
ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী এর জীবনী-Biography of Dr. Jafrullah Chowdhury
বাবার নাম: মাস্টারদা সূর্যসেন
জন্ম: ২৭ ডিসেম্বর ১৯৪১
জন্মস্থান: রাউজান উপজেলা, চট্টগ্রাম
জাতীয়তা: বাংলাদেশি
পেশা: চিকিৎসক
পুরস্কার: স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৭৭)
মোবাইল : ০২৮১১৮০৮৫
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মহান মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি যোদ্ধা। রণাঙ্গনে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে প্রাণ বাঁচিয়েছেন অসংখ্য আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধার। জাতির যেসব সূর্যসন্তান আজকের এই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এবং রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন তাদের অন্যতম তিনি।
স্বাধীন দেশে তিনি হতে পারতেন দেশসেরা সার্জন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন চিকিৎসাখাতের প্রধান ব্যবসায়ী। কিন্তু ভিন্নধাতুতে গড়া এক লড়াকু মানুষ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। স্বাধীন দেশে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন গণমানুষের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
১৯৪১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম । বড় হয়েছেন ঢাকায়। তার বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন। পিতামাতার দশজন সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। পড়াশোনা করেছেন বকশীবাজার স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা মেডিকেলে। ছাত্র ইউনিয়নের মেডিকেল শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্র অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে করেছিলেন সংবাদ সম্মেলন। ১৯৬৪ সালে ডিএমসি থেকে এমবিবিএস ও ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশে ফিরে আসেন। বৃটেনে প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিডিএমএ)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস-এ এফআরসিএস পড়াকালীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি চূড়ান্ত পর্ব শেষ না-করে লন্ডন থেকে ভারতে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার নিমিত্তে আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন এবং এরপরে ডা. এম এ মবিনের সাথে মিলে সেখানেই ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট “বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল” প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। তিনি সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য জ্ঞান দান করেন যা দিয়ে তারা রোগীদের সেবা করতেন এবং তার এই অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার “ল্যানসেট”-এ প্রকাশিত হয়।
স্বাধীন দেশে তিনি সুপারম্যান
নব্বই দশকের পর থেকে চিকিৎসা যখন বাণিজ্য হতে শুরু করেছে, তখনো সত্যিকার অর্থেই ‘সেবা’ দিয়ে যাচ্ছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। স্বাস্থ্যবীমা চালু আছে জন্মলগ্ন থেকেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ঢাকার হাসপাতালে সন্তান প্রসবের মোট খরচ ২ হাজার টাকা। সাভারে আরও কম। সিজারিয়ানের প্যাকেজ ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। ডাক্তার, ওষুধ, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার নামে অন্য কোনো বাড়তি খরচ নেই। জটিলতা দেখা না দিলে সিজার করা হয় না। আর দেশের অন্য হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে সাধারণ প্রসব নেই বললেই চলে।
১৯৮১ সালে গড়ে তোলা হয় অত্যাধুনিক ‘গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল’। অন্য সব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ওষুধের চেয়ে গণস্বাস্থ্য উৎপাদিত ওষুধের দাম প্রায় অর্ধেক। ডা. জাফরুল্লাহ নিজে কিডনির রোগী। ডায়ালাইসিস করেন সপ্তাহে প্রায় তিনবার। আর কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্যে অপরিহার্য ইনজেকশন ‘হ্যাপারিন’। বাজারে দাম ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। গণস্বাস্থ্যে উৎপাদিতটি হ্যাপারিনের দাম ২০০ টাকা। সারা পৃথিবীতে কোলেস্টেরল কমানোর জন্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ওষুধ ‘অ্যাট্রোভাসটাটিন’। গণস্বাস্থ্যে উৎপাদিত একটি ট্যাবলেটের দাম ৭ টাকা, যেখানে অন্য সবার ট্যাবলেট ১১ টাকার কাছাকাছি।
বাংলাদেশে সাধারণভাবে একবার কিডনি ডায়ালাইসিসের খরচ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাক্তার-ওষুধ মিলিয়ে আরও বেশি পড়ে যায়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫০ জন কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস করে থাকে। এর মধ্যে ১০-১২ শতাংশ দরিদ্র রোগীর ডায়ালাইসিস করা হয় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় ২০ শতাংশ রোগীর থেকে নেওয়া হয় ৮০০ টাকা। ১১০০ টাকা নেওয়া হয় ১৫ শতাংশ রোগীর থেকে। সর্বোচ্চ নেওয়া হয় ২৫০০ টাকা। তবে ২৫০০ টাকা দিয়ে যারা ডায়ালাইসিস করাতে পারেন, তারা গণস্বাস্থ্যে আসেন না। তারা অন্য নামকরা হাসপাতালে ৮ বা ১০ হাজার টাকা খরচ করে ডায়ালাইসিস করান। কিডনি রোগীর অন্য যেকোনো রোগের ডাক্তারি সেবাও দেওয়া হয় সার্বক্ষণিক, দক্ষ নার্স তো থাকেনই। এসবের জন্যে আলাদা কোনো ফি নেওয়া হয় না।
স্বাধীনতার পর থেকেই দেশীয় ওষুধ শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। কথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে কম দামে ওষুধ আমদানির প্রস্তাব বিবেচনায়ও নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
দেশীয় ওষুধ শিল্প ও নীতির বিষয়টি বুঝিয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকেও। জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে ওষুধ নীতি নিয়ে কাজ করুক। কিন্তু জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী শফিউল আযমদের সঙ্গে নেওয়ায়, চার পৃষ্ঠার চিঠি লিখে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান ডা. জাফরুল্লাহ। প্রেসিডেন্ট জিয়ার ব্ল্যাংক চেকের প্রস্তাব ফেরাতে সময় নেননি এই দেশপ্রেমিক। পরবর্তীতে এরশাদকে বুঝিয়ে ওষুধ নীতি করাতে সক্ষম হন ১৯৮২ সালে। সাড়ে ৪ হাজার ওষুধ থেকে প্রায় ২৮০০ ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়।
দেশীয় ওষুধ শিল্পের যে বিকাশ, তা ডা. জাফরুল্লাহর সেই বৈপ্লবিক ওষুধ নীতিরই সুফল। এখন ১৬-১৭ কোটি মানুষের চাহিদার ৯৫ শতাংশেরও বেশি ওষুধ বাংলাদেশ উৎপাদন করে। বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানিকারক দেশও। সবখানেই নীরবে সুপারম্যান হয়ে আছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
পুরস্কার ও সম্মাননা
ক্ষণজন্মা এই মানুষটি সমাজসেবার জন্য দেশি-বিদেশি বহু পুরস্কার লাভ করেছেন ।
যার মধ্যে নিম্নে কিছু উল্লেখ করা হলোঃ
০১। ১৯৭৪ সালে সুইডিশ ইয়ুথ পিস প্রাইজ লাভ করেন ।
০২। ১৯৭৭ সালে তিনি "স্বাধীনতা দিবস" পুরস্কার লাভ করেন।
০৩। " র্যামন ম্যাগসায়" নামক পুরস্কার লাভ করেন ১৯৮৫ সালে।
০৪। ১১৯২ সালে " লাইভ লাই হুড" পুরস্কার লাভ করেন সুইডেন থেকে।
০৫। যুক্তরাষ্ট্র থেকে "ইন্ট্যান্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ " পুরস্কার লাভ করেন ২০১০ সালে।
সাম্প্রতিক মন্তব্য
#জয়নাল আবেদিন
আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই।