ইসলামী বিপ্লবের পথ – সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী - Path of Islamic Revolution - Syed Abul A'la Maududi
ইসলামী বিপ্লবের পথ – সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী DOWNLOAD NOW
দুটি কথা
তখনো ভারত স্বাধীন হয়নি। ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্থান রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা লাভ আর মুসলমানদের জন্যে পৃথক আবাসভূমি এ দুটো বিষয়ই চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। মুসলমানরা একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছিল, যেখানে সর্বক্ষেত্রে কার্যকর হবে কুরআন সুন্নাহ বিধান। কিন্তু যারা এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তাদের মধ্যে না ছিল ইসলামের যথার্থ জ্ঞান, না ছিল ইসলামী চরিত্র আর না ছিল নিরেট ইসলামী সমাজ গড়ার মন মানসিকতা। তাদের মধ্যে মুসলিম জাতীয়তাবাদী একটি চিন্তা ছিল মাত্র। স্রেফ মুসলমানদের হাতে ক্ষমতা আসাটাকেই কোন একটি দেশ ইসলামী রাষ্ট্র হবার জন্যে যথেষ্ট বলে তারা ধরে নিয়েছিল। সে দেশের আইন কানুন, শিক্ষা সংস্কৃতি, অর্থনীতি রাজনীতি যা-ই হোক না কেন?
এটা ছিল একটা চরম ভ্রান্ত ধারণা। এই অবাস্তব পন্থায় কিছুতেই একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বা ইসলামী বিপ্লব সাধনের একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম পন্থা রয়েছে। পৃথিবীর যে দেশের লোকেরাই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে, তাদেরকে অবশ্যি সেই নির্দিষ্ট নিয়মপন্থা অনুসরণ করতে হবে। এ সময় মাওলানা মওদূদী (রঃ) এই কথাগুলো পরিষ্কারভাবে সকলের দৃষ্টিগোচর করা নিজের দায়িত্ব মনে করেন এবং সে হিসেবে ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ষ্ট্রেচী হলে এ সম্পর্কে এক অনুপম বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যের শিরোনাম ছিল “ইসলামী হুকুমত কেসতরাহ কায়েম হোতি হায়?” এর সরল অনুবাদ হলো, ‘ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?’ বক্তব্যটি সাথে সাথে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়। অবশ্য বাংলা ভাষায় এটি ‘ইসলামী বিপ্লবের পথ’ নামে পরিচিত।
কয়েক দশক আগে পুস্তিকাটি বাংলা সাধু ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়। এ যাবত পুস্তিকাটির বহু সংস্করণ মুদ্রিত হয়েছে। বহুবারের মুদ্রণের ফলে এতে স্থায়ীভাবে কিছু মুদ্রণজনিত ত্রুটি ঢুকে পড়ে। সে কারণে এবং চলতি ভাষার দাবী পূরণের লক্ষ্যে পুস্তিকাটি আমরা পুনঃ অনুবাদ করেছি চলতি ভাষায়।
এই বক্তব্যটি পুস্তিকাকারে প্রকাশের সময় মাওলানা মওদূদী (রঃ) নিজেই প্রচলিত বাইবেল থেকে ইসলামী রাষ্ট্র সংক্রান্ত হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের কিছু বাণী এর সাথে সংযোজন করে দেন। এই নতুন সংস্করণে আমরা সেই সংযোজনটিও সন্নিবেশিত করে দিয়েছি।
বাংলাদেশে যারা ইসলামী বিপ্লব সাধন করতে চান, পুস্তিকাটি আগেও তাদের দিশারী ছিল, ভবিষ্যতেও অম্লান দিশারীর কাজ করবে বলে আমরা আশা করি।
আব্দুস শহীদ নাসিম ১৮.১১.১৯৯১
“গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা তো সেইসব লোকদের হাতেই আসবে, যারা ভোটারদের সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হবে। ভোটারদের মধ্যে যদি ইসলামী চিন্তা ও মানসিকতাই সৃষ্টি না হয়, যথার্থ ইসলামী নৈতিক চরিত্র গঠনের আগ্রহই যদি তাদের না থাকে এবং ইসলামের সেই সুবিচারপূর্ণ অলংঘনীয় মূলনীতিসমূহ তারা মেনে চলতে প্রস্তুত না হয়, যেগুলোর ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, তবে তাদের ভোটে কখনো খাঁটি মুসলমান নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে আসতে পারবে না।”
“এ কাজের জন্যে এমন একদল দুঃসাহসী যুবকের প্রয়োজন, যারা সত্যের প্রতি ঈমান এনে তার উপর পাহাড়ের মতো অটল হয়ে থাকবে। অন্য কোনো দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হবেনা। পৃথিবীতে যা-ই ঘটুক না কেন, তারা নিজেদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের পথ থেকে এক ইঞ্চিও বিচ্যুত হবেনা।”
ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
স্বাভাবিক নিয়মে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার কর্মপন্থা আমি সুস্পষ্টভাবে এ প্রবন্ধে তুলে ধরতে চাই। আমি দেখতে পাচ্ছি, বর্তমানে ইসলামী রাষ্ট্রের নাম শিশুদের খেলনায় পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন পন্থা ও শ্রেণীর লোকেরা ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা ও তা প্রতিষ্ঠার খেয়াল ব্যক্ত করছেন। কিন্তু এই লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্যে এমন সব অদ্ভুত পথ ও পন্থার প্রস্তাব তারা করছেন, যেসব পথ ও পন্থায় এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়া সেরকমই অসম্ভব, মটর গাড়ীতে করে আমেরিকায় পৌঁছা যেরকমই অসম্ভব। এরকম অসার কল্পনার (Loose thinking) কারণ হলো, কোন না কোন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণে তাদের অন্তরে এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার খায়েশ পয়দা হয়ে গেছে, যার না হবে “ইসলামী রাষ্ট্র”। কিন্তু এই রাষ্ট্রটির ধরণ ও বৈশিষ্ট্য কি হবে, নিরেট বৈজ্ঞানিক (Scientific) পন্থায় তারা তা জানার চেষ্টা করেনি। আর এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিতই বা হয় কোন্ পন্থায়, তাও জানবার কোশেশ তারা করেনি। এমতাবস্থায়, বিষয়টিকে বৈজ্ঞানিক পন্থায় ভালোভাবে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন অনুভব করছি।
