ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি – সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী - Islamic dawat and policy - Syed Abul A'la Maududi

ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি – সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী download now


আমাদের দাওয়াত

আমাদের দাওয়াত সম্পর্কে সাধারণত বলা হয় যে, আমরা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার দাওয়াত দিয়া থাকি। হুকুমতে ইলাহিয়া শব্দে স্বতঃই এক প্রকার ভুল ধারণর সৃষ্টি হয়- অনেকে আবার ইচ্ছা করিয়াই ইহাকে কেন্দ্র করিয়া ভুল ধারণা সৃষ্টি করিতে চেষ্টা করে। সাধারণত লোকে মনে করে, কিংবা তাহাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করা হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্র বলিতে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা মাত্র বুঝায়। আর বলা হয় যে, বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্হার পরিবর্তে সেই বিশেষ রাজনৈতিক ব্যবস্হা প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। তাহার পর যাহারাই এই রাষ্ট্র ব্যবস্হা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করিবে, যেহেতু তাহারাই উহার পরিচালনভারও লাভ করিবে, সেহেতু খুব সহেজই বুঝনো হয় যে, আমরা হুকুমত দখল করিতে চাই। অতঃপর দ্বীনদারীর ওয়ায শুরু হইয়া যায়। আমাদেরকে দুনিয়ার বা পার্থিব স্বার্থবাদী আখ্যা দেওয়া হয়। অথচ মুসলমানদের তো দ্বীন- ইসলাম এবং পরকালের জন্যই কাজ করা দরকার, দুনিয়ার জন্য নহে। দ্বিতীয়তঃ ইহাও বলা হয় যে, হুকুমত তো দাবী করার বস্তু নহে, ইহা তো ধার্মিক জীবন যাপনের ফলে খোদার তরফ হইতে উপহারস্বরূপই মানুষ লাভ করিয়া থাকে। বস্তুত আমাদের সম্পর্কে এইসব কথাবার্তা অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত তত্ত্ব না বুঝিয়াই বলা হয়। কোথাও বিশেষ চালাকীর সহিত ইহা প্রচার করা হয় শুধু এই উদ্দেশ্যে যে, আমাদেরকে না হইলেও খোদার অনেক বান্দাহকেই হয়তো এই উপায়ে সত্যের এই মহান আন্দোলন হইতে বিরত রাখা সম্ভব হইবে। অথচ আমাদের বই পুস্তক উদার ও মুক্ত দৃষ্টিতে পাঠ করিলে প্রত্যেকেই অতি সহজেই বুঝিতে পারেন যে, নিছক একটা রাস্ট্র-ব্যবস্হা প্রতিষ্ঠাই আমাদের উদ্দেশ্য নহে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের সামগ্রিক জীবনে ইসলাম নির্ধারিত পরিপূর্ণ বিপ্লব সৃষ্টি করাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই বিপ্লবের জন্যই আল্লাহ তাআলা নবী প্রেরণ করিয়াছেন। তাহাদের আহবান ও আন্দোলনের ফলে সব নবীরই নেতৃত্বে এক উদ্দেশ্যকে পূর্ণ করা।


আমাদের দাওয়াতকে সহজ ও সুস্পষ্ট ভাষায় পেশ করিতে হইলে ইহাকে নিম্নলিখিত তিনটি দফায় পেশ করা যায়ঃ


১. আমরা সাধারণত সকল মানুষকে এবং বিশেষভাবে মুসলমানদেরকে আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ করার আহবান জানাই।


২. ইসলাম গ্রহণ করার কিংবা উহাকে মানিয়া লওয়ার কথা যাহারাই দাবী অথবা প্রকাশ করেন, তাহাদের সকলের প্রতি আমাদের আহবান এই যে, আপনারা আপনাদের বাস্তব জীবন হইতে মুনাফিকী ও কর্ম-বৈষম্য দূর করুন এবং মুসলমান হওয়ার দাবী করিলে খাঁটি মুসলমান হইতে ও ইসলামের পূর্ণ আদর্শবান হইতে প্রস্তুত হউন।


