ইরফান খান এর জীবনী - Biography of Irrfan Khan
ইরফান খান ছিলেন একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেতা। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে তিনি তার অতুলনীয় ও অকল্পনীয় সহজাত অভিনয় ক্ষমতার জন্য পরিচিত। বলিউড, ব্রিটিশ ভারতীয়, হলিউড এবং একটি তেলুগু চলচ্চিত্রে তিনি কাজ করছেন। ৩৫ বছরের কর্মজীবনে তিনি ৫০টির অধিক দেশীয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও চারটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার-সহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। চলচ্চিত্র সমালোচক, সমসাময়িক অভিনয়শিল্পী ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা তাকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী বলে গণ্য করে থাকেন। ২০১১ সালে ভারত সরকার তাকে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রীতে ভূষিত করে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন্ম: সাহেবজাদা ইরফান আলী খান ৭ জানুয়ারি ১৯৬৭ জয়পুর, রাজস্থান
মৃত্যু: ২৯ এপ্রিল ২০২০ (বয়স ৫৩) মুম্বই, মহারাষ্ট্র
মৃত্যুর কারণ: মলাশয়ের ক্যান্সারজনিত জটিলতা
জাতীয়তা: ভারতীয়
মাতৃশিক্ষায়তন: রাষ্ট্রীয় নাট্য বিদ্যালয়
পেশা: চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক
কর্মজীবন: ১৯৮৫–২০২০
দাম্পত্য সঙ্গী: সুতপা সিকদার (বি. ১৯৯৫; মৃ. ২০২০)
সন্তান: ২
সম্মাননা: পদ্মশ্রী সম্মাননা (২০১১)
প্রারম্ভিক জীবন
ইরফান ১৯৬৭ সালের ৭ই জানুয়ারি ভারতের জয়পুরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইরফানের মাতা বেগম খান এবং তার মরহুম পিতা জাগিরদার খান টঙ্ক জেলার বাসিন্দা ছিলেন এবং সেখানে পাগড়ির ব্যবসা করতেন। ইরফান ও তার এক বন্ধু সতীশ শর্মা ভালো ক্রিকেট খেলতেন এবং ইরফান পরবর্তীতে ভারতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের ভিত্তি হিসেবে সুপরিচিত সিকে নায়ুডু টুর্নামেন্টে অনূর্ধ্ব ২৩ দলের জন্য নির্বাচিত হন। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থায়নের অভাবে তিনি এই আসরে খেলতে পারেননি।
তিনি স্নাতকোত্তর পড়াকালীন ১৯৮৪ সালে নতুন দিল্লির রাষ্ট্রীয় নাট্য বিদ্যালয়ে (এনএসডি) অধ্যয়নের জন্য বৃত্তি পান। এনএসডি থেকে তিনি নাট্যতত্ত্বে ডিপ্লোমা করেন।
কর্মজীবন
ইরফান খান ১৯৮৭ সালে এনএসডি থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে মুম্বইয়ে চলে আসেন এবং মীরা নায়ার পরিচালিত শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরস্কার মনোনীত হিন্দি ভাষার সালাম বম্বে! (১৯৮৮) চলচ্চিত্রে ছোট চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পান, কিন্তু তার অভিনীত দৃশ্যগুলি চূড়ান্ত কাটে জায়গা পায়নি।
এরপর তিনি দূরদর্শনের টেলিভিশন নাটক লাল ঘাস পর নীলে ঘোড়ে-তে ভ্লাদিমির লেনিন চরিত্রে অভিনয় করেন। এটি মিখাইল শাতরভের রুশ নাটকের উদয় প্রকাশের অনুবাদের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। তিনি স্টার প্লাসের দর টিভি ধারাবাহিকে প্রধান খলচরিত্রে অভিনয় করেন। কে কে মেননের বিপরীতে এই ধারাবাহিকে তিনি একজন ধারাবাহিক খুনী চরিত্রে অভিনয় করেন।এছাড়া তিনি কাহকাশাঁ নাটকে বিখ্যাত বিপ্লবী উর্দু কবি ও মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক কর্মী মখদুম মহিউদ্দিন চরিত্রে অভিনয় করেন।