মূল বইকে ৬ টি ভাগে ভাগ করা যায়:
১. রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তন।
২. আদর্শিক রাষ্ট্র।
৩. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র ।
৪. ইসলামী বিপ্লবের পদ্বতি।
৫. অবাস্তব ধারণা-কল্পনা।
৬. ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মনীতি।
১. রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তন:
* রাষ্ট্র ব্যবস্থা তো কোন একটি সমাজের মধ্যকার নৈতিক চরিত্র, চিন্তাচেতনা, মন মানসিকতা, সভ্যতা সংস্কৃতি এবং ইতিহাস এতিহ্যগত কার্যকারণের সমন্বিত কর্ম প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নিয়মে জন্ম লাভ করে।
* আর রাষ্ট্রের প্রকৃতি কি হবে ? তাও নির্ভর করে সমাজের সেই পরিবেশ ও দৃষ্টিভংগির উপর , যার চাপের ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্র জন্ম লাভ করে ।
* আমরা যে বিশেষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, সে প্রকৃতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সে রকম আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে । সে রকম ব্যক্তিগত, দলীয় ও সামাজিক চরিত্র , প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নেতৃত্ব এবং সামাজিক কার্যক্রম ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে ।
২. আদর্শিক রাষ্ট্র:
ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম বৈশিষ্ট্য হল ।
ক. এখানে জাতীয়তাবাদের নাম গন্ধও অনুপস্থিত। এটা হলো IDEOLOGICAL STATE’ যার আদর্শ গ্রহন করে নিলে বংশ , গোত্র ও বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশীদার হয়ে যাবে । খৃষ্টবাদ, ফরাসী বিপ্লব, কমিউনিজম ইত্যাদি এ আশা ক্ষীণ ভাবে জাগ্রত করলে ও জাতীয়তাবাদের তীর্যক ভাবধারায় সমুদ্রের অতল তলদেশে ডুবিয়ে দিয়েছে।
খ. এ রাষ্ট্রব্যবস্থা গোটা মানবজাতিকে তার আদর্শ গ্রহন করে অজাতীয়তাবাদী বিশ্বজনীন রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানায়।
গ. বর্তমান বিশ্বে এমন একটি রাষ্ট্রের ধারণা অপরিচিত। তা কেবল অমুসলিমদের কাছেই নয় বরং মুসলমানরা পর্যন্ত এর অনর্তনিহিত ভাবধারা অনুধাবন করতে অক্ষম।
১. ইসলামী রাষ্ট্রই আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র।
২. সংকীর্ন জাতীয়তাবাদ হতে সম্পূর্ন মুক্ত।
৩. অন্যান্য রাষ্ট্রনীতি হতে সম্পূর্ণ পৃথক।
৪. জনগনের অধিকার সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা।
৫. যোগ্যতার বলে যে কেউ শাসক হতে পারে।
৬. আদর্শ হবে ইসলাম।
৭. উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
৮. সার্বভৌমত্ব হবে আল্লাহর, প্রতিনিধিত্ব হবে জনগনের।
৩. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র:
* ইসলামী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট হল, তার গোটা অট্টালিকা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত ।
* এই রাষ্ট্রের প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে, এখানে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করে।
* এই খিলাফাত প্রতিষ্ঠার কাজে এমন সব লোকই অংশীদার হবে, যারা এই আইন ও বিধানের প্রতি ঈমান আনবে এবং তা অনুসরণ ও কার্যকর করার জন্য প্রস্তুত থাকবে।
* সামষ্টিক ভাবে আমাদের সকলকে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের প্রত্যেককে এর জন্য মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
* ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক, ভোটার , সেনা প্রধান , রাষ্ট্রদূত, মন্ত্রীবর্গ, মোটকথা নিজেদের সমাজ জীবনের প্রতিটি বিভাগ, পরিচালিকা যন্ত্রের প্রতিটি অংশ সম্পূর্ণ নতুনভাবে নিজস্ব ভিত্তিতে ঢেলে সাজাতে হবে।
* এ রাষ্ট্রের পরিচালকদের অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকবে।
* পৃথিবীর ধনভান্ডার হস্তগত হলেও নিখাদ আমানতদার প্রমানিত হবে।
* ক্ষমতা হস্তগত হলে জনগনের কল্যান চিন্তায় যারা বিনিদ্র রজনী কাটাবে।
* জনগণ ও তাদের সুতীব্র দায়িত্বানুভূতিপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণাধীনে নিজেদের জানমাল, ইজ্জত আবরুসহ যাবতীয় ব্যাপারে সম্পুর্ণ নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত …………..
