কোরাণের গল্প-Quraner Golpo , বন্দে আলী মিয়া
বই: কোরাণের গল্প
লেখক: বন্দে আলী মিয়া
প্রকাশনী: আহমদ পাবলিশিং হাউস
আদি মানব ও আজাযিল
পৃথিবী সৃষ্টির একেবারে প্রথশ দিকের কথা। তখন এখানে কোন জীবজন্তু, পশুপক্ষী বা কীটপতঙ্গ কিছুই ছিল না। সমস্ত দুনিয়ায় বাস করতো শুধু জিনেরা। তারা কেবলই নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি, মারামার নিয়েই থাকতো, ভুলেও কখনো আল্লাহ তা’লাকে স্মরণ করতো না। একদিন আজাযিল খোদার দরগায় আরজ (প্রার্থনা) করলোঃ হে প্রভু, আমাকে হুকুম দাও, আমি দুনিয়ায় গিয়ে জিনবংশ গারত (ধ্বংস) করে দুনিয়া থেকৈ পাপ দূর করে দেই। খোদা তার আরজ মঞ্জুর করলেন। আজাযিল চল্লিশ হাজার ফেরেশতাকে সঙ্গে নিয়ে নেমে এলো দুনিয়াতে। জিনদের সৎপথে আনবার জন্য অনক সদুপদেশ দিলো, কিন্তু তারা সে কথাতে একেবারে কর্ণপাতই করলো না। আজাযিল কি আর করে। তখন তাদের ধ্বংস করে বেহেশতে ফিরে গেলো। জিনের দল নিশ্চিহ্ন হওয়ায় দুনিয়া খালি পড়ে রইলো।
দোজখ (নরক) সব শুদ্ধ সাতটা। তার মধ্যে যে দোজখে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশী গোনাগারদের (পাপিদের) রাখা হয়, তার নাম সিজ্জীন। দুনিয়ার নিচের পাতাল এবং পাতালেরও অনেক নিচে সেই সিজ্জীন দোজখ। সেখানে দিনরাত শুধু দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। এত আগুন হবু সেখানে ভয়ঙ্কর অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে আজাযিলের জন্ম হয়। এই আজাযিল ভাল মানুষের দুশমন। দুনিয়ার মধ্যে তার মতো পাপি এখন আর কেউ নাই। সে শুধু নিজে পাপ করে না, প্রলোভন দ্বারা সকলকে পাপের পথে নিয়ে যায়। কিন্তু চিরকাল সে এমন ছিল না। তার মতো ধার্মিক এবং সৎ ফেরেশতারা অবধি হতে পারে নি। সত্যি সত্যি একদিন সে সকল ফেরেশতাদের সরদার ছিলো। খোদার নিকট তার মরতবা (মর্যাদা) অন্য সব ফেরেশতাদের চেয়ে অনেক বেশি ছিলো।
আজাযিল জন্মের পরে কিন্তু অন্য জানোয়ারদের মতো বৃথা সময় নষ্ট করেনি। সে খোদার এবাদতে মশগুল হয়ে পুরা একটি হাজার বছর কাটিয়ে দিয়েছিল। সমস্ত দোজখে তিল পরিমাণ জায়গাও ছিলো না যেখানে দাঁড়িয়ে খোদার উপাসনা করেনি।
খোদা খুশী হয়ে তাকে সিজ্জীন দোজখ থেকে পাতালে আসবার অনুমতি দিলেন। কিন্তু এখানে এসেও তার অহঙ্কারের লেশমাত্র দেখা দিলো না। বরষ্ন খোদাতা’লার এবাদতে আরো অধিক মনোযোগ প্রদান করলো। দেখতে দেখতে হাজারবছর কেটে গেলো এবং এমন এতটুকু জায়গা ফাঁক রইলো না, যেখানে দাঁড়িয়ে সে খোদার উপাসনা করলো না। এমনি করে আরো হাজার বছর কেটে গেলো। খোদা তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে দুনিয়ার উপরে নিয়ে এলেন। কিন্তু এত উন্নতি করেও সে খোদাকে ক্ষণকালের জন্যও ভুললো না। দিনরাত খোদার এবাদতে মশগুল হয়ে রইলো। করুনাময় খোদাতা’লা এবার তাকে প্রথম আসমানে তুলে নিলেন।
