ব্যালে ইরার গল্প-Mobashira Kamal Ira
Mobashira Kamal Ira

Mobashira Kamal Ira

মোবাশ্বিরা কামাল ইরা

নওগাঁ শহরের জগৎসিংহপুর মহল্লার বটতলা মোড় সংলগ্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আবু হায়াৎ মোহাম্মদ কামাল ও ফাহমিদা আক্তার দম্পত্তি চার মেয়ের মধ্যে তৃতীয় মোবাশ্বিরা কামাল ইরা। বাবা একজন স্থানীয় ফার্নিচার ব্যবসায়ী ও মা গৃহিনী। বড় দুই বোন আলাদা প্রতিভার অধিকারী। নওগাঁ সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষে বাণিজ্য শাখায় পড়ছেন তিনি। ২০২০ সালে নওগাঁ সীমান্ত পাবলিক স্কুল থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। দেশের সীমান্তবর্তী মফস্বল নওগাঁ শহর থেকে পড়ালেখা ও অনুশীলন করে সাফল্য এনেছেন অনেক। ছবির বালিকাটির নাম মোবাশ্বিরা কামাল ইরা। নাচ নিয়ে পড়াশুনা করতে চান তিনি। ব্যালে-জিমনেস্টির এক ধরনের নৃত্যকলা। এখানে নাচের সঙ্গে অভিনয় এবং সংগীতের অপূর্ব সমন্বয় ঘটে।  

ব্যালে ইরার গল্প

শৈশব থেকেই ইরা ছিলেন অদম্য মেধাবী ও চঞ্চল প্রকৃতির। বেড়ে ওঠা নওগাঁ শহরেই। বরাবরই নাচ করতে ভালোবাসেন। শৈশবে শিক্ষক সুলতান মাহমুদের কাছে নাচ শিখেছেন। পরে ঢাকায় ভরতনাট্যম শেখেন। তবে ব্যালে নৃত্যের ভাবনা মনে আসে ২০২০ সালের লকডাউনের সময়। ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিখতে শুরু করেন ব্যালে। ব্যালে-জিমন্যাস্টিক মিলিয়ে পারফর্ম করেন।এজন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। ২০২১ সালে সাধনা নামে একটি নাচের সংগঠনের সঙ্গে কাজ শুরু করেন ইরা।

এর মধ্যে পরিচয় হয় ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার জয়িতা আফরিনের সঙ্গে। তিনি থাকেন ঢাকার ধানমন্ডিতে। গত ২০-২২ জানুয়ারি ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে নৃত্য উৎসবে যোগ দিতে এসে জয়িতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন ইরা। দুজনে ফটোগ্রাফির আলাদা একটা অর্থ তৈরি করার চিন্তা করছিলেন। ২৩ জানুয়ারি সকালে দুজনে বেরিয়ে পড়েন। এমন সময় চোখে পড়ে রাজু ভাস্কর্যের পাশে চলমান বিভিন্ন আন্দোলনের প্ল্যাকার্ড-পোস্টার। সেখানে কয়েকটি ফটোশুট করেন। পরে ২৫ জানুয়ারি বিকেল ৪টার দিকে ফেসবুকে আপলোড দেওয়া হয়। সে ছবিগুলোই ছড়াতে ছড়াতে এখন সবার মুখে মুখে ইরার নাম।

গ্রামে থেকে ব্যালে শেখার প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে ইরা বলেন, গ্রাম থেকে কাজ করাটা অনেক কঠিন ছিল। ঢাকার মতো জায়গাতেও ব্যালে খুব একটা নাই। বাসায় প্যাকটিস করার মতো জায়গা ছিল না। মা ড্রয়িং রুম ফাঁকা করে সেখানে প্যাকটিসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। প্রথম দিকে মেঝেতে প্যাকটিস শুরু করলাম। পরে ইয়োগো ম্যাটসের ব্যবস্থা করা হলো। আস্তে আস্তে প্যাকটিস করতে গিয়ে এক সময় তা অভ্যাসে পরিণত হলো। তবে অনেকেই আমার নাচ ভাল ভাবে নিতো না। আবার অনেকেই উৎসাহ জুগিয়েছেন। তবে বলা চলে সব মিলিয়ে পুরো যাত্রা ভাল হচ্ছে। সবক্ষেত্রেই মা আমাকে সার্বক্ষণিক সমর্থন দিয়েছেন ও সহযোগিতা করছেন এবং পাশে থেকেছেন। বাবা-মা সবার কাছেই আমি কৃতজ্ঞ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যালে নৃত্যের ছবি এভাবে ভাইরাল হবে ভাবেননি ইরা। তিনি বলেন, যেভাবে ছবি সবাই শেয়ার করেছেন তা কল্পনাতীত এবং প্রশংসনীয়।

