
ভারতের আলোচিত দশ নিষিদ্ধ সিনেমা-Top 10 Banned Movies in India
কখনও যৌনতা, কখনও সাম্প্রদায়িকতা, কখনোবা জঙ্গিবাদ- ভারতীয় সেলুলয়েডে বিতর্কীত বিষয় নিয়ে সিনেমা তৈরি হয়েছে অনেক। তবে, প্রতিক্রিয়াশীলদের অসহিষ্ণুতা বরাবরই এসব সিনেমাকে নিয়ে গেছে বিতর্কের কেন্দ্রে। আর সেকারণেই নানা সময়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অনেক সিনেমাও সেন্সরের বাধা অতিক্রম করে দেখতে পায়নি মুক্তির আলো। সেরকমই ভারতীয় দশ নিষিদ্ধ সিনেমা নিয়ে এবারের আয়োজন।
১. ব্যান্ডিট কুইন (১৯৯৪)
উচ্ছ্বল হাসি-খুশি পারিবারিক ড্রামা কিংবা নায়ক-নায়িকার গভীর প্রেম দর্শন ফর্মুলায় বিশ্বাসী বলিউড জগতের জন্য 'ব্যান্ডিট কুইন' সিনেমা ছিল এক অন্ধকার জগতের অনুপ্রবেশ। সোজা ভাষায় অপ্রীতিকর, অস্বস্তিকর সব ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ১৯৯৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল ভারতের 'নারী রবিন হুড' খ্যাত ফুলন দেবীকে নিয়ে নির্মিত সিনেমা 'ব্যান্ডিট কুইন'।
ভারতের শেকড়ে মিশে থাকা জাত বিদ্বেষের নির্মম এক ফলাফল ছিলেন নিচু জাতে জন্ম নিয়ে ডাকাত বনে যাওয়া এই ফুলন দেবী। ধর্ষণ যন্ত্রণা কিংবা নগ্ন নির্যাতনের বাস্তব চিত্রগুলো সিনেমাটিকে নিয়ে গিয়েছিল দর্শকের সহ্য সীমার বাইরে। ভারতীয় সেন্সর বোর্ড কোনভাবেই রাজ শেখর নির্মিত এই সিনেমাটি ভারতে মুক্তি দিতে প্রস্তুত ছিলনা। ফুলন দেবীর চরিত্রে ছিলনা আহামরি কোন গুণ, রূপের চাকচিক্যও ছিল অনুপস্থিত। সমাজের অগ্রাহ্যতার শিকার এই নারী নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন 'অপ্রতিরোধ্য' হিসেবে। ফুলন দেবীর জীবনের ঘটনাগুলোর নির্মম চিত্র পর্দায় হজম করতে পারেননি কেউই, সিনেমাটির গায়ে লেগে গিয়েছিল 'নিষিদ্ধ'র তকমা।
২. ফায়ার (১৯৯৪)
ভারতীয় নাগরিক জীবনকে 'শিল্প' করে সেলুলয়েডে যদি কেউ ফ্রেমবদ্ধ করে থাকেন, তবে তিনি নির্মাতা দিপা মেহতা। আন্তর্জাতিক সিনেমা অঙ্গনের প্রতিথযশা এই নারী নির্মাতা সিনেমার ভাষা বারবার আঘাত করে ভারতের প্রচলিত সমাজ ব্যাবস্থাকে। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া 'ফায়ার' সিনেমাতে সমকামীতার মত 'বিতর্কিত' এক যৌন বাসনাকে তিনি টেনে এনেছিলেন সেলুলয়েডের পর্দায়।
সাংসারিক কোন্দল আর জটিলতার মধ্যেও একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের ভাবী-ননদ হয়ে উঠেছিল তাদের যৌন চাহিদার পরিপূরক হিসেবে। আন্তর্জাতিক সাফল্য, প্রশংসা- কোনটারই কমতি হয়নি মেহতার জন্য, ভারতীয় সিনেমার এক 'মাস্টারপিস' ধরা হয়ে থাকে শাবানা আজমি, নন্দিতা দাস অভিনীত এই সিনেমাটিকে।