এমনিভাবে খোদাকে স্তবস্তূতিতে খুশী করে এক ধাপ এক ধাপ করে সে একেবারে আসমানে উঠতে লাগলো। এক এক আসমানে হাজার বছর করে সাত হাজার বছর ধরে আহার নেই, নিদ্রা নেই, দিনরাত কেবল রোজা আর নামাজ, নামাজ আর রোজা করে সে কাটালো। কোনো দিকে তার লক্ষ্য নেই, একম মনে এক প্রাণে খোদার উপাসনায় মশগুল হয়ে রইলো। খোদা তার ওপরে খুব খুশী হয়ে দোজখের না-পাক (অপবিত্র) জানোয়ারকে বেহেশতে আসবার অনুমতি দিলেন।
তাহলে তোমরা দেখছো, না-পাক জানোয়ারও নিজের সাধনার বলে মত উন্নতি করতে পারলো। কোথায় ছিলো আর কোথায় এলো। বেহেশতে এসে তার মনে এতটুকু দেমাগ বা এতটুকু অহঙ্কার দেখা দিল না। ফেরেশতাগণ যখন হাসিখুশী ও আমোদ-প্রমোদে রত থাকতো, তখন আজাযিল খোদার এবাদতে মগ্ন হয়ে থাকতো। মনে তার সুখ নেই –শান্তি নেই, চোখ দিয়ে কেবল ঝর-ঝর ধারায় পানি পড়তো। সে খোদার কাছে এই আরজ করতোঃ হে এলাহী আলমিন, তোমার এবাদত বন্দেগী কিছুই করতে পারলাম না। আমার গোনাহ মাফ করো। আমি বেহেশত চাই না –আমি চাই তোমাকে।
এইরূপ বেহেশতের আমোদ-আহলাদ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সমস্ত অগ্রাহ্য করে সে আরো হাজার বছর খোদার এবাদতে কাটিয়ে দিলো। এবার খোদাতা’লা তার ওপর অতিশয় সদয় হয়ে ফেরেশতাদের সরদার করে বেহেশতের খাজাঞ্চী করে দিলেন।
হলে কি হবে, তথাপি সে আল্লাহকে এক মুহুর্তের জন্যও ভুললো না। দিনরাত আল্লাহর নামে মশগুল হয়ে রইল, আর মাঝে মাঝে বেহেশতের মিনারের ওপরে উঠে আল্লাহতা’লার উপাসনার উপকারিতা সম্বন্ধে ফেরেশতাদের উপদেশ দিতে লাগলো। ফেরেশতাগণ তার জ্ঞান ও বুদ্ধি দেখে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলোঃ আজাযিল খোদার অতিশয় পিয়ারা (প্রিয়)। যদি আমরা খোদার কাছে কখনো কোন প্রকার বেয়াদবি করে ফেলি, তাহলে তার সুপারিশে আমরা বেঁচে যাবো। খোদা তার কতা না শুনে পারবেন না। এমনই করে ফেরেশতাদের মধ্যে মরতবা দিনে দিনে বেড়ে যেতে লাগলো। কিন্তু যার এত মরতবা তার আশা এখনো মিটলো না। এখনো খোদার এবাদত ছাড়া আর কোন দিক লক্ষ্য নেই। নিরালায় বসে কেবল খোদার যিকির করতে লাগলো। এইরূপে আরো হাজার বছর কেটে গেলো। সজল নয়নে কেবলই সে খোদার কাছে আরজ করতে লাগলোঃ হে রহমান, তুমি আমাকে দোজখ থেকে বেহেশতে এনেছো। এখন আমাকে মেহেরবানি করে একবার ‘লওহে মহফুযে’ তুলে নাও।
খোদা তার আরজ মঞ্জুর করলেন। সেখানে দিয়েও খোদার নাম ছাড়া অন্য কিছুই মনের মধ্যে সে স্থান দিলো না –দিনরাত খোদার উপাসনায় একেবারে ডুবে রইলো। একদিন সে দেখতে পেলো ‘লওহে-মহফুযের’ এক জায়গায় লেখা রয়েছে, “একজন ফেরেশতা ছয় লক্ষ বৎসর খোদার উপাসনা করিবার পরও যদি সে একটিবার খোদার আদেশ অমান্য করে, তা হলে সে চরম দুর্দশাপ্রাপ্ত হবে। তখন থেকে তার নাম হবে ইবলিশ”। আজাযিল ভয়ে কাঁপতে লাগলো! তার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো। কোন দিক তার হুঁশ নেই –ধীর স্থিরভাবে পাথরের মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খোদার দরগায় আরজ করতে লাগলো।
এমনিভাবে পাঁচ লক্ষ বছর কেটে গেলো। একদিন খোদা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন আজাযিল, এখানে কেউ যদি আমার একটি মাত্র আদেশ অমান্য করে, তবে তাকে কি শাস্তি দেওয়া উচিত?
