আরজ আলী মাতুব্বর এর জীবনী-Biography of Arj Ali Matubbar
Arj Ali Matubbar

আরজ আলী মাতুব্বর এর জীবনী-Biography of Arj Ali Matubbar

জন্ম: ডিসেম্বর ১৭, ১৯০০,লামছড়ি, চরবাড়িয়া, বরিশাল, বাংলাদেশ

মৃত্যু: ১৫ মার্চ ১৯৮৫ (বয়স ৮৪) বরিশাল, বাংলাদেশ

পেশা: যুক্তিবাদ, দার্শনিক, লেখক

জাতীয়তা: বাংলাদেশী

নাগরিকত্ব: বাংলাদেশী

শিক্ষা: স্বশিক্ষিত, প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা লাভ করতে পারেন নি

ধরন: যুক্তিবাদী, রচনা

উল্লেখযোগ্য রচনাবলি: সত্যের সন্ধানে · সৃষ্টির রহস্য 'অনুমান'

উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: বাংলা একাডেমী আজীবন সম্মাননা, হুমায়ুন কবীর স্মৃতি পদক, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বারিশাল শাখার সম্মাননা পদক।

জন্ম

আরজ আলী মাতুব্বর তিনি ১৯০০ সালের ১৭ই ডিসেম্বর (বাংলা ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ৩রা পৌষ) তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে বরিশাল জেলার অন্তর্গত চরবাড়িয়া ইউনিয়নের লামছড়ি গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম এন্তাজ আলী মাতুব্বর। তার মা অত্যন্ত পরহেজগার ছিলেন। পরিবারে তারা ছিলেন পাঁচ ভাইবোন। আরজ আলী মাতুব্বরের প্রকৃত নাম ছিলো ‘আরজ আলী’। আঞ্চলিক ভূস্বামী হওয়ার সুবাদে তিনি ‘মাতুব্বর’ নাম ধারণ করেন।

শিক্ষা

আরজ আলী নিজ গ্রামের মুন্সি আবদুল করিমের মসজিদ দ্বারা পরিচালিত মক্তবে সীতানাথ বসাকের কাছে 'আদর্শলিপি' পড়তেন। এছাড়া তিনি মক্তবে কোরআন এবং ইসলামিক ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে এক সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তায় তিনি স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। সাথে সাথে তিনি নিজের ঐকান্তিক চেষ্টায় লেখাপড়া শিখতে থাকেন। নিজের জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে তিনি বরিশাল লাইব্রেরির সমস্ত বাংলা বই একজন মনোযোগী ছাত্রের ন্যায় পড়েন। দর্শন ছিলো তার প্রিয় বিষয়। কিন্তু পাঠাগারে পর্যাপ্ত বই ছিলো না। পরে বিএম মহাবিদ্যালয়ের দর্শনের এক শিক্ষক – কাজী গোলাম কাদির তার জ্ঞানগর্ভ বিচার দেখে মোহিত হন এবং তিনি মহাবিদ্যালয়ের পাঠাগার থেকে বই ধার দেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এভাবেই তার মানসিক আকৃতি গঠিত হয়। তিনি নিজ চেষ্টা ও সাধনায় বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম ও দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করেন। ধর্ম, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নানামুখী জিজ্ঞাসা তার লেখায় উঠে এসেছে।

কর্মজীবন

পৈতৃক পেশা কৃষিকাজ দিয়েই তার কর্মজীবনের শুরু। কৃষিকাজের অবসরে জমি জরিপের কাজ করে তিনি আমিনি পেশার সূক্ষ্ম গাণিতিক ও জ্যামিতিক নিয়ম সম্পর্কে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন।

শৈশবে তার মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের ছবি তোলার দায়ে গ্রামের মানুষ তার মায়ের জানাজা পড়তে রাজি হয় নি। শেষে বাড়ির কয়েকজন লোক মিলে তার মায়ের সৎকার করেন। এই ঘটনা আরজ আলীর ধর্মীয় গোঁড়ামী ও কুসংস্কার বিরোধিতার এবং সত্যানুসন্ধিৎসু হয়ে উঠার পেছনে কাজ করেছিল।

আর্থিক সঙ্কটের কারণে, মাতুব্বর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কোর্স বা ডিগ্রী লাভ করতে পারেন নি। কৃষিকাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি জমি জরিপ বা আমিনের কাজ শিখে নেন। এরপর জমি জরিপের কাজকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কৃষি ক্ষেতের জন্য এভাবে কিছু পুঁজি জমা করেন। নিজের শ্রম, মেধা, বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে তিনি আর্থিক অবস্থার উন্নতি করেন এবং জমিদার ও মহাজনদের কাছে বন্ধককৃত জমিজমা উদ্ধার করেন।

আরজ আলী মাতুব্বর ছিলেন একজন বস্তুবাদী দার্শনিক। এখন প্রশ্ন হলো, বস্তুবাদ কি?

