গ্রাম্য চিকিৎসাও কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেশ উপকারী।