আজাযিল প্রত্যুত্তর করলোঃ কেউ যদি আপনার আদেশ অমান্য করে, তাহলে তাকে আপনার দরবার থেকে চিরদিনের জন্য দূর করে দেওয়া উচিত।
খোদা বললেনঃ বেশ কথা। তুমি এখানে ঐ কথাগুলি লিখে রাখ।
আজাযিল খোদার হুকুম পালন করলো!
তোমাদের হয়তো স্মরণ আছে, আল্লাহর নির্দেশে আজাযিল জিনবংশ গারত করবার পরে দুনিয়া খালি পড়ে থাকে। খোদার বোধ হয় খেয়াল হলো যে, তিনি জিনদের বদলে মানুষ দ্বারা দুনিয়া পূর্ণ করবেন। তিনি সে কথা ফেরেশতাদের বললেন। তারা জবাব দিলোঃ হে পরোয়ারদিগার, একবার তুমি জিন পয়দা করে ঠকেছো। তারা কেবল ঝগড়াঝাটি মারামারি করে দিন কাটিয়েছে। আবার এখন মানুষ সৃষ্টি করে ফ্যাসাদ বাড়িয়ে কি লাভ! আমরা তো তোমার এবাদতে মশগুল আছি।
খোদা হেসে বললেনঃ দেখ ফেরেশতাগণ, আমি কি তোমাদের চেয়ে বেশি বুঝিনা।
এই কথা শুনে তারা খুব লজ্জা পেলো। তার বিনয়ের সঙ্গে বললোঃ হে রহমানুর রহিম। তোমার খেয়াল বুঝবার ক্ষমতা কারো নেই।
খোদতা’লা হযরত আদমকে সৃষ্টি করবার ব্যবস্থা করলেন। তিনি দুনিয়া থেকে একমুষ্টি মাটি নিয়ে হযরত আদমের শরীর সৃষ্টি করবার হুকুম দিলেন এবং দেহের মধ্যে আত্মা প্রবেশ করবার পূর্বে মাটিটুকুকে বেহেশতের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দেবার ব্যবস্থা করলেন?
