হাসানুল বান্নার জীবনী - Biography of Hasanul Banna
শেখ হাসান আহমদ আব্দুর রহমান মুহাম্মদ আল-বান্না ( আরবি: حسن أحمد عبد الرحمن محمد البنا ), হাসান আল-বান্না নামে পরিচিত ( আরবি: حسن البنا ) ছিলেন একজন মিশরীয় স্কুল শিক্ষক এবং ইমাম। যিনি মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত যা একটি বৃহত্তম এবং প্রভাবশালী ইসলামী পুনরুজ্জীবনবাদী সংগঠন।
আল-বান্নার লেখাগুলি ইসলামের উপর ভিত্তি করে একটি আধুনিক মতাদর্শ উপস্থাপনের মাধ্যমে ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে একটি বাঁক-বিন্দু চিহ্নিত করেছে। আল-বান্না ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা বলে মনে করেন, যেখানে কোরআনই একমাত্র গ্রহণযোগ্য সংবিধান। তিনি রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও সমাজের ইসলামীকরণের আহ্বান জানান। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিষ্ঠানের বিকাশ এবং প্রগতিশীল কর ব্যবস্থার প্রয়োজন, এবং একটি ইসলামিক আর্থিক তত্ত্ব বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যেখানে বৈষম্য কমানোর জন্য সামাজিক ব্যয়ের জন্য জাকাত সংরক্ষিত থাকবে।
প্রাথমিক জীবন
হাসান আল-বান্না ১৯০৬ সালের ১৪ অক্টোবর কায়রোর উত্তর-পশ্চিমে বেহেরা গভর্নরেটের গ্রামীণ নীল ডেল্টা শহরে মাহমুদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
তার পিতা, শেখ আহমাদ আবদ আল-রহমান আল-বান্না আল-সাআতি ছিলেন একজন হাম্বলী ইমাম, মুয়াজ্জিন এবং মসজিদের শিক্ষক। আল-বান্নার প্রথম জীবনে তার বাবা ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক প্রভাব। শেখ আহমদ একজন হাম্বলী পন্ডিত হিসেবে তার কাজের জন্য পরিচিত ছিলেন, বিশেষ করে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল আল-শায়বানীর ঐতিহ্যের তার শ্রেণীবিভাগ। এই শ্রেণীবিভাগগুলি মুসনাদ আল-ফাতহ আল-রব্বানী নামে পরিচিত হয়। এই কাজের মাধ্যমে, শেখ আহমাদ ইসলামিক পণ্ডিতদের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছিলেন যা তার ছেলে ১৯৩২ সালে কায়রোতে চলে যাওয়ার সময় কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল।
হাম্বলি পিউরিটানিজমের সাথে তার প্রথম দিকের প্রভাবাধীন করা ছাড়াও, হাসান আল-বান্না রশিদ রিদার ম্যাগাজিন, আল-মানার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মাহমুদিয়ায় যুবক হিসেবেও তিনি সুফিবাদ দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি সাপ্তাহিক হাদ্রায় যোগ দিতেন এবং আল-হাসাফিয়া সুফি আদেশের সদস্য ছিলেন।
আল-বান্না ১৯১৯ সালের মিশরীয় বিপ্লবের সময় প্রথম মিশরীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মুখোমুখি হন; সে সময় তার বয়স ছিল তেরো বছর। তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে, আল-বান্না নিজেকে সেই সময়ের ব্যাপক সক্রিয়তার সাথে চিহ্নিত করেছিলেন। অল্প বয়স হওয়া সত্ত্বেও, আল-বান্না দামানহুরে বিক্ষোভে অংশ নেন, রাজনৈতিক প্রচারপত্র প্রকাশ করেন এবং যুব সংস্কার সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও আল-বান্নার পরিবার মিশরীয় অভিজাত শ্রেণীর সদস্য ছিল না, তারা মাহমুদিয়ায় তুলনামূলকভাবে সম্মানিত ছিল। শেখ আহমাদের একজন বিশিষ্ট ইমাম ছিলেন এবং পরিবারের কিছু সম্পত্তি ছিল। যাইহোক, ১৯২০ এর দশকের অর্থনৈতিক সংকটের সময়, পরিবারটি তাদের সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ বজায় রাখতে সমস্যায় পড়েছিল এবং ১৯২৪ সালে কায়রোতে চলে আসে।