৪. ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি:
ক. ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য প্রথমে এমন একটি আন্দোলন প্রয়োজন যে আন্দোলনের মধ্যে ইসলামের প্রাণশক্তির সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল।
খ. এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় এমনসব বিশেষজ্ঞ তৈরী হবে যারা নিজেদের মন মানসিকতা , ধ্যানধারনা ও চিন্তা দর্শনের দিক থেকে হবে পূর্ণ মুসলিম। যাদের ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে বাস্তবধর্মী এক পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নীল নকশা তৈরী করার থাকবে পূর্ণাংগ যোগ্যতা ।
গ. প্রভাবশালী লোকদের আন্দোলনে সমম্পৃক্ত করা
৫. অবাস্তব ধারণা কল্পনা: কিছু লোকের ধারণা।
ক. মুসলমানরা সংগঠিত হলেই তাদের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মূলত জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় না।
খ. “মুসলমান” একটি বংশগত বা ঐতিহাসিক জাতির ধারণা , শুধু সেই জাতিটিরই কেবল উন্নতি সাধন করা এবং একটি জাতীয় রাষ্ট্র ও অর্জিত হতে পারে । কিংবা কমপক্ষে দেশ শাসনে ভাল একটা অংশীদারিত্ব লাভ হতে পারে। কিন্তু ইসলামী বিপ্লব বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে এটাকে প্রথম পদক্ষেপ ও বলা যেতে পারে না।
৬. ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মণীতি:
ক) এক আল্লাহর একচ্ছত্র ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে মানবজীবনের পরিপূর্ণ ইমারত রচনা করার প্রচেষ্টা ও আন্দোলনকে বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে বলা হয় ইসলাম।
খ) মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সা:) এর অনুসৃত পথেই ইসলামী আন্দোলনের কর্মনীতি পরিচালনা করা।
সংযোজন
উপরোক্ত নিবন্ধে ইসলামী বিপ্লবের কর্মপন্থা সম্পর্কে যে স্পষ্ট ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পেশ করা হলো, যদিও বিষয়টি অবহিত হবার জন্যে তাই যথেষ্ট, তারপরও এ সম্পর্কে হযরত মসীহ আলাইহিস সালামের কিছু বক্তব্য বিশেষ পরস্পরার সাথে এখানে উল্লেখ করা উপযোগী মনে করছি। তাঁর এ বক্তব্যগুলোতে ইসলামী আন্দোলনের প্রাথমিক অধ্যায়ের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। সাইয়্যেদুনা মসীহ আলাইহিস সালাম যে পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে ফিলিস্তিনবাসীদের কাছে ‘হুকুমাতে ইলাহিয়ার’ দাওয়াত পেশ করেছিলেন, যেহেতু তার সাথে আমাদের বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতির মিল রয়েছে, সে জন্যে তাঁর কর্মপন্থার মধ্যে আমাদের জন্যে প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ পাওয়া যেতে পারে।
“একজন আলেম জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মূসার দেওয়া হুকুমের মধ্যে সবচেয়ে দরকারী হুকুম কোনটা’? উত্তরে ঈসা বলিলেন, সবচেয়ে দরকারী হুকুম এই, ‘ইস্রায়েলীয়রা শুন, প্রভু, যিনি আমাদের খোদা, তিনি এক; আর তোমার সমস্ত অন্তর, তোমার সমস্ত প্রাণ, তোমার সমস্ত মন এবং সমস্ত শক্তি দিয়া, প্রভু, যিনি তোমার খোদা, তাঁহাকে মহাব্বত করিবে।’ তখন সেই আলেম বলিলেন, ‘হুজুর খুব ভাল কথা। আপনি সত্য কথাই বলিয়াছেন, খোদা এক এবং তিনি ছাড়া আর কোনো খোদা নাই।’ ” (মার্ক/১২:২৮-৩২)