ইরা বলেন, লকডাউনের সময় ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে আপলোড করতাম। সেখান থেকে সাগর দেবনাথ নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার ইচ্ছা ছিল এ ধরনের (ব্যালে) ফটোশুট করার। আমিও সমর্থন দিলাম। তারপর ঢাকায় যমুনা ফিউচার পার্কে কিছু ফটোশুট করলাম। তারপর জয়িতা আফরিন আপু ছবিগুলো দেখেন এবং তিনিও এ ধরনের ছবি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে পোষণ করেন। গত বছরের ২ নভেম্বর ধানমন্ডির লেকের পাড়ে ফটোশুট করা হয়। সেই ছবিগুলো ফেসবুকে আপলোডের পর মোটামুটি ভালো একটা সাড়া পাওয়া যায়। তারপর থেকে ঢাকার বিখ্যাত বিভিন্ন জায়গায় ফটোশুট করার পরিকল্পনা করি আমরা।

এই ব্যালে নৃত্যের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানোর পর ইরা যেমন ভাসছেন প্রশংসার জোয়ারে, তেমনি সামলাতে হচ্ছে গণমাধ্যমকেও।

সম্প্রতি যে ছবিগুলো ভাইরাল হয়েছে সেগুলো প্রসঙ্গে ইরা বলেন, আমার ইচ্ছা ছিল আমরা যেহেতু স্বাধীন দেশের নাগরিক, স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করার। আমার কাছে রাজু ভাস্কর্য মনে হয়েছিল স্বাধীনতা এবং মুক্তির প্রতীক। সেই চেতনা থেকেই সেখানে ফটোশুট করা। ছবিগুলো ভাইরাল হবে, এমন কোনো চিন্তা মাথায় ছিল না। ২৩ জানুয়ারি ফটোশুট করা হলে ২৫ জানুয়ারি আপলোড করা হয়। ফটোশুটের আগে এবং পরে ভয়ে ছিলাম। ছবি ফেসবুকে আপলোড করার দুইঘণ্টা পরও দুশ্চিন্তায় ছিলাম আগের মতো সাড়া পাবো কি না। এরপর বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন পেজে শেয়ার হতে থাকে। আমার মেসেঞ্জারে বিভিন্ন মিডিয়া সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করে। তখন আসলে বুঝতে পারিনি ছবিগুলো এতো সাড়া ফেলবে। সবাই আমাকে সমর্থন জুগিয়েছেন। এটা আমার কাছে বড় একটা প্রাপ্তি মনে করি, যার মাধ্যমে সামনে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা পাবো।’

নৃত্যশিল্পী ও গবেষক এবং ‘সাধনা’ সংগঠনের লুবনা মরিয়মকে আদর্শ হিসেবে মানেন মোবাশ্বিরা কামাল ইরা। তিনি বলেন, লুবনা মরিয়মকে খালা বলে সম্মোধন করি। তার সঙ্গে গত বছর থেকে কাজ করছি। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করেন। তার কাজ আমার খুবই ভালো লাগে। তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে চাই। তিনি যেমন নাচ নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, আমিও নাচ নিয়ে পড়াশোনা করে রিসার্চ করতে চাই।

ভবিষ্যৎ ভাবনা জানিয়ে ইরা বলেন, ভালোভাবে পড়াশোনা করে এইচএসসি পাস করতে চাই, যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই। সেখানে নাচ নিয়ে পড়াশোনা করতে চাই। যেন নাচের মাধ্যমে কথা বোঝাতে পারি। আমাদের চলার অঙ্গভঙ্গি সবখানেই নাচের ব্যবহার আছে। নাচকে সমৃদ্ধ করে মানুষের কাছে তুলে ধরতে চাই। আমাদের নাচের সংস্কৃতিকে বিদেশে এবং বিদেশি নাচের সংস্কৃতিকে দেশে পরিচিত করতে চাই। এ দুইয়ের সংমিশ্রণে নতুন একটা প্লাটফর্ম তৈরি করতে চাই।