শিক্ষা জীবন
আট বছর বয়সে শায়খ হাসানুল বান্নার আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় মাদরাসা আর রাশাদ আদ দীনিয়াহ নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। একই সাথে তিনি আল কুরআন হিফয করতে থাকেন।
কিছুকাল পর তিনি মাহমুদিয়ার মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র হন। বছর খানেকের মধ্যেই শায়খ হাসানুল বান্না দামানহুর টিচার্স ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পান। এই স্কুলে লেখাপড়া কালে তিনি দামানহুরের বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিদের নিকট যাতায়াত করতেন। তাঁদের কাছ থেকে তিনি দীনের তালিম হাছিল করেন। এই সময় ব্যাপকভাবে ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়নের দিকেও তিনি মনোযোগ দেন।
টিচার্স ট্রেনিং ডিপ্লোমা পরীক্ষায় তিনি তাঁর স্কুলে প্রথম ও সারাদেশে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন।
অতপর তিনি কায়রো যান এবং আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দারুল উলুমে ভর্তি হন। এই সময় তাঁর আব্বা সপরিবারে মাহমুদিয়া থেকে কায়রোতে স্থানন্তরিত হন।
কায়রোতে অবস্থানকালে শায়খ হাসানুল বান্না মিসরের অন্যতম সেরা ইসলামী ব্যক্তিত্ব শায়খ মাহমুদ কর্তৃক পরিচালিত জামিয়াতুল মাকারিমিল আখলাক আল ইসলামিয়াহ নামক সংস্থার সদস্য হন। এখানে তার আমর বিল মা’রূফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার (সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ) তৎপরতার হাতেখড়ি।
১৯২৭ সনের জুলাই মাসে দারুল উলুম থেকে তিনি ডিপ্লোমা লাভ করেন। এখানেই তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
কর্মজীবন শুরু
১৯২৭ সনের সেপ্টেম্বর মাসে শায়খ হাসানুল বান্না সরকারী স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তাঁকে পোস্টিং দেয়া হয় ইসমাঈলিয়াতে।
ইসমাঈলিয়া সুয়েজখালের সাথে সংযুক্ত তিমসাহ ঝিলের সন্নিকটে অবস্থিত একটি শহর। স্কুলের শিক্ষক হিসেবে তিনি কর্তব্য পালন করতে থাকেন। আর সময় সুযোগ মতো তিনি নিকটবর্তী ক্লাব ও কফি হাউসে গিয়ে দীনী বক্তব্য পেশ করা শুরু করেন।
পরিবার
আল-বান্নার মেয়ে ওয়াফা আল-বান্না সাইদ রমজানের সাথে বিয়ে করেছিলেন, যিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রধান নেতা হয়েছিলেন। তাদের দুই ছেলে, তারিক রমজান এবং হানি রমজান, সমসাময়িক ইসলামিক পণ্ডিতদের পাশাপাশি শিক্ষাবিদ। হাসান আল-বান্নার ছোট ভাই, গামাল আল-বান্না, একজন উদারপন্থী পণ্ডিত এবং ইসলামী সংস্কারের প্রবক্তা ছিলেন।
শায়খ হাসানুল বান্নার সংক্ষিপ্ত অথচ জ্ঞানগর্ভ ইসলামী ভাষণ চিন্তাশীল লোকদেরকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। ১৯২৮ সনের মার্চ মাসে ছয়জন ব্যক্তি তাঁর বাসায় আসেন তাঁর সাথে আলাপ করতে।
শায়খ হাসানুল বান্না তাঁদের সামনের তাঁর চিন্তাধারা পেশ করেন এবং সমাজ অংগনের সর্বত্র ইসলামের প্রধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠিত প্রয়াসের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। দীর্ঘক্ষণ আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে।
