আবরার ফাহাদ- Abrar Fahad
জন্মঃ
আবরার ফাহাদ ১৯৯৮ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছেন। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায়। তার বাবার নাম মো. বরকত উল্লাহ এবং মায়ের নাম রোকেয়া খাতুন।
শিক্ষা জীবনঃ
মিশন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা এবং পরে কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে তিনি নটরডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ আবরার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন।
আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ ব্র্যাকে অডিটর এবং মা রোকেয়া খাতুন কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক ছিলেন। আবরার দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ছিল, তার ছোট ভাই আবরার ফায়াজ কুষ্টিয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।
আবরার ফাহাদ হত্যাঃ
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। মারধরের একপর্যায়ে আবরার বমি করে দেন, প্রস্রাবও করে ফেলেন। পরে তাকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে এনে পোশাক বদলে ফের মারধর করা হয়। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলা আবরার ইঙ্গিতে তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিতে বারবার মিনতি করলেও তাতে কান দেননি বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। শেষ পর্যন্ত আবরারকে মেরে ফেলার পরই ক্ষান্ত হন তারা।
আবরার ফাহাদকে হত্যার এমন নৃশংস বর্ণনা উঠে এসেছে পুলিশের দাখিল করা চার্জশিটে।
চার্জশিটে আবরার হত্যার মূলহোতা এবং মারধরের ঘটনার সূচনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এজাহারভুক্ত আসামি মিজানুর রহমান ওরফে মিজানকে। তিনি আবরারের রুমমেট ছিলেন। চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে, ৪ অক্টোবরের আগের কোনো একদিন তিনি এজাহারভুক্ত আরেক আসামি মেহেদী হাসান রবিনকে জানান, আবরারকে তার শিবির বলে সন্দেহ হয়। এরই প্রেক্ষিতে রবিন ‘এসবিএইচএসএল ১৫’ ও ‘এসবিএইচএসএল ১৬’ গ্রুপের সবাইকে ফেসবুকে মেসেজ দেন এবং ৪ অক্টোবর রবিন ও মুন্নার নেতৃত্বে অমিত সাহা, সকাল, আকাশ, তাবাখখারুল, মনির, জিয়নসহ অন্য আসামিদের উপস্থিতিতে বৈঠক হয়। ওই সময় আবরার গ্রামের বাড়িতে থাকায় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, পরদিন আসামি মনিরের নেতৃত্বে তোহা, আকাশ, মাজেদ, মোরশেদ, মোয়াজসহ অন্যরা গেস্ট রুমে আবরারকে পেটাবে।
এরপর গত ৬ অক্টোবর মুজতবা রাফিদ তার সহযোগী সকাল ও রবিনকে জানান, তিনি বাড়ি যাবেন। আবরারকে ধরলে ওই দিনই ধরতে হবে। কিছুক্ষণ পর সকালকে তোহা ও রাফাত জানান, আবরার বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। এরপরই আসামিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে রাত ৮টার পর শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর রুমে একত্রিত হন। সেখান থেকে রবিন ও সকালের নির্দেশে তানিম, জেমি ও সাদাত ১০১১ নম্বর রুমে গিয়ে আবরারকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। বলেন, তাকে ২০১১ নম্বর রুমে বড় ভাইয়ারা ডেকেছেন। পরে আবরারকে তার ল্যাপটপ ও দুইটি মোবাইলসহ ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে যান তারা।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, আবরারকে ২০১১ নম্বর রুমে নেওয়ার পরই তাবাখখারুল, সকাল ও রাফিদ তার মোবাইল ও ল্যাপটপ পরীক্ষা করতে থাকেন। তারা বলেন, আবরারের মোবাইলে ছাত্রশিবির সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে। এটা শুনেই আবরারকে চশমা হাতে নিতে বলেন রবিন এবং আবরার তার চশমা হাতে নিলে রবিন তাকে চড় মারতে শুরু করেন। এরপর মোর্শেদ কাঠের ক্রিকেট স্টাম্প নিয়ে এলে সকাল সেটা দিয়ে আবরারের পিঠ, পা, হাত ও নিতম্বসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে নির্মমভাবে আঘাত করতে শুরু করেন। এ সময় সকালের হাতের স্টাম্পটি ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেলে এহতেশামুল রাব্বি তানিম আরেকটি স্টাম্প নিয়ে আসে। অনিক সরকার সেটা দিয়ে আবরারের শরীরে একটানা আঘাত করতে থাকে।