একদিন আজাযিল ফেরেশতাদের সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে সেখানে এসে হাজিল। আদমের চেহারা দেখে সে খুব হাসতে লাগলো। তারপর তাঁকে নিয়ে এমন বিদ্রূপ শুরু করলো যে, ফেরেশতারা তাকে বললোঃ দেখ আজাযিল! খোদা যাকে খলিফারূপে দুনিয়ায় পাঠাবার জন্য পয়দা করেছেন, তাঁকে নিয়ে তোমার এরূপ বেয়াদবি করা উচিত নয়।
ফেরেশতাদের কথায় আজাযিল কিছুমাত্র লজ্জাবোধ করলো না, বরং অবজ্ঞাভরে বললোঃ বলো কি, খোদা এই মাটির ঢেলাকে খলিফারূপে দুনিয়ায় পাঠাবেন! তিনি যদি একে আমার অধীন করে দেন, তাহলে আমি এক্ষুণি একে গলা টিপে মেরে ফেলবো; আর আমাকে যদি এর অধীন করে দেন তবে আমি কিছুতেই মানবো না।
আজাযিলের স্পর্ধা দেখে ফেরেশতারা অসন্তুষ্ট হয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। আজাযিল সেই মাটির মূর্তিটির সুমুখে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কি চিন্তা করলো, তারপর তার নাক দিয়ে তার শরীরের মধ্যে ঢুকতে চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে বড় মুস্কিলে পড়লো। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বের হয়ে এসে সেই মূর্তির গায়ে থুথু দিয়ে সেখানে থেকে চলে গেল।
খোদার আদেশে এক শুভ মুহুর্তে হযরত আদমের আত্মা তাঁর শরীরে প্রবেশ করলো। তারপর তাকে বিচিত্র পোশাকে সজ্জিত করে একটি অনিন্দ-সুন্দর সিংহাসনে বসানো হলো। এইরূপে নিজের খলিফাকে সৃষ্টি করে খোদাতা’লা ফেরেশতাদের বললেনঃ আমি হযরত আদমকে তোমাদের চেয়ে বড় করে পয়দা করেছি। তোমরা এসে সেজদা (প্রণাম) করো।
খোদার আদেশ পেয়ে ফেরেশতারা অতিশয় ভক্তিতে ও শ্রদ্ধায় আদম আলাইহিসসালামকে সেজদা করলো। কিন্তু আজাযিল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। সেজদা তো করলোই না –এমন কি মাথা পর্যন্ত নোয়াল না।
ফেরেশতারা আজাযিলের এই স্পর্ধা দেখে তাজ্জব হয়ে গেলো।
খোদা আজাযিলকে বললেনঃ আজাযিল! আমার হুকুমে ফেরেশতাগণ আদমকে সেজদা করলো, কিন্তু তুমি তাকে সেজদা করলে না কেন?
আজাযিল জবাবা দিলোঃ হে খোদা! আদমকে দুনিয়ার না-পাক মাটি থেকে পয়দা করছো, কিন্তু তুমি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করছো। আমি তাকে সেজদা করিতে পারি না।
অতিশয় অসন্তুষ্ট হয়ে খোদা বললেনঃ রে মুর্খ, আত্ম-অহঙ্কারে তুই আমার হুকুম অমান্য করেছিস! জানিস তাকে মাটি থেকে পয়দা করবার ব্যবস্থা আমিই করেছি –আমিই তাকে ফেরেশতাদের বড় করেছি, আর আমিই তাকে সেজদা করতে বলেছি। কিন্তু এত স্পর্ধা তোর কিসে হলো? তুই এতদিন আমার এবাদত করেছিস সেই জন্য কি? কিন্তু তুই-ই না লওহে-মহফুযে’ লিখে রেখেছিস লক্ষ লক্ষ বৎসর আমার এবাদতে মশগুল হয়ে থাকলেও আমার একটি মাত্র আদেশ অমান্য করলে সমস্ত এবাদত পণ্ড হয়ে যাবে? তুই আজ থেকে মরদুদ হয়ে গেলি। তুই আমার দরবার থেকে দূর হয়ে যা।
খোদা এই কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে আজাযিলের চেহারা বিশ্রীরূপে পরিবর্তিত হয়ে গেলো। তার পায়ের রং হলো অত্যন্ত কালো, মুখ হলো শুকরের মুখের মতো। চোখ দু’টি কপাল থেকে বুকের ওপর নেমে এলো। তার নাম হলো ইবলিস।
আজাযিল নিজের দুর্দশা দেখে মনে মনে খুব ভয় পেলো, কিন্তু বাইরে সে ভাব মোটেই প্রকাশ করলো না। খোদার দরগায় আরজ করলোঃ হে খোদা! আমি নিজের অহম্মকিতে যে পাপ করেছি তার শাস্তি ভোগ আমাকে করতেই হবে! তার জন্য আমাকে যে দোজখী করেছ, তাও আমাকে মানতে হবে। আমি জানি, হাজার চেষ্টা করলেও আমার এ কসুর মাফ হবে না। তোমার দরবার থেকে চিরকালের জন্য চলে যাবার আগে আমি গোটা কয়েক আরজ পেশ করতে ইচ্ছা করি। আশা করি তুমি তা মঞ্জুর করবে।
খোদা বললেনঃ বল তোর কি আরজ আছে?