“প্রভু, যিনি তোমার খোদা, তাঁহাকেই তুমি সিজদা করিবে, কেবল তাহারই সেবা করিবে।” (লুক/৪:৮)
“এই জন্যে তোমরা এইভাবে মুনাজাত করিও, আমাদের বেহেশতি পিতা, তোমার নাম পবিত্র বলিয়া মান্য হোক। তোমার রাজ্য আসুক। তোমার ইচ্ছা যেমন বেহেস্তে, তেমনি দুনিয়াতেও পূর্ণ হোক।” (মথি/৬:৯-১০)
শেষ বাক্যটিতে হযরত মসীহ (আঃ) তাঁর উদ্দেশ্যের কথা সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। সাধারণভাবে খোদার বাদশাহী বলতে কেবল তাঁর আধ্যাত্মিক বাদশাহীর যে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার লাভ করেছে, এ বাক্য তা পুরোপুরিভাবে খন্ডন করে দিয়েছে। পৃথিবীতে খোদার আইন ও শরয়ী বিধানের তেমনি প্রতিষ্ঠাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো, যেমনি সমগ্র সৃষ্টির উপর তাঁর প্রাকৃতিক আইন কার্যকর রয়েছে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই তিনি লোকদের তৈরি করছিলেন।
“আমি দুনিয়াতে শান্তি দিতে আসিয়াছি, এই কথা মনে করিওনা; আমি শান্তি দিতে আসি নাই। বরং মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করাইতে আসিয়াছি; ছেলেকে পিতার বিরুদ্ধে, মেয়েকে মায়ের বিরুদ্ধে, বউকে শ্বাশুড়ির বিরুদ্ধে দাঁড় করাইতে আসিয়াছি। নিজের পরিবারের লোকেরাই মানুষের শত্রু হইবে।”
“যে কেহ আমার চাইতে পিতা মাতাকে বেশী মহব্বত করে, সে আমার উপযুক্ত নয়। আর যে কেহ ছেলে বা মেয়েকে আমার চেয়ে বেশী মহব্বত করে, সে আমার উপযুক্ত নয়। যে নিজের ক্রুশ লইয়া আমার পথে না চলে, সেও আমার উপযুক্ত নয়। যে কেহ নিজের জীবন রক্ষা করিতে চায়, সে তাহার সত্যিকারের জীবন হারাইবে; কিন্তু যে কেহ আমার জন্যে তাহার জীবন কোরবানী করিতে রাজী থাকে, সে তাহার সত্যিকারের জীবন রক্ষা করিবে।” (মথি/১০:৩৪-৩৯)
“যদি কেহ আমার পথে আসিতে চায়, তবে সে নিজের ইচ্ছামতো না চলুক; নিজের ক্রুশ বহন করিয়া আমার পিছে আসুক।” (মথি/১৬:২৪)
“ভাই ভাইকে এবং পিতা ছেলেকে মারিয়া ফেলিবার জন্যে ধরাইয়া দিবে। ছেলে মেয়েরা পিতা মাতার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া তাহাদের খুন করাইবে। আমার জন্যে সকলে তোমাদের ঘৃণা করিবে, কিন্তু যে শেষ পর্যন্ত স্থির থাকিবে, সে উদ্ধার পাইবে।” (মথি/১০:২১-২২)
“দেখ, আমি নেকড়ে বাঘের মধ্যে ভেড়ার মতো তোমাদের পাঠাইতেছি। সাবধান থাকিও, কারণ মানুষ বিচার সভার লোকদের হাতে তোমাদের ধরাইয়া দিবে এবং তাহাদের মজলিশ খানায় তোমাদের বেত মারিবে। আমার জন্যই শাসনকর্তা ও রাজাদের সামনে তোমাদের লইয়া যাওয়া হইবে।” (মথি/১০:১৬-১৮)
“যে আমার নিকট আসিবে, সে যেন নিজের পিতা মাতা, স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে, ভাইবোন, এমনকি নিজেকে পর্যন্ত যেন আমার চেয়ে কম প্রিয় মনে করে। তাহা না হইলে সে আমার উম্মত হইতে পারে না। যে লোক নিজের ক্রুশ বহন করিয়া আমার পিছনে না আসে, সে আমার উম্মত হইতে পারেনা।”
