আক্কেল দাঁত বা উইশডম টিথ আসলে তিন নম্বর কশের দাঁত। আমাদের মুখে ওপরে ও নিচে এবং ডান ও বাঁ দিকে মিলে মোট ৪টি অংশ। এক একটি অংশে মোট ৮টি করে দাঁত থাকে। তার মানে ৪টি অংশে ৪ X ৮=৩২টি দাঁত। প্রতিটি অংশের একেবারে শেষ, অর্থাৎ ৮ নং দাঁতটিকে আক্কেল দাঁত বলে। আমাদের মোট ৪টি আক্কেল দাঁত থাকে।
আক্কেল দাঁত নাম কেন
এই দাঁতকে ‘আক্কেল’ দাঁত বলার কারণ সম্ভবত এটাই যে আক্কেল দাঁত অন্যান্য দাঁত ওঠার অনেক পরে ওঠে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, ততদিনে একটি শিশুর তুলনায় মানুষটির যথেষ্ট আক্কেল (!) হয়ে গেছে বা মানুষটি অনেকখানি প্রজ্ঞা (উইশডম) প্রাপ্ত হয়েছেন।
অনেকের ৩২টি দাঁত হয় না। মানুষের কটা দাঁত হয়, এই প্রশ্নে আমরা একবাক্যে বলে থাকি ৩২টা। তাই কি? নিজের চোয়ালে দাঁতের সংখ্যা গুনে দেখুন, এই অঙ্ক নাও মিলতে পারে। আজকাল আসলে অনেকেরই ৩২টি দাঁত হয়না।
এই বিষয়টির সঙ্গে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ যখন কাঁচা মাংস ও গাছপালা চিবিয়ে জীবন ধারণ করত, তখন বেশি দাঁতওয়ালা মস্ত বড় চোয়ালের প্রয়োজন হয়ে পড়ত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে সব কিছুর সঙ্গে মানুষের শরীরেরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তার চোয়াল ছোট হয়ে গেছে। একই সঙ্গে দাঁতের সংখ্যাও কমেছে। তাই আজকাল কারও কারও ৩২টা দাঁত হয় না, হয় ২৮টা। একটু অন্য ভাবে ভেবে বলা যায় যে, এই সব মানুষ সম্ভবত বিবর্তনের বিচারে আক্কেল দাঁতওয়ালা ৩২টি দাঁতের অন্য মানুষদের তুলনায় এক কদম এগিয়ে আছেন।
সমস্যা: সাধারণত মানুষের ১৮ বছর বয়স নাগাদ আক্কেল দাঁত মাড়ি ফুঁড়ে বেরতে শুরু করে। এখন বেরোতে গিয়ে কোনও কারণে সেই দাঁত আটকে গেলেই আক্কেল দাঁতের সমস্যা শুরু হয়ে যায়। অন্য দাঁতের ক্ষেত্রে না হলেও আক্কেল দাঁতের ক্ষেত্রে এই ধরনের সমস্যা হয়। আগেই বলেছি, বিবর্তনের কারণে আমাদের চোয়াল আগের চেয়ে ছোট হয়ে গেছে। এই ছোট হয়ে আসা চোয়ালে ঠিকমতো স্থান সঙ্কুলান না হলে দাঁতগুলি নিজেদের মধ্যে গুঁতোগুঁতি করে গোলমাল পাকায়। অনেক সময়েই এরা তাই আর কখনও পুরোপুরি ভাবে না বেরিয়ে আটকে যায়। এর থেকে তো অন্য সমস্যা হতে পারে। মাঝে মাঝে আধ-বেরনো ক্রাউন অর্থাৎ, শিকড়ের ওপরের ‘এনামেল’-এর ঢাকা অংশের চারপাশ ঘিরে থাকা মাংসে সংক্রমণ শুরু হয়ে যায়। জায়গাটা ফুলে উঠলেই উল্টো পাটির দাঁত সেই ফোলা মাংসে বারে বারে কামড় দিয়ে ফেলে। তখন ঘটনাটি আরও জটিল এবং যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। সমস্যার শুরুতে অল্প অল্প হলেও পরের দিকে চোয়ালে ভীষণ ব্যথা হয়। তখন খেতে অসুবিধে হয়, কথা বলতে গেলেও ব্যথা লাগে। গাল-গলা ফুলে ওঠে। অনেক সময় ব্যথার চোটে জ্বরও চলে আসে।
জটিলতা:
আক্কেল দাঁতের বিষয়টাকে যত সহজ বলে মনে করা হয়, বিষয়টা ঠিক অতটা সোজাসাপটা নয়। ১৮-১৯ বছরের মধ্যে পুরো দাঁত বেরিয়ে আসতে না পারলে অনেকের আক্কেল দাঁতই আর কখনও পুরোপুরি বেরতে পারে না। আর ক্রাউনের একটুও যদি মাড়ির নিচে থেকে যায়, তাহলে গোলমাল পাকানোর জন্য সেটুকুই যথেষ্ট।মাড়িতে একটু কেটে দিয়ে এর চিকিত্সা হয় না
কারণ ওটা সত্যিকারের চিকিত্সা নয়। বলা যেতে পারে, ওটা হল আধা চিকিত্সা বা গোঁজামিল। যে আক্কেল দাঁত সত্যি সত্যিই আটকে গেছে, তাকে কখনই ওভাবে বের করা যাবে না, বিশেষ করে ১৮-১৯ বছর পেরিয়ে গেলে। মাড়ি কেটে চিকিত্সা দু’টি ক্ষেত্রের যে কোনও একটির কারণে করা হয়। এক, আক্কেল দাঁত তোলার ক্ষেত্রে রোগীর প্রবল অনীহা এবং দুই, চিকিত্সারত ডাক্তারের অক্ষমতা।