ইবলিস বললোঃ আমার প্রথম আরজ এই যে, আমাকে কেয়ামত (শেষদিন) পর্যন্ত স্বাধীনতা দাও।
খোদা সে আরজ মঞ্জুর করলেন।
ইবলিস তার দ্বিতীয় আবেদন পেশ করলো। বললোঃ আমাকে লোকচক্ষে অদৃশ্য করে দাও। আর কেউ জানতে না পারে এমনি করে সকলের হাড় মাংস স্নায়ু মজ্জা শরীরের মধ্যে প্রবেশ করবার ক্ষমতা দাও।
খোদা তাও মঞ্জুর করলেন।
তারপর ইবলিস বললোঃ লক্ষ লক্ষ বছর তোমার এবাদতে মশগুল থেকে সিজ্জীন দোজখ হতে বেহেশতে আসবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। কিন্তু তোমার তৈয়ারী সামান্য বান্দার ওপর বেয়াদবি করার জন্য আমাকে শাস্তি দিলে। তোমার প্রিয় মানবের ওপর আমি তার প্রতিশোধ নেবো। তুমি আমাকে শয়তান করলে। আমি তোমার বান্দাকে শয়তান করে তৈরী করবো! যেমন সামান্য একটু কসুরে আমাকে নারকী করলে, তেমনি তোমার প্রিয় মানুষেরা দিন রাত তোমার রোজা নামাজ করলেও আমি বান্দাকে দোজখে পাঠাবার ব্যবস্থা আমি করবো, আর তুমি তাদের সৎপথে চালিত করবার জন্য অনেক নবী ও পয়গম্বর পাঠাবে। তারা তাদের উদ্ধারের জন্য অনেক পরামর্শ, অনেক উপদেশ দান করবেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হবে না। আজ থেকে তোমার মানবের অনিষ্ট করাই হবে আমার একমাত্র কাজ।
এই বলে ইবলিস ডানা মেলে দুনিয়ার দিকে উড়ে গেলো। সেই থেকে সে শয়তান। তার প্রতিজ্ঞা কেমন করে পূরণ করছে তা তোমরা দিন রাত দেখতে পাচ্ছ। খোদার ঈমানদারের চেয়ে শতাদের বেঈমানদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
তাহলে তোমরা দেখতে পেলে, ইবলিস লক্ষ লক্ষ বছর খোদার উপাসনা করে কত উন্নতি করেছিলো। একদিনের সামান্য একটু কসুরে তা সমস্ত নষ্ট হয়ে তার কত অধঃপতন হলো। সুতরাং তোমার জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ন্যায় ধর্ম ও সত্য পথে চলতে চেষ্টা করবে। কখনো ভুলেও এক নিমিষের জন্য একটুও ত্রুটি করবে না। জীবরেন একটু কসুরও খোদা মাফ করেন না। তোমরা হয়ত মনে করবে, প্রথমে একটু আধটু কসুর করে ভাল ভাল কাজ করবে, কিন্তু তা হয় না।
স্বর্গ চ্যুতি
মাটির দ্বারা প্রস্তুত তুচ্ছ মানব আদমের জন্য আজাযিলের এই দুর্দশা ঘটলো। আজাযিল সেই নিরপরাধ আদমকে জব্দ করবার জন্য সুযোগ খুঁজতে লাগলো।