“আপনাদের মধ্যে যদি কেহ একটা উচু ঘর তৈরি করিতে চায়, তবে সে আগে বসিয়া খরচের হিসাব করে। সে দেখিতে চায় যে, উহা শেষ করিবার জন্য তাহার যথেষ্ট টাকা আছে কি-না। তাহা না হইলে, সে ভিত্তি গাঁথিবার পরে যদি সে উচু ঘরটা শেষ করিতে না পারে, তবে যাহারা উহা দেখিবে তাহারা সকলে তাহাকে ঠাট্টা করিবে। তাহারা বলিবে, ‘লোকটা গাঁথিতে আরম্ভ করিয়াছিল কিন্তু শেষ করিতে পারিলনা।’ সেইভাবে আপনাদের মধ্যে যদি কেহ ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার সমস্ত কিছু ছাড়িয়া না আসে, তবে সে আমার উম্মত হইতে পারে না।” (লুক/১৪:২৬-৩০)
এ সবগুলো আয়াত এ কথাই প্রমাণ করে যে, মসীহ (আঃ) কেবল একটি ধর্ম প্রচারের জন্যেই আবির্ভূত হননি, বরঞ্চ গোটা সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করাই ছিলো তাঁর মূল উদ্দেশ্য। তাই, গোটা রোম সাম্রাজ্য, ইহুদী রাষ্ট্র এবং ফকীহ ও ফরীশীদের নেতৃত্ব, এক কথায় সকল আত্মপূজারী ও স্বার্থন্বেষীদের সাথে তাঁর সংঘাত সংঘর্ষের সমূহ আশংকা ছিলো বিদ্যমান। তাই তিনি সুস্পষ্টভাবে সবাইকে বলে দিচ্ছিলেন, আমি যে কাজ করতে যাচ্ছি তা সাংঘাতিক বিপজ্জনক। আমার সাথে কেবল তাদেরই আসা উচিত, যারা এ সকল বিপদ মুসীবত বরদাশত করতে প্রস্তুত হবে।
“তোমাদের সঙ্গে যে খারাপ ব্যবহার করে, তাহার বিরুদ্ধে কিছুই করিও না। বরং যে কেহ তোমার ডান গালে চড় মারে, তাহাকে অন্য গালেও চড় মারিতে দিও। যে কেহ তোমার কোর্তা লইবার জন্যে মামলা করিতে চায়, তাহাকে তোমার চাদরও লইতে দিও। যে কেহ তোমাকে তাহার বোঝা লইয়া এক মাইল যাইতে বাধ্য করে, তাহার সঙ্গে দুই মাইল যাইও।” (মথি/৫:৩৯-৪১)
“যাহারা কেবল দেহ ধ্বংস করে, কিন্তু রূহকে ধ্বংস করতে পারে না, তাহাদের ভয় করিও না। যিনি দেহ ও রূহ দুইটিই দোযখে ধ্বংস করিতে পারেন, বরং তাহাকেই ভয় করো।” (মথি/১০:২৮)
“এই দুনিয়াতে তোমরা নিজেদের জন্যে ধন সম্পদ জমা করিও না। এখানে মরিচায় ধরে ও পোকায় নষ্ট করে এবং চোর ঢুকিয়া চুরি করে। বরং বেহেশতে তোমাদের ধন জমা করো।” (মথি/৬:১৯-২০)
“কেহ দুই মনিবের সেবা করিতে পারে না। খোদা এবং ধন সম্পত্তি এই দুইয়েরই এক সঙ্গে সেবা করিতে পার না। কি খাইবে বলিয়া বাঁচিয়া থাকিবার বিষয়ে, কিংবা কি পরিবে বলিয়া দেহের বিষয়ে চিন্তা করিও না। বনের পাখিদের দিকে তাকাইয়া দেখ; তাহারা বীজ বুনেনা, ফসল কাটেনা, গোলাঘরে জমাও করেনা, আর তবু তোমাদের বেহেশতি পিতা তাহাদের খাওয়াইয়া থাকেন। তোমরা কি তাহাদের চেয়ে আরও মূল্যবান নও? তোমাদের মধ্যে কে চিন্তা ভাবনা করিয়া নিজের আয়ু এক ঘন্টা বাড়াইতে পারে? কাপড় চোপড়ের জন্য কেন চিন্তা করো? মাঠের ফুলগুলির কথা ভাবিয়া দেখ, সেইগুলি কেমন করিয়া বাড়িয়া উঠে। তাহারা পরিশ্রম করেনা, সুতাও কাটেনা। কিন্তু তোমাদের বলিতেছি, সোলায়মান রাজা এতো জাঁকজমকের মধ্যে থাকিয়াও এইগুলির একটার মতোও নিজেকে সাজাইতে পারেন নাই। মাঠের যে ঘাস আজ আছে, আর আগামী কাল চুলায় ফেলিয়া দেওয়া হইবে, তাহা যখন খোদা এইভাবে সাজান; তখন ওহে অল্প বিশ্বাসীরা, তিনি যে তোমাদের নিশ্চয়ই সাজাইবেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু তোমরা প্রথমে খোদার রাজ্যের বিষয়ে এবং তাহার ইচ্ছামতো চলিবার জন্যে ব্যস্ত হও। তাহা হইলে ঐ সমস্ত জিনিসও তোমরা পাইবে।” (মথি/১৬:২৪-৩৩)