তিনি স্টার প্লাসে প্রচারিত স্টার বেস্টসেলার্স-এর কয়েকটি পর্বে অভিনয় করেন। একটি পর্বে তাকে একজন দোকানদার চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়, যেখানে তার ধারণা হয় তার বাড়িওয়ালার স্ত্রী তাকে কামের ফাঁদে ফেলতে চাচ্ছে, কিন্তু পরে দেখা যায় তার স্ত্রীই তাকে ফাঁকি দিচ্ছে। আরেকটি পর্বে তাকে একজন হিসাবরক্ষক চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়, যেখানে তিনি তার নারী বস কর্তৃক অপমানিত হওয়ার পর এর প্রতিশোধ নেন। এছাড়া তিনি সেট ইন্ডিয়ায় প্রচারিত ভানবর ধারাবাহিকের দুটি পর্বে অভিনয় করেন।
১৯৯০-এর দশক জুড়ে তিনি একাধিক টেলিভিশন ধারাবাহিকে অভিনয় করেন, তন্মধ্যে রয়েছে দূরদর্শনের চণক্য, ভারত এক খোঁজ, সারা জাহাঁ হামারা, বনেগি আপনি বাত, চন্দ্রকান্ত, শ্রীকান্ত, অনুগুঞ্জ, ও স্পর্শ, এবং ডিডি ন্যাশনালের দ্য গ্রেট মরত।
দ্য নেমসেক চলচ্চিত্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে সহশিল্পী তাবুর সাথে ইরফান
এরপর কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি ২০০১ সালে ওয়ারিয়র চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ২০০৩ সালে তিনি নাট্যধর্মী হাসিল চলচ্চিত্রে খল চরিত্রে অভিনয় করেন। সমালোচকগণ তার অভিনয়ের প্রশংসা করেন। রেডিফ.কম লিখেন, "উচ্চাকাঙ্ক্ষী, উদ্ধত ও নির্ভয় দুর্বৃত্ত চরিত্রে তার অভিনয় অনবদ্য। তিনি খুবই ভয়ঙ্কর, যা আপনাকে ভয় পাইয়ে দেবে, এবং পরবর্তীতে কি করতে যাচ্ছে তা আপনাকে বিস্মিত করবে।
এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ খল অভিনয়শিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন। পরের বছর মকবুল (২০০৪) চলচ্চিত্রে তাকে পুনরায় খল চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়, এবং চলচ্চিত্রেও তার অভিনয় সমাদৃত হয়। বলিউড চলচ্চিত্রে তার প্রথম কেন্দ্রীয় চরিত্রে কাজ ছিল রোগ (২০০৫)। এই চলচ্চিত্রের তার অভিনয়ের প্রশংসা করে স্ম্যাশহিটস লিখে, "ইরফানের চোখ তার শব্দের চেয়েও জোড়ে কথা বলে এবং পর্দায় তাকে যতক্ষণ দেখা যায়, তিনি অভিনয়শিল্পী হিসেবে তার নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন।
২০০৬ সালে তিনি দ্য নেমসেক চলচ্চিত্রে তাবুর বিপরীতে অভিনয় করেন। ২০০৭ সালের বহু-প্রশংসিত মুম্বই-কেন্দ্রিক হিন্দি নাট্য-চলচ্চিত্র লাইফ ইন আ... মেট্রো বক্স অফিসে বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়। এই চলচ্চিত্রে পার্শ্ব চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন। এই চলচ্চিত্রে কঙ্কনা সেন শর্মার সাথে রসায়ন এই তারকাবহুল চলচ্চিত্রের অন্যতম দিক ছিল। এই বছর তিনি দুটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রে কাজ করেন, সেগুলো হলো আ মাইটি হার্ট ও দ্য দার্জিলিং লিমিটেড।
তিনি ২০০৮ সালে একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র স্লামডগ মিলিয়নিয়ার চলচ্চিত্রে একজন পুলিশ কর্মকর্তা চরিত্রে অভিনয় করেন। এই কাজের জন্য তিনি এবং এই চলচ্চিত্রের বাকি অভিনয়শিল্পীগণ চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পীদের সেরা অভিনয় বিভাগে স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কার অর্জন করেন। চলচ্চিত্রটির পরিচালক ড্যানি বয়েল তার সম্পর্কে বলেন, "কোন চরিত্রের "নৈতিক কেন্দ্রবিন্দু" খোঁজার তার সহজাত কৌশল রয়েছ, স্লামডগের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।" বয়েল তাকে সেই সকল অ্যাথলেটদের সাথে তুলনা করেন যারা একই কাজ সঠিকভাবে বারবার করতে পারেন। বয়েলের ভাষ্যমতে, "তা দৃষ্টি নন্দন"। এরপর তিনি নিউ ইয়র্ক, আই লাভ ইউ (২০০৮) চলচ্চিত্রে গুজরাতি হীরক ব্যবসায়ী এবং নিউ ইয়র্ক (২০০৯) চলচ্চিত্রে এফবিআই কর্মকর্তা চরিত্রে অভিনয় করেন। এছাড়া তাকে ২০০৯ সালে মারপিটধর্মী এসিড ফ্যাক্টরি চলচ্চিত্রে দেখা যায়।