টানা মারধরে আবরার ফাহাদ রুমের মেঝেতে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুজাহিদুল ইসলাম ও শামীম বিল্লাহ ‘স্কিপিং রোপ’ দিয়ে আবরার ফাহাদকে দুই থেকে তিনটি আঘাত করে, স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরার ফাহাদের পিঠ ও পায়ে আঘাত করতে শুরু করেন। আবরার তাকে মারধর না করার জন্য আকুতি জানালেও পরে মেফতাহুল ইসলাম জিয়নও স্টাম্প দিয়ে আবরারকে মারতে থাকেন এবং জিজ্ঞাসা করেন, আবরার ছাত্রশিবির করেন কি না।
রাত ১১টার পর এস এম সেতু ২০১১ নম্বর রুমে এসে অন্যদের আবরার ফাহাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ সময় অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল ও মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, সে (আবরার) কোনো তথ্য দিচ্ছে না। তখন সেতু অন্যদের বলেন, ‘মারতে থাক।’ ওই নির্দেশের পর আবরারকে আরও বেশি মাত্রায় পেটানো শুরু হয়। স্টাম্প দিয়ে আঘাত করা ছাড়াও তারা আবরারের পুরো শরীরে ঘুষি, লাথি মারতে থাকে। আসামি মেহেদি হাসান রবিন ও অনিক সরকার রুম থেকে বের হওয়ার সময় উপস্থিত অন্যদের বলেন, ‘তোরা ওর (আবরার) কাছ থেকে তথ্য বের কর।’
এ সময় আসামি আবরারের মোবাইল চেক করে ছাত্রশিবিরের তথ্য পাওয়া গেছে বলে আবার স্টাম্প দিয়ে আবরারকে আঘাত করেন মনিরুজ্জামান মনির। উপস্থিত অন্য আসামিরাও আবরারকে প্রচণ্ড মারধর করতে থাকেন। একপর্যায়ে আবরার ফাহাদ বমি ও প্রস্রাব করে দেন। কথা বলতে না পারলেও ইশারায় তাকে প্রাণে বাঁচতে আর মারধর না করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু আসামিরা আবরারকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে পোশাক বদলে দেন। এ সময় ইফতি মোশারফ সকাল ও মেহেদী হাসান রবিনের হুকুমে এ এস এম নাজমুস সাদাত, শামীম বিল্লাহ, আকাশ হোসেন, আবু হুরাইরা মোয়াজ, জেমিসহ আরও কয়েকজন আবরার নিথর দেহ ধরাধরি করে ২০০৫ নম্বর রুমে নিয়ে যান এবং জাহিদ হাসান জনিকে ডেকে মোশাররফ সকাল ২০১১ রুম পরিষ্কার করিয়ে নেন।
এদিকে, আবরার ফাহাদকে ২০০৫ নম্বর রুমে নেওয়ার পর আবরারকে জেরা করা শুরু হয়, বুয়েটে কে কে ছাত্রশিবির করে। কিন্তু আবরার তখন প্রায় সংজ্ঞাহীন। তখন রবিনকে আবু হুরাইরা, অমর্ত্য ইসলাম, মেহেদী হাসান বলেন, আবরারকে হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু রবিন বলেন, ও (আবরার) নাটক করছে। শিবির চেনস না, শিবির চেনা কষ্ট। পরে আরও মারধরের পর ৬ অক্টোবর দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে মুয়াজ আবু হুরায়রা ওরফে মোয়াজ, ইফতি মোশারফ সকাল, মুজাহিদুল ইসলাম, খন্দকার তাবাককারুল ইসলাম তানভীর ও হোসেন মোহাম্মদ তোহা আবরারকে রুম থেকে বের করে নিয়ে দ্বিতীয় তলায় ওঠার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে রেখে দেন।
চার্জশিটে বলা হয়, এর মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আবরার। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আসামিরা আবরারকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য বুয়েটের চিকিৎসক ও অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন। চিকিৎসক এসে আবরারকে মৃত ঘোষণা করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিটে উল্লেখ করেছেন, আসামিরা যোগসাজশে একে অন্যের সহায়তায় ছাত্রশিবির সন্দেহে আবরারের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে তাকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছেন। তাকে হত্যার পর তারা মামলার আলামত ক্রিকেট স্টাম্প, তোষক, বালিশ, ল্যাপটপ-মোবাইল ও স্টিলের পুরাতন চাপাতি শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর রুম থেকে এবং সিঁড়ি ল্যান্ডিং স্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে একই হলের ২০১০ নম্বর রুমে রেখে দেন। ওই রুমে থাকতেন আরেক আসামি মুহতাসিন ফুয়াদ।