এই মিটিংয়ে আগত ছয়জন ব্যক্তি হচ্ছেন-
১. হাফিয আবদুল হামীদ, ২. আহমাদ আল হাসরী, ৩. ফুয়াদ ইবরাহীম, ৪. আবদুর রাহমান হাসবুল্লাহ, ৫. ইসমাইল ইযয ও ৬. যাকী আল মাগরিবী।
শায়খ হাসানুল বান্না চাইলে তখনই আরো অনেককে ডেকে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রতিটি গঠনমূলক আন্দোলনের শুরুতে থাকেন মাত্র একজন লোক। তারপর আরো কিছুসংখ্যক সমমনা লোক যুক্ত হয়ে সংগঠিত তৎপরতা শুরু করেন। গোড়ার দিক কার এই ব্যক্তিদের চিন্তার ঐক্য সংগঠনের ভিতকে দৃঢ়তা দান করে। তাঁদের অভিন্ন বক্তব্য পরবর্তীতে যারা সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হয় তাদের চিন্তার ঐক্য নিশ্চিত করে। আর চিন্তার ঐক্যই যদি না থাকে একটি প্লাটফরমে অসংখ্য লোকের ভীড় জমিয়েও কোন সুফল আশা করা যায় না।
আলোচনান্তে একটি সংগঠন কায়েমের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘আল ইখওয়ানুল মুসলিমূন’। আর এর আলমুরশিদুল আম নির্বাচিত হন শায়খ হাসানুল বান্না। এইভাবে ১৯২৮ সনের মার্চ মাসে মিসরের অন্যতম শহর ইসমাঈলিয়াতে সাতজন সদস্য নিয়ে আল ইখওয়ানুল মুসলিমূন গঠিত হয়। উল্লেখ্য যে তখন শায়খ হাসানুল বান্না ছিলেন ২২ বছরের একজন দীপ্তিমান যুবক।
শায়খ হাসানুল বান্না ভালো করেই জানতেন যে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আল জিহাদু ফিল ইসলাম বা ইসলামী আন্দোলনের প্রধান কাজ হচ্ছে আদ্দা’ওয়াতু ইলাল্লাহ বা আল্লাহর দিকে লোকদেরকে ডাকা। এই কাজ করতে হলে লোকদের সামনে প্রথমেই তুলে ধরতে হয় আল্লাহর পরিচয়, তারপর আল্লাহর পথের তথা ইসলামের পরিচয়। এরপর তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হয় ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর বিধান অনুসরণের সাথে সাথে সামষ্টিক জীবনে আল্লাহর বিধান কায়েম করার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে।
শায়খ হাসানুল বান্নার বিরুদ্ধে অভিযোগ
এই সময় মিসরের মসনদে আসীন ছিলেন কিং ফুয়াদ। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইসমাঈল সিদকী পাশা। আল ইখওয়ান তখনো কোন শক্তিধর সংগঠন ছিলো না। তথাপিও প্রধানমন্ত্রী ইসমাঈল সিদকী পাশা এইটিকে বাঁকা চোখে দেখতেন।
শায়খ হাসানুল বান্না একটি সরকারী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা শরু হলো এই বলে যে তিনি সরকারী টাকা খরচ করে দল গঠন করেছেন। তাঁরা কার্যাবলী পরীক্ষা করার জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটি তদন্ত করে আপত্তিকর কিছুই পেলোনা। আসলে তাঁকে হয়রানি করার ছিলো এই অভিযোগের আসল উদ্দেশ্য।
সরকারী মহল থেকে প্রচারণা শরু হলো যে হাসানুল বান্না কিং ফুয়াদকে ক্ষমতাচ্যুত করা ও রাজতন্ত্র খতম করার জন্য এই সংগঠন গড়ে তুলেছেন।
শায়খ হাসানুল বান্নার প্রথম গ্রেফতারী
অল্প কাল করেই শায়খ হাসানুল বান্না কায়রোতে আসেন ইংরেজ বিরোধী জনমত গড়ে তোলার জন্য। সরকার আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সরকার শায়খ হাসানুল বান্না ও সংগঠনের সেক্রেটারী জেনারেল আবদুল হাকীম আবিদীনকে গ্রেফতার করে। আল ইখওয়ানের পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। অন্য সব পত্রিকায় আল ইখওয়ানের কোন খবর ছাপানো যাবে না বলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। মিছিল ও জনসভা নিষিদ্ধ হয়। সরকারের এই পদক্ষেপ গণ-মনে দারুণ অসন্তোষ সৃষ্টি করে। জনমতের