খোদাতা’লা বেহেশতে বিচিত্র উদ্যান রচনা করে নানারকম সুন্দর সুন্দর ফল ও ফুলের গাছ সৃষ্টি করলেন। সেই বাগানের দু’টি গাছ সৃষ্ট হলো –তার একটি নাম জীবন-বৃক্ষ, অপরটির নাম জ্ঞান-বৃক্ষ। খোদা আদমকে সেই বাগানে বাস করবার অনুমতি দিলেন। খোদা আদমকে অনুমতি দিলেন –বাগানের সমস্ত গাছের ফল সে খেতে পারে, কিন্তু জীবন-বৃক্ষ ও জ্ঞান-বৃক্ষের ফল সে কখনো যেন ভক্ষণ না করে। এই গাছের ফল আহার করামাত্র তার মৃত্যু ঘটবে।
এর পরে অনেক দিন চলে যাবার পর খোদা মনে করলেন আদমেরন একজন সঙ্গিনী সৃষ্টি করা প্রয়োজন। একদিন তিনি সমস্ত পশুপক্ষীকে আদমনের নিকটে এনে তাদের প্রত্যেকের নামকরণ করতে বললেন। আদম প্রত্যেক জীবের আলাদা আলাদা নাম রাখলেন। তারা চলে গেলে আদম চিন্তা করতে লাগলেন, খোদাতা’লা সকল জীবজন্তুকে জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন কেবল মাত্র তিনিই একাকী রয়েছেন।
সেই রাত্রে আদ ঘুমিয়ে পড়লে খোদা তাঁর বাম পাঁজড় থেকে একটা হাড় বের করে নিয়ে তা দিয়ে একটি নারী সৃষ্টি করে তাঁর পাশে শুইয়ে রাখলেন। ঘুম ভাঙলে পাশে একটি সুন্দরী নারীকে দেখে তিনি মনে মনে পরম বিস্ময়বোধ করলেন। এমন সময়ে খোদা বললেনঃ এর নাম বিবি হাওয়া। এ হলো তোমার সঙ্গিনী। তোমরা দু’জনে একত্রে বেহেশতের বাগানে থাকবে, খেলবে, বেড়াবে। কিন্তু সাবধান সেদিন তোমাকে নিষেধ করেছি –আজ আবার তোমাকে ও তোমার সঙ্গিনীকে বলছি, যখন ইচ্ছে হবে এই বাগানের সকল রকম ফল আহার করবে, কিন্তু এই জীবন-বৃক্ষ ও জ্ঞান-বৃক্ষের ফল কখনো আহার করবে না!
সেই দিন থেকে আদম ও হাওয়া মনের সুখে সেই বাগানের নানা রকম ফলমূল খেয়ে বেড়াতে লাগলেন।
একদিন হাওয়া একা একা বাগানে বেড়াচ্ছেন। এই সুযোগে শয়তান একটা সাপের মূর্তি ধরে তাঁর কাছে এলো। সে সময়ে সিংহ, বাঘ, সাপ, গরু, হরিণ, ভেড়া, ছাগল সকলে একসঙ্গে খেলা করতো। কেউ কাউকে হিংসা করতো না। সাপ হাওয়াকে জিজ্ঞাসা করলোঃ তোমরা কি এই বাগানের সব গাছের ফল খাও।
হাওয়া জবাব দিলেনঃ না, দু’টি গাছের ফল খাওয়া আমাদের নিষেধ!
সাপ জিজ্ঞাসা করলোঃ কোন কোন গাছের ফল তোমরা খাও না?
হাওয়া গাছ দু’টি দেখিয়ে দিলেন।
সাপ বললোঃ কেন তোমরা এ দু’টি গাছের ফল খাও না?
হাওয়া বললেনঃ জানি না খোদা বারণ করেছেন।
সাপ বললোঃ খোদা তোমাদের বোকা বানিয়ে এখানে রেখেছেন। এই গাছের ফল খেলে তোমাদের জ্ঞান-চক্ষু খুলে যাবে, তোমাদের ওপরে খোদার আর কোন কারসাজি চলবে না, তাই খোদা তোমাদের এই গাছের ফল খেতে বারণ করেছে, কি সুন্দর আর মিষ্টি এই ফল তা তোমরা জানো না।
সাপের কুপরামর্শে হাওয়ার মন দুলে উঠলো। তিনি ভাবলেন –তাইতো, অমন সুন্দর ফল না জানি কেমন মিষ্টি! তিনি লোভ সামলাতে পারলেন না। একটা ফল ছিঁড়ে নিলেন। আধখানা নিজে খেয়ে অর্ধেক আদমের জন্য নিয়ে গেলেন। আদম হাওয়ার হাত থেকে সেই নতুন রকমের ফলটুকু নিয়ে সাগ্রহে খেলে ফেললেন।
শয়তান উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে মনে মনে হাসতে লাগলো। ফল খাবার পরে তাঁরা সর্বপ্রথম মুঝতে পারলেন যে নিজেরা বস্ত্রহীন। তখন বড় বড় ডুমুরের পাতার সঙ্গে লতা গেঁথে তাঁরা লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করতে লাগলেন। এমন সময়ে খোদাতা’লা আদম ও হাওয়াকে নিকটে ডাকলেন, কিন্তু তাঁরা প্রতিদিনের মতো সমুখে গেলেন না। গাছের আড়ালে গিয়ে লুকোলেন।
খোদাতা’লা বললেনঃ আমি বুঝতে পেরেছি তোমরা জ্ঞান-বৃক্ষের ফল খেয়েছো।
আদম বললেনঃ হাওয়া আমাকে দিয়েছে।
খোদা ক্রুব্ধ কণ্ঠে বললেনঃ আমার আদেশ অমান্য করে যে পাপ আজ তোমরা করলে, বংশ পরম্পরাক্রমে এর ফল সকলকে ভোগ করতে হবে। ত
হাওয়াকে উদ্দেশ্য করে তিনি অভিশাপ দিলেনঃ তুমি প্রসব বেদনায় অত্যন্ত যন্ত্রণা ভোগ করবার পর তোমার সন্তান জন্মগ্রহণ করবে। চিরকাল তোমাকে পুরুষের অধীন হয়ে থাকতে হবে। পুরুষ তোমায় শাসন করবে।
আদমকে তিনি অভিশাপ দিলেনঃ তোমার শস্যক্ষেত্র আগাছা কুগাছা ও নানা কাঁটা গাছে ভর্তি হয়ে যাবে। এক মুষ্টি অন্নের জন্য আ-মরণ তোমাকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে।
সাপকে অভিশাপ দিয়ে বললেনঃ নির্বোধ নারীকে কুপরামর্শ দিয়ে পাপ করিয়েছ –এর শাস্তি তোমাকে সারা জীবন ভোগ করতে হবে। যে মাটিতে মানুষ পা দিয়ে চলবে সেই মাটিতে সর্বদা বুক পেতে তুমি চলবে এবং সেই খেয়ে তোমাকে জীবনধারণ করতে হবে। এই নারী বংশই হবে তোমাদের পরম শত্রু! তারা যখনই তোমাকে দেখবে তখনই বধ করার চেষ্টা করবে।
এই কথা বলে খোদা দু’খানা চামড়া তাঁদের পরিয়ে বাগান থেকে বের কের পৃথিবীতে নির্বাসন দিলেন।
হাবিল ও কাবিল
হযরত আদ ও বিবি হাওয়া শয়তাদের কুচক্রে পড়ে বেহেশতচ্যুত হলেন। তাঁরা আল্লাহতা’লার অভিশাপে পৃথিবীতে এসে বাস করতে লাগলেন। ক্রমে তাঁদের সন্তান-সন্ততি জন্মগ্রহণ করতে লাগলো। হযরত আদমের বংশধরগণের মধ্যে হাবিল ছিলেন অতিশয় ধর্মপ্রাণ। তিনি রাতদিন কেবল খোদার বন্দেগীতে মশগুল হয়ে থাকতেন। অন্য কোন দিকে তাঁর দৃষ্টি ছিলো না।