তবে, সাধারণ ভারতীয় দর্শক বুঝতে ব্যার্থ হয়েছিলেন নির্মাতার প্রতিবাদী, প্রতীকী ভাষা। সিনেমাটির বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাঁধে রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল শিভ সেনাদের আক্রোশে। এমনকি নিজের জীবননাশের হুমকিও পেয়েছিলেন মেহতা। সেন্সর বোর্ডের সামনে সিনেমাটি নিষিদ্ধ করা ছাড়া ক্ষিপ্ত সমাজকে শান্ত করার আর কোন রাস্তা ছিলনা।
৩. কামা সুত্রা- এ টেল অফ লাভ (১৯৯৬)
যৌনতার মত স্পর্শকাতর এক বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলাটাকে উপমহাদেশে ধরা হয় একধরণের 'ট্যাবু' হিসেবে। আর তাই যৌনতা নির্ভর মীরা নায়ারের 'কামা সুত্রা- এ টেল অফ লাভ' মুক্তির পর বিতর্কের ফুলকি ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয়নি।
সপ্তদশ শতকের ভারতীয় পটভূমিতে এক সুদর্শন পুরুষের কামনায় দুই নারীর 'যৌন প্রতিযোগিতা'কে কেন্দ্র করে নির্মিত এই সিনেমা মুক্তিতে রীতিমত চোয়াল ঝুলে পড়েছিল সকলের! উত্তেজক নাচ গানের বালাই কিংবা তথাকথিত ন্যাকামি ছাড়াই সোজাসাপটা মানুষের আদিমতম চাহিদা যৌন আচরণের প্রকাশ সিনেমায় দেখানো হয়েছে ইন্দিরা ভার্মা এবং নাভিন অ্যান্ড্রুসের উন্মুক্ত যৌন দৃশ্যে।
একেবারে কোন রাখঢাক বিহীন নগ্নতা আর যৌনতার বহিঃপ্রকাশ সিনেমাটিকে চলতে দেয়নি ভারতীয় বক্স অফিসে। তবে, বরাবরই নিজের সিনেমাকে নান্দনিকতার ছোঁয়া উপহার দেওয়া মীরা নায়ার 'কামা সুত্রা- এ টেল অফ লাভ' দিয়েও পেয়েছেন অসংখ্য আন্তর্জাতিক সম্মাননা।
৪. দ্য পিঙ্ক মিরর (২০০৩)
যৌনতা, সমকামীতা, নগ্নতা- এই তিনটি স্পর্শকাতর বিষয়ের যেকোন একটির উপস্থিতিই যথেষ্ঠ ছিল সেন্সর বোর্ডের কাছে কোন সিনেমা নিষিদ্ধ করবার জন্য। সেখানে নির্মাতা শ্রীধার রাঙ্গায়ান হাত বাড়িয়েছিলেন আরও বিতর্কিত এক বিষয়ের দিকে, সেটা হলো লিঙ্গান্তরিতদের যৌন বাসনা।
'ট্রান্স-সেক্সুয়াল' বা পুরুষ থেকে লিঙ্গান্তরিত নারীরা ভারতে এখনও বঞ্চনার আর অবহেলার পাত্র। দরিদ্রতা আর যৌন নিপীড়নের দুর্দশার তীব্র যন্ত্রণা- সব মিলিয়ে রাঙ্গায়নের সিনেমাটি ছিল সাধারণ দর্শকের জন্য অস্বস্তিকর। অবহেলিত এই গোষ্ঠীর যৌন চাহিদাকে কতটা বিকৃত মনে করা হয়- 'দ্য পিঙ্ক মিরর' সবার সামনে বাস্তব আয়নাটিই হাজির করেছিল। একই পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট দুই লিঙ্গান্তরিত নারী, সঙ্গে যোগ হয় একজন সমকামীও! নাটকীয়তা, নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে যৌন বাসনার সংমিশ্রণে সিনেমাটি ভারতে বেশিদিন টিকতে পারেনি বটে, কিন্তু ৭০ টিরও বেশি আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রদর্শিত ও পুরষ্কারপ্রাপ্ত সিনেমাটি ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভূক্ত।
৫. ব্ল্যাক ফ্রাইডে (২০০৪)