“চাও, তোমাদের দেওয়া হইবে; খোঁজ কর, পাইবে; দরজায় আঘাত কর, তোমাদের জন্যে খোলা হইবে।” (মথি/৭:৭) সাইয়্যেদুনা ঈসা (আঃ) বৈরাগ্যবাদ, ত্যাগ এবং আজন্ম কৌমার্যের শিক্ষাদান করেছেন বলে সাধারণে ভ্রান্ত ধারণা গড়ে উঠেছে। অথচ! এই বিপ্লবের সূচনাকালে লোকদের ধৈর্য্য, কষ্ট সহিষ্ণুতা এবং আল্লাহ নির্ভরতার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দান ছাড়া কোনো গত্যন্তরই ছিলনা। যেখানে একটি রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা পূর্ণ শক্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং মানবজীবনের সমস্ত উপায় উপকরণ কব্জা করে রেখেছে, সেখানে কোনো একটি দল পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব সাধণের জন্যে অগ্রসর হতে পারেনা, যতোক্ষণ না সে মন মগজ থেকে জানমালের মহব্বত দূরে নিক্ষেপ করবে, দুঃখ কষ্ট ও বিপদাপদ বরদাশত করার জন্যে প্রস্তুত হবে, বহু পার্থিব লাভ কোরবানী করতে এবং অসংখ্য পার্থিব ক্ষতি স্বীকার করতে তৈরি হয়ে যাবে।
প্রকৃতপক্ষে সমকালীন প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অর্থই হলো, সমস্ত বিপদ মুসীবতকে নিজেদের উপর ডেকে আনা। এ মহান কাজের জন্যে যারা উত্থিত হবে, তাদেরকে এক থাপ্পড় খেয়ে আরেক থাপ্পড়ের জন্যে অবশ্যি প্রস্তুত থাকতে পবে। জামা হাতছাড়া হলে চোগা হারাবার জন্যেও প্রস্তুত থাকতে হবে। সমকালীন জীবিকার ভান্ডার যাদের মুষ্টিবদ্ধে, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আবার তাদের থেকে অন্ন বস্ত্র লাভ করার আশা করা যেতে পারে না। তাই কেবল সেই ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম, যে এসব উপায় উপকরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে, কেবল এক আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয়ে যাবে।
“তোমরা যাহারা ক্লান্ত ও বোঝা বহিয়া বেড়াইতেছ, তোমরা সকলে আমার নিকট আস; আমি তোমাদের বিশ্রাম দিব। কারণ আমার জোয়াল বহন করা সহজ ও আমার বোঝা হাল্কা।” (মথি/১১:২৮-৩০)
সম্ভবত এর চাইতে সংক্ষেপে এবং মর্মস্পর্শী ভাষায় হুকুমাতে ইলাহীয়ার মেনিফেস্টো সংকলন করা যেতে পারে না। মানুষের উপর মানুষের জোয়াল অত্যন্ত কঠিন এবং ভারী। এ বোঝার তলায় পিষ্ট মানুষকে হুকুমাতে ইলাহীয়ার নকীব যে সংবাদ শুনাতে পারেন, তা হলো, যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার জোয়াল আমি তোমাদের উপর রাখতে চাই, তা যেমনি কোমল তেমনি হাল্কা।
“অইহুদীদের মধ্যে রাজারা প্রভুত্ব করেন। আর তাহাদের শাসনকর্তাদের বলা হয় উপকারী নেতা, কিন্তু তোমাদের মধ্যে এই রকম হওয়া উচিত নয়। তোমাদের যে সবচেয়ে বড়, সে বরং সবচেয়ে যে ছোট তাহারই মত হোক, আর যে নেতা সে সেবাকারীর মতো হোক।” (লুক/২২:২৫-২৬)
মসীহ আলাইহিস সালাম তাঁর সাথীদেরকেই (হাওয়ারী) এসব উপদেশ দিতেন। এ বিষয়ে ইঞ্জিলগুলোতে বেশ কিছু বাণী বর্তমান রয়েছে। সেগুলোর সারকথা হলো, ফেরাউন এবং নমরূদদের হটিয়ে তোমরা নিজেরাই আবার ফেরাউন নমরূদ হয়ে বসো না।