ইরার মেঝ বোন জুয়াইয়া কামাল অর্ক। পড়াশোনা করছেন রাজশাহী হোমিও কলেজে। তিনি বলেন, আমরা অনেকেই চেষ্টা করেছি ছোট বোন ইরার মতো ব্যালে করতে। কিন্তু সেটা না পারায় আফসোস থেকে গেছে। আশা করছি সে আরও ভালো করবে। আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। দেশকে আরও পরিচিত করাবে।


ইরার মা ফাহমিদা আক্তার বলেন, শুরু থেকে পারিবারিক তেমন সাপোর্ট পাওয়া যায়নি। মেয়ের ইচ্ছা ও আগ্রহ থাকায় আমি চেষ্টা করেছি এ জায়গা পর্যন্ত পৌঁছানোর। ২০১৭ সাল থেকে তার নাচে হাতেখড়ি। মেয়ের একটার পর একটা সাফল্য আসতে থাকে। কোথাও তাকে থেমে থাকতে হয়নি। তার প্রতিভা দেখে আমারও আগ্রহ বাড়তে থাকে যে—যদি একটু সহযোগিতা করা যায়, মেয়ে হয়তো আরও ভালো করতে পারবে।

ইরা শৈশব থেকে বিভিন্ন খেলায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন জানিয়ে ফাহমিদা বলেন, নাচের পাশাপাশি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ক্রিকেট ও টেনিস খেলতো। এখনো নাচের পাশাপাশি জিম ও স্কেটিং খেলে। বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিল, কিন্তু সময় স্বল্পতায় আর এগোনো সম্ভব হয়নি। তার নাচের শিক্ষক সুলতান মাহমুদ মনে করেন, মেয়ে নাচ ভালো করে সামনে এগিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে ভালো কিছু করবে বলে সবাই আশাবাদী।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে তুরস্ক যান ইরা। সেখানে বিশ্বের ৪৫টি দেশের অংশগ্রহণে শিশু সমাবেশ হয়। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির দলনেত্রী হিসেবে ওই আয়োজনে পুরস্কার পান ইরা। তার মা বলেন, মেয়ে যেন প্রকৃত মানুষ হয় এবং পড়াশোনার পাশাপাশি সে যা করছে তা চালিয়ে যাবে, এটাই আমার কাম্য।

ইরার বাবা আবু হায়াৎ মোহাম্মদ কামাল বলেন, প্রথম চাওয়া মেয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষিত হবে এবং চাকরি করবে। আর দ্বিতীয়ত এ নাচকে সারাবিশ্বে পরিচিত করে দেশের সুনাম বয়ে নিয়ে আসবে। মেয়ে যতটুকু সামনে এগিয়ে যেতে পেরেছে সবটুকু চেষ্টা তার মায়ের। মেয়ের জন্য সে অনেক চেষ্টা ও ত্যাগ স্বীকার করেছে।

ইরার নাচের শিক্ষক ও নওগাঁর ‘নৃত্য রং একাডেমি’র প্রশিক্ষক সুলতান মাহমুদ বলেন, মোবাশ্বিরা কামাল ইরা ছোট থেকেই আমার কাছে নাচ শিখেছে। সব শিক্ষার্থীকে আমি আমার সন্তানের মতো ভালোবাসি। হাতেগোনা যে কয়জন প্রথম সারির শিক্ষার্থী রয়েছে সে তাদের মধ্যে একজন। সে খ্যাতি অর্জন করে নওগাঁবাসীর মুখ উজ্জ্বল করবে এটাই আমার চাওয়া। তার জন্য অনেক শুভ কামনা রইলো।


ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী এর জীবনী-Biography of Dr. Jafrullah Chowdhury
শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল এর পরিচয় ও জীবনী - biography of Sheikh Salahuddin Jewel
মুফতি আনোয়ার হোসাইন চিশতী এর জীবনী - Biography of Mufti Anwar Hossain Chishti
মাওলানা আজিজুল ইসলাম জালালী এর জীবনী - Biography of Maulana Azizul Islam Jalali
ইমদাদুল হক মিলন-Biography Of Imdadul Haque Milon
রাগিব আলী
বেগম ফজিলাতুন্নেসা এর জীবনী - Biography of Begum Fazilatunnesa
মাহফুজ আনাম এর শিক্ষা ও জীবনী- biography of Mahfuz Anam
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শায়খ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক এর জীবনী-Biography of Shaykh Abdullah bin Abdur Razzak