মনে রাখবেন, আক্কেল দাঁত নিখুঁত ভাবে বের করে আনা একটা বেশ বড় ঝুঁকির অস্ত্রোপচার। একটা বেয়াড়া আক্কেল দাঁত মস্ত বড় ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জেনকেও কঠিন বিপদে ফেলে দিতে পারে। আসলে আক্কেল দাঁত তোলা মানে কোনও মতেই দাঁতের খানিকটা বার করে ফেলে দেওয়া নয়। দক্ষতা হল তখনই যখন চারপাশের সমস্ত পেশি ও কলাকে সযত্নে বাঁচিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়।
নিচের পাটির আক্কেল দাঁতের খুব কাছে থাকে দুটো স্নায়ু বা নার্ভ। এদের একটা ঠোঁটের আর একটা জিভের অনুভুতি দেয়। এই নার্ভ দুটিকে আঘাত করলে বা ছিঁড়ে ফেললে ঠোঁট, জিভ ও মাড়ি সারা জীবনের জন্য অসাড় হয়ে যেতে পারে। বুঝতেই পারছেন সেটা কতটা অস্বস্তিকর এবং অসুবিধেজনক পরিস্থিতি। তাছাড়া ওপরের আক্কেল দাঁতের ঠিক ওপরেই থাকে সাইনাস। চিকিত্সকের ভুলে সাইনাস ফুটো হয়ে গেলে মুখের জল নাকে এসে পড়তে পারে।
আক্কেল দাঁত তুললে চোখ বা ব্রেনের ক্ষতি হয়:
এ সব কথা সম্পূর্ণ ভুল। শুধু তাই-ই নয়, এমন কোনও কিছু হওয়ার দূরতম সম্ভাবনার কথাও কোথাও উল্লেখ নেই। চিকিত্সাশাস্ত্রের কোনও বইতে এ ধরনের ঘটনার কোনও কথাই পাবেন না। তাই পুরোটাই পাগলের প্রলাপ বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে তৈরি করা। গোটা বিষয়টি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, দেশের সার্বিক শিক্ষার মান আজও ঠিক কোথায় অবস্থান করছে। তবে শুধু শিক্ষার প্রসার ঘটালেই চলবে না। মানুষকে প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্ক ও সচেতন করে তুলতে হবে।
আক্কেল দাঁত তোলার ক্ষেত্রে অসুবিধে হওয়ার কারণ
অধিকাংশ ক্ষেত্রে আক্কেল দাঁত তোলাটা ঠিক অন্যান্য দাঁত তোলার মতো নয়। তাই চেয়ারে বসিয়ে ইঞ্জেকশন দিয়ে পট্ করে সাঁড়াশির সাহায্যে আক্কেল দাঁত তুলে ফেলা হয় না। এর জন্য রোগীকে অজ্ঞান করার প্রয়োজন হয়। প্রথমে মাড়ির মাংসে অল্প ফাঁক করে একটা ছোট যন্ত্র দিয়ে তলার হাড় সামান্য সরিয়ে নেওয়া হয়। তার পরে সেই একই যন্ত্র দিয়ে দাঁতগুলো ছোট ছোট টুকরো করে কেটে কেটে তুলে ফেলা হয়। তা ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আজকাল এক সঙ্গে চারটে আক্কেল দাঁতই তুলে ফেলা হয়। এই ধরনের অস্ত্রোপচারের জন্যই তৈরি করা বিভিন্ন সুক্ষ, অত্যাধুনিক ও দ্রুত যন্ত্র এখন কলকাতাতেই পাওয়া যায় এবং ব্যবহারও করা হয়। দক্ষ ও উপযুক্ত সার্জেনের হাতে অস্ত্রোপচারের জন্য ৪০ মিনিট থেকে বড়জোর ১ ঘন্টা সময় লাগে। সকালবেলা খালি পেটে ভর্তি হয়ে পরদিন সকালে বাড়ি ফেরা যায়। সাধারণত দুপুরের দিকে অস্ত্রোপচার করা হয়।
আক্কেল দাঁত না তুললে যে ধরনের অসুবিধে হতে পারে
দাঁতে দাঁত চেপে প্রচণ্ড ব্যথা সহ্য করতে হতে পারে
আক্কেল দাঁতের সামনের দাঁত ক্ষয় হয়ে নষ্ট হতে পারে
চোয়াল সন্ধি বা ‘জ’ জয়েন্ট-এ আর্থারাইটিস-এর মতো বিরক্তিকর যন্ত্রণা শুরু হতে পারে। এ যন্ত্রণা একবার শুরু হলে পুরোপুরি সারিয়ে নেওয়া খুব কঠিন
হাড়ের নিচে চাপা থাকা আক্কেল দাঁত থেকে সিস্ট হয়ে গিয়ে চোয়াল ভেঙে যেতে পারে
ক্রমাগত কামড় পড়তে পড়তে, গাল কাটতে কাটতে টিস্যুর চরিত্র বদলাতে শুরু করতে পারে। এর পর ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে
সাধারণ আক্কেল দাঁতের সংক্রমণ পুষতে পুষতে অ্যাবসেস/ সেলুলাইটিস শুরু হতে পারে।