ইবলিস আদমের ওপরে হাড়ে হাড়ে চটে ছিলো। সে কেবল সুযোগ খুঁজছিলো কি করে এঁর সন্তানগণকে পথভ্রষ্ট করা যায়। অবশেষে অনেক প্রলোভন দিয়ে কাবিল নামক পুত্রকে আপনার অধীনে আনতে সমর্থ হলো। কাবিল শয়তানের ফেরেরীতে পড়ে মুহুর্তের জন্য ভুলেও একবার আল্লাহতা’লার নাম মুখে আনতো না, বরং দিনে দিনে পাপের পথে অধিক অগ্রসর হতে লাগলো।
একদিন হাবিল ও কাবিল মনস্থ করলো যে, তারা উভয়ে আল্লাহতা’লার উদ্দেশ্যে একটা পশুকে কোরবানি দেবে। নির্দিষ্ট দিনে উভয়ে দু’টি পশু জবেহ করলো। ধার্মিক ও পরহেজগার হাবিলের কোরবানি মঞ্জুর হলো, কিন্তু পাপী কাবিলের কোরবানী খোদা মঞ্জুর করলেন না।
কাবিল যখন বুঝতে পারলো যে, আল্লাহ তার কোরবানি গ্রহণ করেননি, তখন সে মনে খুব আঘাত পেলো। সে ভাবলো যে, হাবিলের কারসাজিতেই খোদাতা’লা তার প্রতি বিমুখ হয়েছেন। সে প্রতিহিংসায় উত্তেজিত হয়ে চীৎকার করে বলে উঠলোঃ তেমাকে খুন করবো হাবিল। তোর জন্যই আমার কোরবানি মঞ্জুর হলো না।
কাবিলের কথা শুনে হাবিল তো অবাক! সে কাবিলকে বললোঃ সে কি কাবিল –আমি তোমার কাছে কি অপরাধ করেছি যে, তুমি আমাকে খুন করবে? তুমি যদি আমাকে খুন করো তবে আমার ও তোমার উভয়ের পাপ তোমাকে আজীবন বহন করতে হবে। তার পরে খোদাতা’লা তেমাকে এর শাস্তির জন্য দোজখে পাঠাবেন। তোমার দুর্দশার সীমা থাকবে না। তুমি এমন পাপ কখনো করো না ভাই।
হাবিলের কতায় কাবিল আলো বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠলো। সে লাফ দিয়ে হাবিলের বুকের ওপরে ওঠে গলা টিপে ধরলো। ধর্মপ্রাণ হাবিল দম বন্ধ হয়ে মারা গেলো।
হাবিলকে মেরে ফেলে কাবিল ভয়ানগ বিপদে পড়ে গেলো। হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে সে চিন্তা করতে লাগলো। কি করবে, কিছুই স্থির করতে পারলো না। সে পাগলের মতো এদিক-ওদিন ছুটোছুটি করতে লাগলো। হাবিলের লাশটার কি গতি হবে তা সে ভেবে পেলো না।
এই ঘটনার পূর্বে কোন মানুষ মরে নি, খুন খারাবিও কোনো দিন হয়নি। কাজেই মৃতদেহ কিরূপে দাফন-কাফন করতে হয় তা কারুরই জানা ছিলো না।
হাবিলকে খুন করে মাথায় হাত দিয়ে কাবিল আকাশ পাতাল চিন্তা করতে লাগলো। এখন সে কি করে, কোথায় যায়, কার পরামর্শ লয়।
আল্লাহতা’লা কাবিলের বিপদ বুঝতে পেরে একটি কাককে সেই স্থানে পাঠিয়ে দিলেন। কাকটি ঠোট দিয়ে ঠুকরে মাটি খুঁড়তে লাগলো। কাকের এই ব্যাপার দেখে কাবিল যেন অকূলে কুল পেলো। এরূপবাবে মাটি খুঁড়ে হাবিলকে তো অনায়াসে মাটিতে পুতে রাখা যায়। কথাটা মনে হতেই কাবিল একখানা অস্ত্র সংগ্রহ করে এনে মাটি খুঁড়ে হাবিলকে কবর দিলো। তারপর অনুতপ্ত হয়ে ভ্রাতার শোকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
আপনার মতামত লিখুন