“মূসার শরীয়ত শিক্ষা দিবার ব্যাপারে আলেমরা ও ফরীশীরা মূসার জায়গায় আছেন। এই জন্য তাহারা যাহা কিছু করিতে বলেন, তাহা করিও এবং যাহা পালন করিবার আদেশ করেন, তাহা পালন করিও। কিন্তু তাহারা যাহা করেন, তোমরা তাহা করিও না। কারণ তাহারা মুখে যাহা বলেন, কাজে তাহা করেন না। তাহারা ভারী ভারী বোঝা বাঁধিয়া মানুষের কাঁধে চাপাইয়া দেন, কিন্তু সেইগুলি সরাইবার জন্য নিজেরা একটা আঙ্গুল নাড়াইতেও চান না। লোকদের দেখাইবার জন্যেই তাহারা সমস্ত কাজ করেন। পাক কিতাবের আয়াত লেখা তাবিজ তাহার বড় করিয়া তৈরি করেন। আর নিজেদের ধার্মিক দেখাইবার জন্য চাদরের কোণায় কোণায় লম্বা ঝালর লাগান। ভোজের সময়ে সম্মানের জায়গায় এবং মজলিশখানায় প্রধান আসনে তাহারা বসিতে ভালবাসেন। তাহারা হাটে বাজারে সম্মান খুঁজিয়া বেড়ান আর চান, যেন লোকেরা তাহাদের ওস্তাদ (রাব্বী) বলিয়া ডাকে।”
“ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ধিক আপনাদের! আপনারা! লোকদের সামনে বেহেশতি দরজা বন্ধ করিয়া রাখেন। তাহাতে নিজেরাও ঢুকেন না, আর যাহারা ঢুকিতে চেষ্টা করিতেছে, তাহাদেরও ঢুকিতে দেন না।”
“ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ধিক আপনাদের! একটি মাত্র লোককে আপনাদের ধর্মমতে আনিবার জন্যে আপনারা দুনিয়ার কোথায় না যান। আর সে যখন আপনাদের ধর্মমতে আসে, তখন আপনারা নিজেদের চেয়ে তাহাকে অনেক বেশী করিয়া তোলেন।”
“আপনারা নিজেরা অন্ধ অথচ অন্যদের পথ দেখান। একটা ছোট মাছিও আপনারা ছাঁকেন অথচ উট গিলিয়া ফেলেন।”
“ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ধিক আপনাদের! আপনারা চুন লাগানো সাদা কবরের মতো, যাহার বাহিরের দিকটা সুন্দর, কিন্তু ভিতরে মরা মানুষের হাড় গোড় ও সমস্ত রকম ময়লায় ভরা। ঠিক সেইভাবে বাহিরে বাহিরে আপনারা লোকদের চোখে ধার্মিক, কিন্তু ভিতরে ভণ্ডামী ও পাপে পূর্ণ।” (মথি/২৩:২-২৮)
সে সময়কার আলেম ও শরীয়তের ধারক বাহকদের এ ছিলো অবস্থা। ইলমের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবল আত্মপূজার কারণে তারা ছিলো গুমরাহ, পথভ্রষ্ট। সাধারণ লোকদেরও তারা ভ্রান্তপথে পরিচালিত করছিলো, আর এই বিপবের পথে রোমের কাইজারদের থেকেও তারা বড় প্রতিবন্ধক ছিলো।
“তখন ফরীশীরা চলিয়া গেলেন এবং কেমন করিয়া ঈসাকে তাঁহার কথার ফাঁদে ফেলা যায়, সেই পরামর্শ করিতে লাগিলেন। তাহারা হেরোদের দলের কয়েকজন লোকের সঙ্গে নিজেদের কয়েকজন সাগরেদকে ঈসার নিকট পাঠাইলেন। তাহার ঈসাকে বলিল, ‘হুজুর, আমরা জানি, আপনি একজন সৎলোক। খোদার পথের বিষয়ে আপনি সত্যভাবে শিক্ষা দিয়া থাকেন। লোকে কি মনে করিবে না করিবে, তাহাতে আপনার কিছু যায় আসে না। কারণ, আপনি কাহারও মুখ চাহিয়া কিছু করেন না। তাহা হইলে আপনি বলুন, রোম সম্রাটকে কি কর দেওয়া হালাল? আপনার কি মনে হয়? তাহাদের খারাপ উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়া ঈসা বলিলেন, ‘ভণ্ডেরা, কেন আমাকে পরীক্ষা করিতেছ? যে টাকায় কর দিবে তাহার একটা আমাকে দেখাও।’ তাহারা একটা দীনার ঈসার নিকট আনিল। তখন ঈসা তাহাদের বলিলেন, ‘ইহার উপর এই ছবি ও নাম কাহার?’ তাহার বলিল, ‘রোম সম্রাটের’। ঈসা তাহাদের বলিলেন, ‘তবে যাহা সম্রাটের তাহা সম্রাটকে দাও, আর যাহা খোদার তাহা খোদাকে দাও।’ (মথি/২২:১৫-২১)