দুই বছরের পর আজ আবরার হত্যা মামলার রায় দেওয়া হয়। রায়ে ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনের যাবজ্জীবনের আদেশ দিয়েছেন আদালত। বুধবার (৮ ডিসেম্বর) দুপুরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন।
আসামিঃ
আসামিরা হলেন মেহেদী হাসান রাসেল, (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ১৩ ব্যাচ), মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪ ব্যাচ, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ), অনীক সরকার (১৫ ব্যাচ), মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল বিভাগ, ১৫ ব্যাচ), ইফতি মোশারফ হোসেন (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬ ব্যাচ), মনিরুজ্জামান মনির (পানিসম্পদ বিভাগ, ১৬ ব্যাচ), মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫ ব্যাচ), মাজেদুল ইসলাম (এমএমই বিভাগ, ১৭ ব্যাচ), মোজাহিদুল (ইইই বিভাগ, ১৬ ব্যাচ), তানভীর আহম্মেদ (এমই বিভাগ, ১৬ ব্যাচ), হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭ ব্যাচ), জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬ ব্যাচ), আকাশ (সিই বিভাগ, ১৬ ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭ ব্যাচ), শাদাত (এমই বিভাগ, ১৭ ব্যাচ), তানীম (সিই বিভাগ, ১৭ ব্যাচ), মোর্শেদ (এমই বিভাগ, ১৭ ব্যাচ), মোয়াজ, মনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ)।
হত্যার অভিযোগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শাখা ছাত্রলীগের দশ সদস্যকে আটক করা হয় এবং রিমান্ডে নেওয়া হয়। এরা হলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান রাসেল, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মুহতামিম ফুয়াদ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, উপ সমাজকল্যাণ সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাতুল ইসলাম জিওন, গ্রন্থনা ও গবেষণা সম্পাদক ইশতিয়াক মুন্না, ছাত্রলীগ কর্মী মুনতামির আল জেমি, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, মোজাহিদুর রহমান, মেহেদী হাছান রবিন। পরবর্তীতে আরও ৩ জন - মনিরুজ্জামান মনির, আকাশ হোসেন, শামসুল আরেফিনকে ডেমরা, গাজীপুর বাইপাস, ঢাকা জিগাতলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আবরার ফাহাদ যে কারণে স্মরণীয়ঃ
আবরার ফাহাদের মতো তরুণদের প্রাসঙ্গিকতা এখানে। একটি হাদিসের কথা বলা হয়- ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।’ সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নেয়া সওয়াবের কাজ। আবরার ফাহাদের দেয়া পোস্টে সেই দেশপ্রেমের অবস্থানটি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্যে আবরার ফাহাদ ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর ফেসবুকে পোস্টটি দেন। বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের সহজ সুবিধাপ্রাপ্তি, গ্যাসপ্রাপ্তি, নদীর পানিপ্রাপ্তির বিপরীতে বাংলাদেশের শূন্যপ্রাপ্তির মেজাজটাই তার ওই পোস্টে ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন, ’৪৭-এ দেশ ভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ছয় মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। ভারত তখন এ অনুরোধে সাড়া দেয়নি। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ লাঘবে, উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আজ ভারতকে সেই মংলা বন্দর ব্যবহারে হাত পাততে হচ্ছে। এরপর তিনি কোনো বিনিময় ছাড়া ভারতকে ফেনী নদী থেকে পানি দেয়ার বিষয়টি তির্যক ভাষায় উল্লেখ করেন। চেতনা জাগার জন্য জাতির অগ্রভাগে এ ধরনের দেশপ্রেমিকের প্রয়োজন রয়েছে। গ্যাস দেয়ার ব্যাপারে তিনি ওই পোস্টে লিখেন, কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা ও পাথর রফতানি বন্ধ করেছিল অথচ আমরা তাদের গ্যাস দেবো। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে, সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বলবে।