বস্তুবাদ বা জড়বাদের মূলকথা হলো, জড়ই এ জগতের আদি উপাদান অর্থাৎ যাবতীয় বস্তুর মূল উপাদান জড় বা পরমাণু ও তার গতি। বস্তুবাদ হচ্ছে এমন এক তত্ত্ববিদ্যক মতবাদ(ontological theory), যা জড়কে বিশ্বজগতের আদি সত্ত্বা বলে মনে করে।

বস্তুবাদের মতে, এ জগতের যাবতীয় বস্তুই জড়ের আকর্ষণ ও বিকর্ষণের ফলে উদ্ভূত হয়। পাশ্চাত্য দর্শনের জনক নামে খ্যাত থেলিসের মতবাদে প্রথম বস্তুবাদের সাক্ষাত মেলে।

আরজ আলী মাতুব্বর প্রশ্ন করতে ভালোবাসতেন।

শুধু প্রশ্ন করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, সেগুলোর উত্তর সন্ধানের চেষ্টা করেছেন। মানুষের জীবন ও প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর মনে কৌতুহল বা কোনোরকম প্রশ্নের উদয় হলে তিনি ‘বস্তুবাদ’ বিষয়টা নিয়ে নড়াচড়া করতেন। বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান এবং নিজের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তিনি নিজস্ব চিন্তার জগৎ তৈরি করতেন।

সক্রেটিস বলেছিলেন, 'An unquestioned life is not worth living.' মানবসভ্যতার অগ্রগতির মূলে কাজ করেছে প্রশ্ন। প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক উত্তরের দীর্ঘ ইতিহাস মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। অগণিত প্রতিভাবানকে এ জন্য কঠোর সাধনা ও ত্যাগ করতে হয়েছে, কেউ কেউ জীবন দান করেছেন। 

পারিবারিক জীবন

বাংলা ১৩২৯ সালের ২৯শে অগ্রহায়ণ আরজ আলী মাতুব্বর ২১ বছর বয়সী লালমন্নেছার সাথে প্রথমবারের মতো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর প্রথম স্ত্রী তিনটি কন্যাসন্তান ও একটি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। এরপর পাশের গ্রামের ‘সুফিয়া’ নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। এই সংসারে তাঁদের চারটি কন্যা ও দুইটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়েছিল।

প্রকাশিত গ্রন্থ

স্বশিক্ষায় শিক্ষিত এই মানুষটি বেশ কিছু সাহিত্য রচনা করেছেন যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জ্ঞানের জ্যোতি বাড়িয়ে দিয়ে জানার সীমানাকে করেছে অসীম। আরজ আলীর রচিত পাণ্ডুলিপির সংখ্যা মোট ১৫টি। এর মধ্যে তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল ৪টি।

এই বইগুলো হলো- ‘সত্যের সন্ধান’ (১৯৭৩), ‘সৃষ্টি রহস্য’ (১৯৭৭), ‘অনুমান’ (১৯৮৩), ও ‘স্মরণিকা’ (১৯৮৮)। তাঁর কিছু লেখা ইংরেজীতে ভাষান্তর করা হয়।

জীবন দর্শন ও সৃষ্টি

আরজ আলী মূলত বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি অনেক অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লেখালেখি করেন। তৎকালীন সময়ে লেখালেখির জন্য তিনি সমালোচিত ও অভিযুক্ত হয়েছিলেন। সেজন্য কিছুদিন তার লেখালেখি নিষিদ্ধ ছিল। আরজ আলী মাতুব্বর তাঁর প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদ নিজেই আঁকেন। বইটি লিখেছিলেন ১৯৫২ সালে। প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে ‘সত্যের সন্ধানে’ শিরোনামে।

