আইয়ুব বাচ্চুর জীবনী - Biography of Ayub Bachchu
আইয়ুব বাচ্চু একজন বাংলাদেশী সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক-গীতিকার এবং গীটারবাদক ছিলেন। তিনি রক ব্যান্ড এল আর বি এর গায়ক ও গীটারবাদক হিসেবে পুরো বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। তাকে বাংলাদেশের জনপ্রিয় সঙ্গীতের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং গীটারবাদক বলা হয়।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন্ম: আইয়ুব বাচ্চু রবিন ১৬ আগস্ট ১৯৬২ চট্টগ্রাম, পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)
মৃত্যু: ১৮ অক্টোবর ২০১৮ (বয়স ৫৬) ঢাকা, বাংলাদেশ
স্মৃতিস্তম্ভ: রূপালী গিটার
পেশা: সঙ্গীতশিল্পী,সঙ্গীতজ্ঞ,গীতিকার
দাম্পত্য সঙ্গী: ফেরদৌস আইয়ুব চন্দনা (বি. ১৯৯১)
সন্তান: ২
পিতা-মাতা: ইশহাক চৌধুরী (পিতা),নুরজাহান বেগম (মাতা)
কার্যকাল: ১৯৭৭–২০১৮
প্রাথমিক জীবন
আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইশহাক চোধুরী এবং মা নুরজাহান বেগম। তাদের পরিবার ছিল একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার। তার মতে তাদের পরিবারে সবাই "অতি ধার্মিক ছিলেন এবং সঙ্গীত নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেওয়াটা কেউ গ্রহণ করেননি।" তারা তিন ভাই-বোন ছিলেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সে ছিল সবার বড়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর তার বাবা চট্টগ্রাম শহরের জুবীলি রোড এলাকায় একটি বাড়ি ক্রয় করেন, যেখানে বাচ্চুর বেশিরভাগ কৈশর জীবন অতিবহিত হয়। ১৯৭৩ সালে তার বাবা তাকে তার ১১তম জন্মদিনে একটি গীটার উপহার দেন। তার কৈশর জীবনের শুরুর দিকে সে বিভিন্ন ব্রিটিশ এবং আমেরিকান রক ব্যান্ডের গান শোনা শুরু করে, যেমন তৎকালীন সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রক ব্যান্ড লেড জেপলিন, ডিপ পার্পল, কুইন, দ্য জিমি হেনড্রিক্স এক্সপেরিয়েন্স ইত্যাদি। তন্মধ্যে জিমি হেনড্রিক্স এর গীটার বাজানো তাকে বেশি মুগ্ধ করেছিল। তাকে গীটার শেখাতো জেকব ডায়াজ নামের একজন বার্মিজ মানুষ যে তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রামে থাকতো। ১৯৭৬ এর দিকে সে তার এক বন্ধুর থেকে ধার নিয়ে ইলেকট্রিক গীটার বাজাতো, যা ছিল একটি টিস্কো গীটার। পরে সে যখন গীটারটির প্রতি বেশি আগ্রহ দেখান, তার বন্ধু তাকে গীটারটি দিয়ে দেয়। ১৯৭৫ সালে তাকে সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। ১৯৭৯ সালে সে ওই স্কুল থেকে এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেন। চট্টগ্রামে কলেজ জীবনে সহপাঠী বন্ধুদের নিয়ে তিনি একটি ব্যান্ডদল গড়ে তোলেন। এর নাম ছিল "গোল্ডেন বয়েজ"। পরে নাম বদলে করা হয় "আগলি বয়েজ"। সেই ব্যান্ডের গায়ক ছিল কুমার বিশ্বজিৎ এবং বাচ্চু ছিল গিটারিস্ট। সেই সময়ে তারা মূলত পটিয়ায় বিভিন্ন বিবাহ অনুষ্ঠানে গান গাইতো এবং শহরের বিভিন্ন ক্লাবে গান করতো। ১৯৮০ সালে বাচ্চু ও বিশ্বজিৎ যখন সোলসে যোগদান করে তখন ব্যান্ডটি ভেঙে যায়।
সঙ্গীতজীবন
বাচ্চু চট্টগ্রামে ১৯৭৬ সালে কলেজ জীবনে "আগলি বয়েজ" নামক ব্যান্ড গঠনের মাধ্যমে তার সঙ্গীত জীবনের সূচনা করেছিল। ১৯৭৭ সালে তিনি "ফিলিংস" (বর্তমানে "নগর বাউল" নামে পরিচিত) এ যোগদান করেন এবং ব্যান্ডটির সাথে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাজ করেছিলেন। একই বছরে তিনি জনপ্রিয় রক ব্যান্ড সোলস-এর প্রধান গীটারবাদক হিসেবে যোগদান করেন। সোলসের সঙ্গে তিনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, সুপার সোলস (১৯৮২), কলেজের করিডোরে (১৯৮৫), মানুষ মাটির কাছাকাছি (১৯৮৭) এবং ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট (১৯৮৮) চারটি অ্যালবামে কাজ করেছিল। ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল তিনি তার নিজের ব্যান্ড লিটল রিভার ব্যান্ড গঠন করে, যা পরবর্তীকালে লাভ রান্স ব্লাইন্ড নামে বা সংক্ষেপে এল আর বি নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি তার মৃত্যু অবধি ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৭ বছর ধরে ব্যান্ডটির সঙ্গে ছিলেন। একজন একক শিল্পী হিসেবেও তিনি সফলতা পেয়েছিল। তার প্রথম একক অ্যালবাম রক্ত গোলাপ, যা ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় অ্যালবাম ময়না (১৯৮৮) দিয়ে, তিনি তার একক কর্মজীবনের সফলতা অর্জন করেন এবং পরে কষ্ট (১৯৯৫) অ্যালবামটি প্রকাশ করেন, যা প্রচুর সফলতা অর্জন করে। ২০০৭ সালে তিনি দেশের প্রথম বাদ্যযন্ত্রগত অ্যালবাম সাউন্ড অফ সাইলেন্স প্রকাশ করেন।
বাচ্চু এল আর বি'র সাথে এবং একজন একক শিল্পী হিসেবে প্রচুর অ্যালবাম বিক্রয় করেছেন। বাচ্চু বাংলাদেশে একজন অন্যতম সেরা গীটারবাদরক এবং অন্যতম প্রভাবশালী গীটারবাদক। এল আর বি'র সাথে সে ছয়টি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার এবং একটি সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস জিতেছেন। ২০০৪ সালে বাচসাস পুরস্কার জিতেছিলেন সেরা পুরুষ ভোকাল বিভাগে। ২০১৭ সালে সে টেলে সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার জিতেছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন
আইয়ুব বাচ্চু ১৯৮৬ সালে যখন তার একক অ্যালবাম রক্ত গোলাপ রেকর্ডের জন্যে ঢাকায় আসে তখন সে তার এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছিল। তার বন্ধুর বাসায় একটি আয়নায় ফেরদৌস চন্দনার ছবি লাগানো ছিল৷ বাচ্চু সেই ছবি দেখেই তার বন্ধুকে বলেছিল যে, "সে চন্দনাকে বিয়ে করতে চায়"। তার সাথে যখন চন্দনার দেখা হয় তখন তারা একজন আরেকজন খুবই পছন্দ করে ফেলে৷ পরে যখন চন্দনার পরিবারে সবাই বাচ্চুর ব্যাপারে জেনে যায়, তখন তারা তাকে বাচ্চুর সাথে দেখা করতে দিত না। বাচ্চু বলেছিল যে, তার ব্যান্ড এলআরবি এর প্রথম অ্যালবাম এল আর বি - ১ এর একটি গান "ফেরারি মন", চন্দনাকে যখন তার পরিবার বাচ্চুর সাথে দেখা করতে দিচ্ছিলেন না, তখন বাচ্চুর কেমন মনে হচ্ছিলো তার কথাই বলে: "ফেরারি এই মনটা আমার, মানে না, কোনো বাধা৷ তোমাকে পাওয়ারই আশাই। ফিরে আসে বারে বার।" বাচ্চু তখন ঢাকায় এলিফ্যান্ট রোড এর একটি বাসায় থাকতো। তার কাছে মাত্র ৬০০ টাকা ছিল, যা দিয়ে সে কিছুই করতে পারছিলোনা৷ অ্যালবাম রেকর্ড করে সে আবার চট্টগ্রাম চলে আসে। কিন্তু তাও সে প্রায় সময়েই চন্দনা কে দেখতে ঢাকা আসতো৷ যখন সে ১৯৯০ এর শেষের দিকে সোলস ছেড়ে দেয়, তখন সে ঢাকায় আসে আর চন্দনা কে বিয়ের প্রস্তাব দেয়৷ চন্দনার পরিবার প্রথমে রাজি না হলেও পরে রাজি হয়ে যায়। ১৯৯১ সালের ৩১শে জানুয়ারি বাচ্চু চন্দনা কে বিয়ে করে। তাদের দুটি সন্তান আছে: মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব (জ. ১৯৯৪) এবং ছেলে আহনাফ তাজওয়ার আইয়ুব (জ. ১৯৯৬)।
স্বীকৃতি
আইয়ুব বাচ্চুকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে ১৮ ফুট উচ্চতার একটি গিটারের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। রূপালী গিটার আইয়ুব বাচ্চুর একটি জনপ্রিয় গানের শিরোনাম অনুসারে এই ভাস্কর্যের নাম রাখা হয় রূপালী গিটার।
মৃত্যু
আইয়ুব বাচ্চুর ফুসফুসে পানি জমার কারণে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হন (২৭ নভেম্বর, ২০১২)। সেখানে চিকিৎসা গ্রহণের পর তিনি সুস্থ হন। বাচ্চু ১৮ই অক্টোবর ২০১৮ সালে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। একই দিন সকালে অসুস্থবোধ করায় তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তাররা ৯টা ৫৫ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।