আনুরাগ কাশ্যাপ নিঃসন্দেহে বলিউডের অন্যতম প্রতিভাবান নির্মাতা। তবে, বলিউড অঙ্গনে তার যাত্রা মোটেও শুভ হয়নি। ইসলামী জঙ্গিদের ঘটানো ১৯৯৩ সালের মুম্বাই বোমা হামলা নিয়ে নির্মিত 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' সিনেমাটি অনবদ্য এক মাস্টারপিস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু এতে দেখানো জঙ্গিবাদের ভীষণদর্শন চেহারা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেননা ভারতীয় দর্শক।
কাশ্যাপ অবশ্য একপাক্ষিক ভাবে সিনেমা দিয়ে কোন প্রপাগান্ডা ছড়াননি, অভিযুক্তদের প্রতি দুঃসহ অত্যাচার, জঙ্গিদের পারিবারিক দুর্দশার চিত্র আর বোমা হামলার নৃশংস চালচিত্র- প্যাকেজ আকারে তিনি তার সিনেমায় টানতে পেরেছিলেন ধর্মের নামে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ রূপটি। ধর্মীয় এবং গোষ্ঠী উষ্কানিমূলক দাঙ্গা বাঁধবার আশঙ্কায় সেন্সর বোর্ড সিনেমাটি নিষিদ্ধ করলেও ২০০৭ সালে সিনেমাটি আবারও মুক্তি পায়।
৬. পারজানিয়া (২০০৫)
২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা এখনও ভারতীয়দের জন্য হয়ে আছে দগদগে এক ক্ষত হিসেবে। ধর্মীয় রেষারেষি আর অন্তর্দ্বন্দ্বের ছোবলে গুজরাটে এই দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছিলেন দুই হাজারেরও বেশি মুসলমান।
নির্মাতা রাহুল ঢোলাকিয়া ২০০৫ সালে এসে এই দাঙ্গাকে ঘিরে নির্মাণ করেন 'পারজানিয়া', যার কেন্দ্রে ছিল গুজরাটে দাঙ্গাচলাকালে নিখোঁজ হয়ে পড়া এক ইরানি দম্পতির সন্তান। দাঙ্গার ফলে সৃষ্ট 'গণহত্যা'র বীভৎসতা এবং চরিত্রগুলোর মর্মান্তিক পরিণতি সিনেমাটিকে নিয়ে যায় নন্দনতত্ত্বের অনন্য মাত্রায়। ভারতের জাতীয় পুরস্কার জেতা এই সিনেমা অবশ্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায় গুজরাটের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য। ইতিহাসের কালো অধ্যায়কে ঢেকে প্রদেশের 'ইমেজ' রক্ষার্থে নেতাকর্মীরা তদবির করে সিনেমাটি বন্ধ করেন ভারতীয় সিনেমা হলে 'পারজানিয়া'র প্রদর্শনী।
৭. সিনস (২০০৫)
একজন ক্যাথলিক পাদ্রীর যৌনাচার যখন হয়ে উঠে একটি সিনেমার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু, সে সিনেমা ঘিরে ইন্ডাস্ট্রিতে হই চই হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। নিজের ধর্মীয় বিধিনিষেধ ভেঙ্গে মোহনীয় এক তরুণীর সঙ্গে যৌন মিলনে লিপ্ত কেরালার এক পাদ্রীকে নিয়ে নির্মাণ করা হয় 'সিনস' সিনেমাটি।
ভারতের খ্রিষ্টান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মাঝে তুমুল ক্ষোভ সৃষ্টি করে ভিনোদ পাণ্ডে নির্মিত এই সিনেমাটি। ক্যাথলিকদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অপবাদ এনে ক্যাথলিক সেকুলার ফোরাম সিনেমাটির বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করে জনস্বার্থ আইনের অধীনে। তবে সে মামলা ধোপে টেকেনি। কিন্তু, সিনেমাটিও চলেনি প্রেক্ষাগৃহে, সেন্সর বোর্ড এতটাও উদারমনা হয়ে সিনেমাটিকে ছাড় দিতে রাজি হয়নি।
৮. ওয়াটার (২০০৫)