বইটি তাঁকে ‘শিক্ষিত ব্যক্তি’ হিসেবে সুনাম এনে দিয়েছিল। মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেনঃ “আমি অনেক কিছুই ভাবছি, আমার মন প্রশ্নে ভরপুর কিন্তু এলোমেলোভাবে। আমি তখন প্রশ্নের সংক্ষেপণ লিখতে থাকি, বই লেখার জন্য নয় শুধুমাত্র পরবর্তীকালে মনে করার জন্য। অসীম সমুদ্রের মতন সেই প্রশ্নগুলো আমার মনে গেঁথে আছে এবং আমি ধীরে ধীরে ধর্মীয় গণ্ডি হতে বের হতে থাকি।”

তিনি এই বইটিতে দার্শনিক প্রশ্নগুলোর ৬টি ধাপে তার প্রশ্ন ও তাদের যৌক্তিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। সেগুলো হলো-

প্রথম ধাপ- আত্মা বিষয়ক। এখানে মোট প্রশ্নের সংখ্যা ৮টি।

দ্বিতীয় ধাপ- ঈশ্বর বিষয়ক। এই অংশে মোট প্রশ্ন ১১টি।

তৃতীয় ধাপ- পরকাল বিষয়ক। এই অংশে ৭টি প্রশ্ন।

চতুর্থ ধাপ- ধর্ম বিষয়ক। এই অংশে ২২টি প্রশ্ন।

পঞ্চম ধাপ- প্রকৃতি বিষয়ক। এই অংশে ১১ টি প্রশ্ন।

ষষ্ঠ ধাপ- অন্যান্য বিষয়। এই অংশে মোট ৯টি প্রশ্ন।

মৃত্যু

আরজ আলী মাতুব্বর ১৯৮৫ সালের ১৫ই মার্চ ( ১৩২৯ সন; ১লা চৈত্র) ৮৬ বছর বয়সে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তিনি মরণোত্তর চক্ষুদান করে যান এবং  মেডিকেল শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ-এর এনাটমি বিভাগে মরণোত্তর দেহদান করে যান।

সম্মাননা

বাংলা একাডেমী কর্তৃক আজীবন সদস্যপদ প্রদান এবং বাংলা ১৩৯২ সালের ১লা বৈশাখ নববর্ষ সংবর্ধনা জ্ঞাপন।

হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৩৮৫ ব.)

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কর্তৃক বরণীয় মনীষী হিসেবে সম্মাননা (১৩৯২ ব.)

বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ প্রতি বছর তার স্মরণে আরজ আলী মাতুব্বর স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে থাকে।

উক্তি

"বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রী আছে জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই; জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন"

"জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে শুধু আপন বিশ্বাসই নয়, সকল মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। সকল ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা দরকার প্রতিটি জ্ঞান পিপাসু মানুষের। শুধু সীমাবদ্ধ পরিমন্ডলে আবদ্ধ হলে চলেনা। সীমানাকে অতিক্রম করে যেতে হবে ক্রমান্বয়ে। এর মধ্যেই ক্রমশ অতিক্রম করা যাবে নিজেকে।"

"কোন ব্যক্তি যদি একজন ক্ষুদার্থকে অন্নদান ও একজন পথিকের মাল লুন্ঠন করে ও অন্য কাউকে হত্যা করে অথবা একজন গৃহহীনকে গৃহদান করে এবং অপরের গৃহ করে অগ্নিদাহ, তবে তাহাকে 'দয়াময় 'বলা যায় না।"

মুফতি আমজাদ হোসাইন আশরাফী এর জীবনী - Biography of Mufti Amjad Hossain Ashrafi
মুফতি মুহসিনুল করিম এর জীবনী - Biography of Mufti Muhsinul Karim
মাওলানা ওয়াসেক বিল্লাহ নোমানী এর জীবনী-Biography of Maulana Wasek Billah Nomani
রোদ্দুর রায় এর জীবনী- Biography Of roddur roy
বাদশাহ হারুন অর রশীদ-Biography Of King Harun Aur Rashid
মীর জাফর আলী- Biography Of Mir Jafar ali
শায়খ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক এর জীবনী-Biography of Shaykh Abdullah bin Abdur Razzak
মুনাইম বিল্লাহ এর জীবনী - Biography of Munaim Billah
শেখ জামাল এর জীবনী - Biography of Sheikh Jamal
শেখ আবু নাসের এর পরিচয় ও জীবনী - Sheikh Abu Nasser's identity and biography