৩. মানব-জীবনের যে ব্যবস্হা আজ বাতিলপন্থী ও ফাসিক কাফিরদের নেতৃত্বের আমূল পরিবর্তন করিতে হইবে এবং নেতৃত্ত্ব ও কর্তৃত্ত্ব আদর্শ ও বাস্তব উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহর নেক বান্দাহদের হাতে সোপর্দ করিতে হইবে। উল্লিখিত তিনটি বিষয়ই যদিও সুস্পষ্ট, তবুও দীর্ঘকাল পর্যন্ত ইহার উপর ক্রমাগত ভুল ধারণা ও অবসাদ-উপেক্ষার আবর্জনা পুঞ্জীভূত হইয়াছে বলিয়া আজ কেবল অমুসলমানই নহে- মুসলমানদের নিকটও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা অপরিহার্য হইয়া পড়িয়াছে।


খোদার বন্দেগীর বিভিন্ন রকম অর্থ করা হয়। কেহ মেন করে, মুখে মুখে খোদাকে ‘খোদা’ এবং নিজেকে খোদার বান্দাহ মানিয়া লওয়াই যথেষ্ট। নৈতিক, বাস্তব কর্মজীবনে এবং সমষ্টিগত ক্ষেত্রে খোদাকে না মানিলে এবং তাহার দাসত্ব স্বীকার না করিলেও কোনরূপ ক্ষতি নাই। অথবা খোদাকে অতিপ্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টিকর্তা, রেযেকদাতা এবং মাবুদ স্বীকার করিতে হইবে এবং বাস্তব কর্মজীবনের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের ক্ষেত্র হইতে খোদাকে অপসারিত ও বেদখল করা অসংগত হইবে না। খোদার বন্দেগী সম্পর্কে আর একটি ধারনা এই যে, জীবনকে ধর্মীয় ও বৈষয়িক- এই দুইভাগে বিভক্ত করা চলে এবং কেবল ধর্মীয় জীবনে আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত ও হালাল-হারামের কয়েকটি শর্ত পালনের ব্যাপারে খোদার বন্দেগী করিলেই চলিবে। কিন্তু বৈষয়িক ব্যাপারে তামাদ্দুন, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প- সাহিত্যের ক্ষেত্রে মানুষ খোদার বন্দেগী হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকিবে। এই ক্ষেত্রের জন্য হয় নিজেরা কোন নীতি রচনা করিয়া লইবে, কিংবা অপর লোকদের রচিত নীতি অবলম্বন করিবে।


খোদার বন্দেগী সম্পর্কে সাধারণ প্রচলিত এই সমস্ত ধারণাকেই আমরা ভ্রান্ত মনে করি এবং ইহা নির্মূল করতে চাই। কাফিরী জীবন-ব্যবস্হার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই যতখানি, ততখানি কিংবা ততোধিক তীব্রতার সহিত বন্দেগীর এই ভুল ধারণাসমূহের বিরুদ্ধেও আমাদের সংগ্রাম। কারণ, উল্লিখিত ধারণসমূহে দ্বীন ইসলামের মূল ভিত্তি এবং রূপকেই সম্পূর্ণ বিকৃত করিয়া দেওয়া হইয়াছে। আমাদের মনে কুরআন মজীদ এবং উহার পূর্ববর্তী সমস্ত আসমানী গ্রন্হ, শেষ নবী এবং পৃথীবির বিভিন্ন অংশে প্রেরিত অন্য নবীগণ এক বাক্যে খোদার দাসত্ব গ্রহণ করার পর যে আহবান জানাইয়াছেন, তাহার অর্থ এই যে, মানুষ খোদাকে পূর্ণরূপে ইলাহ, রব, মাবুদ, শাসক, মালিক, মনিব, পথপ্রদর্শক, আইন রচয়িতা, হিসাব গ্রহণকারী এবং প্রতিফলদাতা মানিবে এবং নিচের সমগ্র জীবনকে ব্যক্তিগত (private), সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয়, তামাদ্দুনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও আদর্শমূলক ব্যাপারসমূহকেও পূর্ণরূপে খোদার বন্দেগীর ভিত্তিতেই সুসম্পন্ন করিবে। কুরআন মজীদে( ) “পূর্ণরুপে ইসলামের মধ্যে দাখিল হও” বলিয়া এই কাজেরই নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। অর্থাৎ নিজেদের জীবনের কোন একটি দিক বা বিভাগকেই খোদার বন্দেগীর বাহিরে রাখিতে পারিবে না। পরিপূর্ণ সত্ত্বা লইয়া খোদার গোলামী ও দাসত্ব কর, জীবনের কোন একটি দিক বা কোন একটি কাজকেও তোমরা খোদার বন্দেগী হইতে মুক্ত রাখিও না, খোদার নির্দেশ ও বিধানকে পরিত্যাগ করিয়া, স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী হইয়া অথবা কোন স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী মানুষের অনুসারী ও অনুগামী হইয়া চলিও না। বস্তুত খোদার বন্দেগীর এই অর্থই আমরা প্রচার করিয়া থাকি। এইরূপ বন্দেগী কবুল করার জন্য আমরা মুসলিম সকল মানুষেকই আহবান জানাইয়া থাকি।