তিনি ক্রীড়া নাট্যধর্মী পান সিং তোমার (২০১১) চলচ্চিত্রে ক্রীড়াবিদ থেকে ডাকাত হয়ে যাওয়া পান সিং তোমারের ভূমিকায় অভিনয় করে সমাদৃত হন। এই কাজের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে ফিল্মফেয়ার সমালোচক পুরস্কার অর্জন করেন। পরের বছর তিনি দি অ্যামেজিং স্পাইডার-ম্যান এবং লাইফ অব পাই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে বাফটা পুরস্কার মনোনীত দ্য লাঞ্চবক্স (২০১৩) চলচ্চিত্রে তার অভিনয় বৈশ্বিক সমালোচক ও দর্শকদের প্রশংসা অর্জন করে।
২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মাঝে মুক্তিপ্রাপ্ত হায়দার, পিকু, তালবার ও ব্ল্যাকমেইলের মতো কয়েকটি বাণিজ্যিকভাবে সফল ও সমাদৃত চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেন।
২০১৭ সালে তিনি দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, সেগুলো হলো করিব করিব সিঙ্গেল এবং হিন্দি মিডিয়াম। হাস্যরসাত্মক নাট্যধর্মী হিন্দি মিডিয়াম চলচ্চিত্রে তার কাজের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কার অর্জন করেন। এটি তার অভিনীত সর্বোচ্চ আয়কারী হিন্দি চলচ্চিত্র, যা ভারত ও চীনে স্লিপার হিট তকমা লাভ করে। এছাড়া তিনি একই বছর মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র ডুব: নো বেড অব রোজেস চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তার অভিনীত চলচ্চিত্রসমূহ বিশ্বব্যাপী বক্স অফিসে $৩.৬৪ বিলিয়ন আয় করে।
২০১৮ সালে তিনি কারওয়া চলচ্চিত্রে দুলকার সালমান, মিথিলা পালকার ও কৃতি খরবন্দার সাথে অভিনয় করেন। এতে দুলকার ও তার অভিনয় প্রশংসিত হয়। একই বছর তিনি কৃতি কুলহারির বিপরীতে ব্ল্যাকমেইল চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া লাভ করে। ইরফান খানের অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র আংরেজি মিডিয়াম ২০২০ সালের ১৩ই মার্চ মুক্তি পায়।
ব্যক্তিগত জীবন
১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরফান তার এনএসডির সহপাঠি সুতপা সিকদারকে বিয়ে করেন। তাদের দুই পুত্র রয়েছে।
২০১২ সালে তিনি তার নামের ইংরেজি বানানে একটি অতিরিক্ত আর (r) যুক্ত করেন, ফলে ওনার নাম "Irrfan" এ পরিবর্তিত হয়। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন তার নামে অতিরিক্ত আরের শব্দটি তিনি পছন্দ করেন। তিনি তার নামের শেষাংশ থেকে "খান" অংশটি বাদ দেন। ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে তার কাজগুলো তাকে পরিচয় করিয়ে দেবে, তার বংশ পরম্পরা নয়।
অসুস্থতা ও মৃত্যু
ইরফান খান দীর্ঘ একবছর কঠিন নিউরো এন্ডোক্রিন কর্কটরোগে ভুগছিলেন।লন্ডনে এক বছর চিকিৎসা গ্রহণের পর তিনি ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতে ফিরে আসেন।
২০২০ সালের ২৮শে এপ্রিল বৃহদন্ত্রে জটিলতার জন্য তাকে মুম্বইয়ে অবস্থিত কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানি হাসপাতালে ভর্তি করা হলে, তিনি ২৯শে এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
পুরস্কার
বেসামরিক সম্মান
২০১১: পদ্মশ্রী[
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
২০১২: শ্রেষ্ঠ অভিনেতা - পান সিং তোমার
ফিল্মফেয়ার পুরস্কার
২০১৮: শ্রেষ্ঠ অভিনেতা - হিন্দি মিডিয়াম
২০১২: শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (সমালোচক) – পান সিং তোমার
২০০৭: শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা - লাইফ ইন আ... মেট্রো
২০০৩: শ্রেষ্ঠ খল অভিনয়শিল্পী – হাসিল