এ ঘটনা থেকে জানা যায়, মূলত এটা ছিলো একটা ষড়যন্ত্র। ফরীশীরা আন্দোলন পাকা হবার অাগেই সরকারের সাথে হযরত ঈসার (আঃ) সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দিতে এবং আন্দোলন শিকড় গেড়ে বসার আগেই সরকারী শক্তি দ্বারা তাকে মূলোৎপাটিত করে দিতে চাইছিলো। সে কারণে হেরোদী রাষ্ট্রের সিআইডিদের সামনে রোম সম্রাটকে কর দেয়া বৈধ কিনা, সে প্রশ্ন তারা উত্থাপন করেছিল। জবাবে হযরত ঈসা (আঃ) যে নিগূঢ় অর্থবহ কথাটি বলেছিলেন, বিগত দু’হাজার বছর থেকে খ্রীষ্টান অখ্রীষ্টান সকলে তার এই অর্থই করে আসছে যে, ইবাদত কর খোদার আর অনুগত্য কর সমকালীন প্রতিষ্ঠিত সরকারের। কিন্তু আসলে তিনি একথাও বলেননি যে, রোম সম্রাটকে কর দেয়া বৈধ। কারণ এমনটা বলা ছিলো তাঁর দাওয়াতের পরিপন্থী। আর তাকে ট্যাক্স না দেয়ার কথাও তিনি বলেননি। কারণ তখন পর্যন্ত তাঁর আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছায়নি যে, তিনি কর প্রদান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন। এ জন্যেই তিনি তখন একটি সূক্ষ্ম কথা বলে দিলেন যে, কাইজারের নাম এবং ছবি তাকে ফেরত দাও। আর খোদা যে নিখাঁদ সোনা তৈরি করেছেন, তা তার পথে ব্যয় করো।
তাদের এ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবার পর তারা স্বয়ং মসীহ আলাইহিস সালামের জনৈক সাহাবীকে ঘুষ দিয়ে এমন এক সময় মসীহ আলাইহিস সালামকে গ্রেফতার করিয়ে দিতে সম্মত করায়, যখন গণবিদ্রোহের কোনো আশংকা থাকবে না। তাদের এ ষড়যন্ত্র সফল হয়। ইহুদী সক্রীটু হযরত মসীহকে গ্রেফতার করিয়ে দেয়।
“তখন সেই সভার সকলে উঠিয়া ঈসাকে প্রধান শাসনকর্তা পীলাতের নিকট লইয়া গেলেন। তাহারা এই কথা বলিয়া ঈসার বিরুদ্ধে নালিশ জানাইতে লাগিলেন, ‘আমরা দেখিয়াছি, এই লোকটা সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের লোকদের লইয়া যাইতেছে। সে সম্রাটকে কর দিতে নিষেধ করে এবং বলে, সে নিজেই মসীহ, একজন রাজা।’ ”
“তখন পীলাত প্রধান ইমামদের এবং সমস্ত লোকদের বলিলেন, ‘আমিতো এই লোকটির কোন দোষই দেখিতে পাইতেছি না।’ কিন্তু তাহারা জিদ করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘এহুদিয়া প্রদেশের সমস্ত জায়গায় শিক্ষা দিয়া সে এ লোকদের ক্ষেপাইয়া তুলিতেছে। গালীল প্রদেশ হইতে সে শুরু করিয়াছে, আর এখন এখানে আসিয়াছে।’ ”
“কিন্তু লোকেরা ঈসাকে ক্রুশের উপর মারিয়া ফেলিবার জন্যে চিৎকার করিতে থাকিল এবং শেষে তাহার চেঁচাইয়া জয়ী হইলো।” (লুক/২৩: ১-২৩)
এভাবেই ঐ সমস্ত লোকদের হাতে মসীহ আলাইহিস সালামের মিশনের পরিসমাপ্তি ঘটে, যারা নিজেদেরকে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের উত্তরাধিকারী মনে করতো। ঐতিহাসিক সাক্ষ্য প্রমাণ অনুযায়ী মসীহ আলাইহিস সালামের নবুয়্যতকাল ছিলো দেড় থেকে তিন বছরের মতো। এ সংক্ষিপ্ত সময়কালে তিনি ঐ পরিমাণ কাজ করেছিলেন, যতোটা করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর মক্কী জীবনের প্রাথমিক দুই তিন বছরে। কোনো ব্যক্তি যদি ইঞ্জিলের উপরোল্লিখিত আয়াতগুলোর সাথে কুরআন মজীদের মক্কী সূরাসমূহ এবং মক্কায় অবস্থানকালীন হাদীসগুলোকে মিলিয়ে দেখেন, তবে তিনি এতদোভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামঞ্জস্য দেখতে পাবেন।