মুনাফিকীর মূলকথা

দ্বিতীয়তঃ আমরা এই দাওয়াতও দেই যে, যাহারা ইসলামের অনুসরণ করিয়া চলার দাবী করে, কিংবা যাহারা ইসলাম গ্রহণ করিয়াছে, তাহারা যেন বাস্তব জীবনে মুনাফিকী নীতি পরিত্যাগ করে এবং নিজেদের জীবনকে যেন আভ্যন্তরীণ বৈষম্য ও কর্মীয় বৈষম্য (Inconsistencies) হইতে পবিত্র রাখে। ‘মুনাফিকী নীতি’ বলিতে বুঝায় সেই অবস্হাকে, যখন মানুষ নিজের ঈমান ও দ্বীন এর সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের জীবন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে আদৌ চেষ্টা করে না বরং সাম্প্রতিক ফাসিকী ও খোদাদ্রোহীমূলক জীবন ব্যবস্থাকে নিজের অনূকূল মনে করিয়া উহাতে নিজের মঙ্গলময় ‘ভবিষ্যত’ রচনার চিন্তায় মশগুল হয়। তাহা পরিবর্তনের চেষ্টা করিলেও তাহার উদ্দেশ্য ফাসিকী জীবন-ব্যবস্থার পরিবর্তন করিয়া দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করা নহে, বরং এক ধরনের ফাসিকী রাস্ট্র-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করাই তাহার উদ্দেশ্য হইয়া থাকে। আমাদের মতে এই কর্মণীতি সম্পূর্ণ মুনাফিকী কর্মনীতি ছাড়া আর কিছুই নহে। কারণ এক প্রকার জিবন-ব্যবস্থার প্রতি ঈমান রাখা এবং কার্যত উহার বিপরীত ধরণের জীবন-ব্যবস্হার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা সুস্পষ্টরূপে পরস্পর বিরোধি ব্যাপার। নিষ্ঠাপূর্ণ ঈমানের পরিচয় এই যে, যে জীবন ব্যবস্হার প্রতি ঈমান আনা হইবে উহাকেই বাস্তব জীবনের বিধান ও আইন হিসাবে চালু করিতে হইবে এবং এই জীবন ব্যবস্হা অনুযায়ী বাস্তব জীবন যাপনের পথে যত বাধা প্রতিবন্ধকতাই আসুক না কেন, উহার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আমাদের প্রাণ কাতর ও ব্যাকুল হইয়া উঠিবে। প্রকৃত ঈমান উহার বিকাশ পথেই এই ধরনের সামান্যতম বাধা বরদাশত করিতেও প্রস্তুত হয় না। আর সমগ্র দ্বীনকে বিপরীত ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্হার অধীন থাকিতে দেখার এবং তাহা সহ্য করার তো কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না। কারণ, এই অবস্থায় তাহার দ্বীন এর কোন অংশেরই বাস্তবায়ন সম্ভব নহে। কোন কোন দেশে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত জীবন ব্যবস্হা ইসলামের বিশেষ কয়েকটি অংশকে অক্ষতিকর মনে করিয়া অনুগ্রহ স্বরূপ চলিতে দেয় বটে, কিন্তু মানব জীবনের অন্যান্য সমগ্র ব্যাপারই দ্বীন-ইসলামের বিপরিত নিয়ম-নীতি অনুযায়ী চলিয়া থাকে। এই অবস্হায় ও সেখানে ঈমানের কোনই ক্ষতি হয় না বলিয়া যাহারা মনে করে, তাহাদের ভ্রান্তি সুস্পষ্ট। সেখানে কাফিরী ব্যবস্হাকে এক স্হায়ী নিয়তি মনে করিয়াই অন্যান্য কাজ সম্পর্কে চিন্তা করা হয়। ফিকাহ শাস্ত্রের বাহ্যিক দৃষ্টিতে এই ধরনের ঈমানের যত মূলই হোক না কেন, কিন্তু দ্বীন-ইসলামের দৃষ্টিতে প্রকৃত মুনাফিকী ও এই ধরনের ঈমানের মধ্যে কোন পাথর্ক্য নাই। কুরআনের অসংখ্য আয়াতও ইহাকে মুনাফিকী বলিয়াই অভিহিত ও প্রমাণিত করে। পূর্বোক্ত অর্থ অনুযায়ী যাহারাই খোদার বন্দেগী কবুল করার প্রতিশ্রুতি দিবে, তাহাদের সকলেরই জীবনকে এইরূপ মুনাফিকী হইতে পবিত্র করিয়া তোলাই হইল আমাদের এই প্রচেষ্টার লক্ষ্য; খোদার বন্দেগীর সঠিক ধারনা অনুযায়ী ঐকান্তিক নিষ্ঠার সহিতই অবিশ্রান্তভাবে আমাদের এই চেষ্টা চালাইয়া যাইতে হইবে। কারণ আমরা চূড়ান্তভাবে এই সিদ্ধান্ত করিয়াছি যে, আল্লাহ তা’আলা তাঁহার নবীদের মারফতে যে জীবন পদ্ধতি, আইন-কানুন এবং তামাদ্দুন, নৈতিক চরিত্র, সমাজ, রাজনীতি, অথর্নীতি এবং চিন্তা ও কর্মের যে বিধান প্রেরণ করিয়াছেন, আমরা আমাদের পরিপূর্ণ জীবনে তাহাই অনুসরণ করিয়া চলিব এবং এক মুহুর্তের জন্য জীবনের কোন একটি কাজকেও- কোন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যপারেও- খোদার দেওয়া সত্য জীবন বিধানের পরিবর্তে অপর কোন আদর্শ ও নীতির বিন্দুমাত্র প্রভাবও স্বীকার করিব না। বাতিল জীবন ব্যবস্হার সামান্য ব্যাপারে, সেখানে উহাতে সন্তুষ্ট হওয়া, উহার প্রতিষ্টা ও স্হিতির চেষ্টায় অংশগ্রহণ করা কিংবা এক প্রকারের বাতিল ব্যবস্হার পরিবর্তে অন্য এক প্রকারের বাতিল বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা করা যে প্রকৃত ঈমানের কত বিপরীত, তাহা কাহারও অজ্ঞাত থাকা উচিত নহে।