যেকোনো দেশের নাগরিকরা নিজেদের দেশের স্বার্থে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণামূলক পোস্ট দিতে পারেন। পাবলিক ডোমেইনে এ ধরনের পোস্ট একেবারে নির্ভুল না হলেও তিরস্কার বা শাস্তির পাওয়ার কোনো কারণ থাকে না। সে দিক থেকে আবরার ফাহাদ সঠিক কাজটি করেছেন। দেশের স্বার্থরক্ষাকারী এজেন্সিগুলো একে একে সবাই উদাসীন হয়ে যাচ্ছে। এই সময় জাতির প্রত্যাশা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনসহ নানা আন্দোলন সংগ্রামে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে তারা আবার জাতিকে জাগিয়ে তুলুক। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সচেতনতা প্রদর্শন তো প্রগতিশীলতা। আমরা যদি নিজেদের অধিকারের আওয়াজ জোরালো করতে পারি তাতে তো আমাদের লাভ। সেই হিসেবে দুর্দিনে এমন সাহসিকতাপূর্ণ কাজ করার জন্য ক্যাম্পাসে আবরারের বরিত হওয়ার কথা ছিল। দুর্ভাগ্য, তার বদলে তাকে নিজের বন্ধুদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। আমাদের দেশে ‘রতœগর্ভা’ পুরস্কার দেয়া হয় মাকে। আবরারের জন্মদাতা বাবা-মা পুরস্কার পেতে পারেন; জাতির কাছ থেকে বিশেষ সম্মান পেতে পারেন। আমরা তাদের জন্য এখনো কোনো সম্মান প্রদর্শন করতে পারিনি।
২৭ নভেম্বর আবরারের বিচারের রায়ের তারিখ ছিল। তার পরিবার এ রায়ের অপেক্ষায় রয়েছেন। বিচারক রায় পিছিয়ে ৮ ডিসেম্বর নতুন তারিখ ঘোষণা করেছেন। আমরা এ বিচার নিয়ে কিছু বলতে চাই না। আমরা আবরারকে একজন সচেতন দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে দেখি। তাই তার স্মরণ জেগে থাকার প্রয়োজন রয়েছে। এ দেশের স্বার্থেই এমন প্রয়োজন। কারণ এই সময় এমন সচেতন যুবকের অভাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন পলাশীতে আবরারের স্মৃতিরক্ষার্থে একটি স্তম্ভ নির্মাণ করেছিল। কারা যেন সেটি ভেঙে ফেলে। তারা যখন সেটি আবার নির্মাণ করে আবারো সেটি ভেঙে ফেলা হয়। সারা দেশে বিগত কয়েক বছরে অসংখ্য স্মারকচিহ্ন নির্মিত হয়েছে। এসব স্মৃতিস্তম্ভের অনেকগুলো নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। অনেকগুলো বিতর্কিত হয়েছে।
আবরার এ দেশে বিতর্কিত কোনো ব্যক্তিত্ব নন। তার মেধার ব্যাপারে কারো কোনো প্রশ্ন নেই। তিনি একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। দেশের পক্ষে ওই পোস্টটি না দিলে তাকে তখন প্রাণ হারাতে হতো না। তা হলে তার আত্মবলিদান কেন মর্যাদার হতে পারে না? পলাশীতে যারা স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙেছেন তাদের খুঁজে বের করা হোক। তাদের মোটিভ কী, সেটি জানা হোক। বর্তমান সরকার স্মৃতি রক্ষার্থে অনেক বেশি তৎপর। আমরা আশা করব, সরকার নিজে থেকে আবরারের স্মৃতি রক্ষার্থে আগ্রহী হবে। তার নামে কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হবে। বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অনেক স্মৃতিস্তম্ভের পাশে আবরারের একটি স্মৃতিস্তম্ভও থাকতে পারে।
আবরার ফাহাদকে ‘জামায়াত-শিবির’ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো ‘জামায়াত-শিবির’ হলে মারতে হবে কেন? এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি ইস্যু বানিয়ে রাখা হয়েছে। যে কাউকে এই তকমা দেয়া হলে তার জন্য কোনো আইনি সুরক্ষা যেন থাকছে না; তাকে মৌলিক অধিকার বঞ্চিত করা অধিকার হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এ ধরনের ডাহা অন্যায় করার সুযোগ আর কতকাল রাখা হবে? এ অভিযোগ তুলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অসংখ্য অন্যায়-অত্যাচার করা হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে বহু মানুষকে লাঞ্ছিত অপমানিত ও অধিকারহারা করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, এটি আসলে একটি রাজনৈতিক ঘুঁটি। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা নেয়া হচ্ছে, প্রতিপক্ষকে দমন করা হচ্ছে। এভাবে কোণঠাসা করে রাখার অপচেষ্টা অব্যাহত রাখা কোনো সভ্য জাতির জন্য মানায় না। আবরারের হত্যাকেও বৈধ করে ফেলা কিংবা অপরাধকে হালকা করার জন্য তার ‘জামায়ত-শিবির’ পরিচয় লেপন করার জঘন্য চেষ্টা হয়েছে।