তালিকায় আরেকবার ফিরে এলেন দিপা মেহতা। 'এলিমেন্টস ট্রিলজি'র শেষ সিনেমা 'ওয়াটার' ভারতের জন্য এনে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক সিনেমা অঙ্গনের মর্যাদাপূর্ণ অস্কার মঞ্চে সেরা বিদেশী সিনেমার মনোনয়ন। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনলেও সাম্প্রদায়িক সমাজে সিনেমাটি তুমুল রোষের সৃষ্টি করে।
চল্লিশের দশকে গান্ধীবাদের অন্ধ ভক্তকূল এবং তার বিপরীতে সামাজিকভাবে একঘরে করে রাখা হিন্দু বিধবাদের প্রতি নারীবিদ্বেষের চরম রূপ এর আগে কখনও সিনেমার পর্দায় উঠে আসেনি। আর তাই কিছু অন্ধ জাতবিদ্বেষী গোষ্ঠী ক্ষেপে ওঠে তাদের প্রথাকে সমালোচনা করায়। এমনকি ২০০০ সালে ভারানসিতে উগ্রপন্থীরা ভাংচুর করে যায় সিনেমা সেটেও। সেন্সর বোর্ড থেকে তাই আর ভারতে প্রদর্শনের অনুমতি পায়নি সিনেমাটি।
৯. গান্ডু (২০১০)
কৌশিক মুখার্জি ওরফে 'কিউ' এখন পর্যন্ত যে কয়টি সিনেমা নির্মাণ করেছেন, তার সবগুলোই হয়েছে বিতর্কের শিকার। 'গান্ডু' সিনেমার নামকরণেই কিউ হুঁশিয়ার বার্তা জানিয়েছেন- এই সিনেমা সাধারণ দর্শকের স্বাভাবিক চিন্তা ও বুদ্ধি-বৃত্তি নিয়ে তীব্রভাবে আঘাত হানবে।
আধুনিক কলকাতা শহরের এক বৈরী রূপান্তর- যেখানে তরুণ গান্ডুর যৌন চাহিদা আর আকাঙ্খাগুলো প্রকাশিত হয় বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনাবলীতে। বদলাতে থাকা সমাজের গণ্ডি বিক্ষিপ্তভাবে মানসিক এবং যৌন বিষণ্ণতায় ভোগা তরুণদের কিভাবে ছুঁড়ে ফেলছে অপ্রয়োজনীয় মনে করে, কলকাতার অন্ধকার গলি ঘুঁপচিতে র্যাপের তালে তালে সে উত্তরই যেন খোঁজে গান্ডু। সাদা-কালো ফ্রেমের সিনেমাটি ভারতীয় প্রথা ও সংস্কৃতির দিকেও আঙুল তোলে, একই সঙ্গে বিতর্ক সৃষ্টি করে ধর্মীয় প্রভাবের বিকৃত দিক নিয়ে। এরকম সিনেমার প্রদর্শনী করতে দিতে এতেবারেই সাহস করেনি ভারতীয় সেন্সর বোর্ড।
১০. ইনশাল্লাহ, ফুটবল (২০১০)
কাশ্মীরের বিশুদ্ধ বাতাসে এখনও ভাসে আতঙ্ক আর হাহাকারের টুকরো চিত্র, জঙ্গিবাদের নির্মম অভিশাপে নরকে পরিণত হয়েছে একসময়ের স্বর্গতুল্য পরিবেশ। আশভিন কুমার নিজের ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন নুয়ে পড়া এই প্রদেশের মাঝে আশার আলো খুঁজে পেতে। আফগান এক কিশোরকে খুঁজে পেয়েছিল তার ক্যামেরা, যার পায়ে রয়েছে অসাধারণ ফুটবল জাদু। কিন্তু সমস্যা একটাই, নব্বই এর দশকে হিজবুল মুজাহেদিন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ওই কিশোরের বাবার অতীতের কারণে কাশ্মীরের ঘেরাটোপেই আটকা পড়ে ছেলেটি, ফুটবল প্রতিভা আর দেখানো হয়না দেশের বাইরে গিয়ে।
তথ্যচিত্রটিতে এক কিশোরের আকুল আর্তি অশ্রুতই রয়ে যায়। জঙ্গিবাদ, কাশ্মীর সংক্রান্ত বিতর্কিত ইস্যুজনিত নানা কারণে ভারতীয় সরকারও যেন এরকম এক তথ্যচিত্রের প্রয়োজনীয়তা অবহেলা করেই দূর করে দেয়। ফলে, ভারতে নিষিদ্ধ হয় এই তথ্যচিত্র।
আপনার মতামত লিখুন