দিকে লক্ষ্য করে সরকার শায়খ হাসানুল বান্না ও আবদুল হাকীম আবিদীনকে মুক্তি দেয়। গ্রেট বৃটেন বরাবরই ইসলামের প্রতি বৈরি মনোভাব পোষণ করে আসছিলো। মিসরে ক্রমবর্ধমান ইসলামী জাগরণ গ্রেট বৃটেনকে শংকিত করে তোলে। কূট-কৌশলের মাধ্যমে ইসলামী শক্তিকে বশে আনা যায় কিনা সেই চেষ্টাও তারা করে। গ্রেট বৃটেনের দূতাবাস থেকে শায়খ হাসানুল বান্নার সাথে যোগাযোগ করা হয়। দূতাবাসের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের লক্ষ্য, কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি জানতে চান। তাঁকে সব জানানো হয়।
সব শুনে তিনি বাহ্যতঃ সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি আল ইখওয়ানকে আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব দেন। বিচক্ষণ শায়খ হাসানুল বান্না ধন্যবাদ সহকারে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। প্রধানমন্ত্রী হুসাইন সিররী পাশা নির্বিঘ্নে শাসন চালাতে পারছিলেন না। ইংরেজদের সাথে তাঁর মাখামাখি জনমনে ক্রোধের সঞ্চার করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে হুসাইন সিররী পাশা পদত্যাগ করেন। কিং ফারুক ওয়াফদ পার্টির নেতা মুসতাফা আন্নাহাস পাশাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।
এই সময় সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসারদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। তারা একদিকে কিং ফারুক ও অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী পরিচালিত প্রশাসনের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা তাদেরকে বিরক্ত করে তোলে। কিছু সংখ্যক তরুণ অফিসার ‘‘ফ্রি অফিসারস’’ নামে একটি গোপন সংস্থা গড়ে তোলে। তারা একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা আঁটছিলো। এই অফিসারগণ দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। আনোয়ারুস সা’দাত ও আবদুন মুনীম আবদুর রউফ শায়খ হাসানুল বান্নার সাথে যোগাযোগ করেন।
শায়খ হাসানুল বান্নার দ্বিতীয় গ্রেফতারী
নির্বাচনের পর আহমাদ মাহির পাশা শক্ত হয়ে বসেন। তিনি ইংরেজদের ইচ্ছা পূরণের উদ্যোগ নেন। সিদ্ধান্ত নেন জার্মেনী ও তুর্কীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার।
১৯৪৫ সনের ২৪ শে ফেব্রুয়ারী আহমাদ মাহির পাশা যুদ্ধে নামার সিদ্ধান্ত সম্বলিত ঘোষণাটি পাঠকালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। প্রচার করা হলো, এটি আল ইখওয়ানের কাজ। শায়খ হাসানুল বান্না, আহমাদ আশ্ শুককারী ও আবদুল হাকী আবিদীনকে গ্রেফতার করা হয়।
আততায়ী ধরা পড়েছিলো। জিজ্ঞাসাবাদের সময় সে স্বীকার যে সে ন্যাশনালিস্ট পার্টির লোক। অতপর শায়খ হাসানুল বান্না ও তাঁর দুইজন সহকর্মীকে মুক্তি দেয়া হয়।
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন মাহমুদ ফাহমী আন্ নুক্রাশী পাশা। শায়খ হাসানুল বান্না তাঁর সাথে দেখা করেন। আহমাদ মাহির পাশার হত্যাতে দুঃখ প্রকাশ করেন। এই সুযোগে তিনি তাঁকে আল ইখওয়ানের লক্ষ্য কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি অবহিত করেন। মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশা আল ইখওয়ানকে ঘৃণা চোখে দেখতেন। শায়খ হাসানুল বান্নার সাক্ষাত ও আলাপের পরও তাঁর মনোভংগির কোনই পরিবর্তন হয়নি। বরং তিনি আল ইখওয়ানের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি আরো বাড়িয়ে দেন। মিসরের জনমত ছিলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে। সুয়েজে ইংরেজদের অবস্থান জনগণ মেনে নিতে পারছিলো না। গ্রেট বৃটেনের প্রতি নতজানু নীতি দেশের গণ-মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তরুণ সমাজ সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মুসতাফা মুমিনের নেতৃত্বে ছাত্রগণ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতার মুখে মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশা পদত্যাগ করেন। উল্লেখ্য যে মুসতাফা মুমিন আল ইখওয়ানের ছাত্র-শাখার একজন নেতা ছিলেন।
১৯৪৬ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন ইসমাইল সিদকী পাশা। তিনিও ইংরেজদের বশংবদ ছিলেন। আল ইখওয়ান গ্রেট বৃটেনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ও আপোসহীন মনোভাব গ্রহণ করার জন্য সরকারের উপর চাপ দিতে থাকে। একই দাবি উত্থাপিত হয় ছাত্র ও শ্রমিকদের পক্ষ থেকে। দেশে দারুণ রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এই অবস্থাতেই ইসমাইল সিদকী পাশা ইংরেজদের সাথে চুক্তির একটি খসড়া প্রকাশ করেন। মিসরের গণ-মানুষ বিক্ষোভের মাধ্যমে তা প্রত্যাখ্যান করে। ৮ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশা আবার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
শায়খ হাসানুল বান্নার শাহাদাত
১৯৪৯ সনের ১২ই ফেব্রুয়ারী।
এই দিন কায়রোতে ইয়াং মুসলিমস এসোসিয়েশানের একটি মিটিংয়ে শায়খ হাসানুল বান্না মেহমান বক্তা হিসেবে আসেন। মিটিং শেষে তিনি উক্ত সংস্থার কার্যালয় থেকে বের হন। রাস্তায় নেমে তিনি ট্যাকসীতে উঠতে যাচ্ছিলেন এমন সময় আততায়ীর গুলি এসে বিঁধে তাঁর বুকে। রক্ত রঞ্জিত দেহ নিয়ে শায়খ হাসানুল বান্না ঢলে পড়েন। সংগীরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। আল্লাহর দীনের সৈনিক আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে চলে যান।
লাশ পাঠানো হয় তাঁর বাসায়। পুলিশ এসে বাড়ির চারদিক ঘেরাও করে ফেলে। নিকট আত্মীয় ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দেয়া হলোনা তাঁর বাড়িতে। ট্যাংক বাহিনী ও সাঁজোয়া বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীসহকারে তাঁর লাশ কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ দূরে অবস্থান করে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে। সরকার তাদেরকে তাঁর জানাযা ও দাফন কাজে অংশগ্রহণ করতে দিলোনা।
শায়খ হাসানুল বান্নার উত্তরসূরী
ইতোমধ্যে আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়েছিলো। ১৯৫১ সনের ১৭ই সেপ্টেম্বর মিসরের সুপ্রীম কোর্ট নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে রায় দেয়। আল ইখওয়ান আবার বৈধ সংগঠনরূপে কাজ শুরু করে।
অক্টোবর মাসে হাসান ইসমাঈল আল হুদাইবী আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের আল মুর্শিদুল আম নির্বাচিত হন। তাঁর ডেপুটি নিযুক্ত হন আবদুল কাদির আওদাহ। কিছুকাল পর ভাইস মুর্শিদ নামে আরেকটি পদ সৃষ্টি করা হয়। এই পদে নিযুক্ত হন মুহাম্মাদ খামিস হুমাইদা। হাসান ইসমাইল আল হুদাইবীও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন।
তিনিও গুপ্ত বাহিনীকে স্বীকৃতি দেননি। শায়খ হাসানুল বান্নার মতো তিনিও ছিলেন সন্ত্রাসবাদের ঘোর বিরোধী।