ভাঙ্গা ও গড়া – সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। - Bhanga and ghara – Syed Abul A'la Maududi.
ঈমানের হাকীকত-সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী - Imaner Hakikat- Syed Abul A'la Mawdudi
হজ্জের হাকীকত – সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী - Haqiqat of Hajj - Syed Abul A'la Maududi
রাহে আমল - আল্লামা জলিল আহসান নদভি - Rahe Amal - Allama Jalil Ahsan Nadvi
হাদীসের আলোকে মানব জীবন - মাওলানা এ.কে.এম ইউসুফ
দ্বীন প্রতিষ্ঠায় মহিলাদের দায়িত্ব – শামসুন্নাহার নিজামী
রাসূলুল্লাহর (সা.) বিপ্লবী জীবন – আবু সলীম মুহাম্মদ আবদুল হাই
ইসলামী সংগঠন – অধ্যাপক এ.কে.এম. নাজির আহমদ - Islamic organization – Prof. A.K.M. Nazir Ahmad
ইকামাতে দ্বীন – অধ্যাপক গোলাম আযম - Iqamat - e-din – Prof. Ghulam Azam
তাফহীমুল কুরআন ১৯শ খন্ড – সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। - Tafhimul Qur'an 19th Khondo - Syed Abul A'la Mawdudi.