পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ - The most poisonous snake in the world
পৃথিবীতে অনেক বিষাক্ত প্রাণী আছে। তাদের মধ্যে সাপ মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর ক্ষতি করে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে, সাপ প্রতিবছর বিশ্বের ৫৪ লাখ মানুষকে কামড়ায়। যার মধ্যে ৮১ হাজার থেকে ১.৩৮ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। সাপের বিষ এতটাই মারাত্মক যে মৃত্যুর আগে সামান্য সময়ও দেয় না। জ্বালা ও বিষের প্রভাবে যন্ত্রণায় মৃত্যু হয়। বিশ্বজুড়ে বিষধর সাপ এমন বিষাক্ত বিষ ব্যবহার করে যা যেকোন প্রাণীকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মৃতের মুখে পাঠিয়ে দেয়। সাপের এই বিষগুলি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে, যাতে তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারে। আসুন আমরা বিশ্বের ১০ টি বিষধর সাপ সম্পর্কে জানি, যাদের কামড় কয়েক মিনিটের মধ্যে একজন ব্যক্তিকে মেরে ফেলতে পারে।
১.কালো মাম্বা(Black Mamba)
পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ কালো মাম্বা। এটি আফ্রিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ভয়ংকর সাপ। বৈজ্ঞানিক ভাষায় একে ডেনড্রোস্পিস পলিলেপসিস (Dendroaspis polylepis) বলা হয়। আফ্রিকার আতংক এ সাপটি ভূমিতে বসবাসকারী সবচেয়ে বিষাক্ত সাপগুলো মধ্যে ৬ষ্ঠ। এরা আক্রমনের জন্য খুবই কুখ্যাত। ব্ল্যাক মাম্বা আফ্রিকার সবচেয়ে ভয়ংকর সাপ এবং সাধারণ মানুষ এদের থেকে যথেষ্ট সম্মানের সাথেই দূরে থাকে। এটি শুধু প্রচণ্ড বিষাক্তই নয় প্রচণ্ড আক্রমণাত্মকও।
এর কামড় থেকে শিকারের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। এটি ভূমিতে বসবাসকারী সকল সাপ থেকে দ্রুত গতির এবং ঘন্টায় প্রায় ১৬ থেকে ১৯ কি.মি. যেতে পারে। এর বিভিন্ন প্রজাতিও খামারবাড়ি থেকে গভীর বন পর্যন্ত ছড়িযে ছিটিয়ে বাস করে। এ প্রজাতির সাপগুলো প্রায় ৪.৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
২.বেলচারস সী স্নেক(belchers sea snake)
‘ভেনামাস’ প্রাণিকূলে সরীসৃপের মধ্যে সবচেয়ে বিষাক্ত হলো বেলচারস সী স্নেক। বৈজ্ঞানিক নাম Hydrophis Belcheri । অস্ট্রেলিয়ার উত্তর উপকূল এবং দক্ষিণ এশিয়ার উপকূলের সাগরের জলে এদের দেখা পাওয়া যায়। এই সাপের এক কামড়ে যতটুকু বিষ বের হয় তা দিয়ে প্রায় এক হাজার পূর্ন বয়স্ক মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু এই সাপটি খুবই শান্ত ও লাজুক প্রকৃতির। বিশেষ করে জেলেদের মাছ ধরার সময় জালের ভিতরে ধরা পড়ে। এই সাপ মাঝে মাঝেই ভূমিতে যায়।পানির নিচে এরা ৭৮ ঘন্টা দম বন্ধ করে থাকতে পারে। এই সময়ের মধ্যে তারা শিকার ধরে এবং বিশ্রাম নেয়।
৩.ফের-ডি-ল্যান্স (Fer-De-Lance snake)
ফের-ডি-ল্যান্স বৈজ্ঞানিকভাবে বোথরপস অ্যাসপার (Bothrops Asper) নামে পরিচিত। এর বিষ মানুষের শরীরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই এটি শরীরকে নিস্তেজ করতে শুরু করে। এগুলো সাধারণত পিট ভাইপার (Pit Vipers)। এগুলি মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। তাদের দৈর্ঘ্য ৩.৯ থেকে ৮.২ ফুট হতে পারে। ওজন সর্বোচ্চ ৬ কেজি। আমেরিকার সাপের কামড়ে অর্ধেকের মৃত্যুর জন্য দায়ী ফের-ডি-ল্যান্স। এর বিষে রয়েছে অ্যান্টিকোয়ুল্যান্ট, যার কারণে রক্ত জমাট বাঁধে না। এর কামড়ের কারণে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা রয়েছে। মহিলা ফার-ডি-ল্যান্স সাপ একসাথে ৯০টি বিপজ্জনক সাপ উৎপাদনে সক্ষম।
৪.রাসেল ভাইপার সাপ (Russell’s Viper snake)
ভয়ংকর দর্শন এ সাপটি ভূমিতে বসবাসকারী পৃথিবীর বিষাক্ত সাপগুলো মধ্যে পঞ্চম। এটি খুবই রাগী ধরনের সাপ। সম্ভবত অন্য যেকোন বিষাক্ত সাপের চেয়ে এ সাপই মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। রাসেল ভাইপারের বৈজ্ঞানিক নাম Daboia Russelii ।
এটি কুন্ডলী পাকিয়ে থাকে এবং এত প্রচন্ড বেগে শিকারকে ছোবল মারে যে পালিয়ে যাওয়ার আর কোন উপায় থাকে না। এর বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে যারা খামার বাড়ি থেকে শুরু কলে গভীর জঙ্গল পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করে। এরা সাধারনত ১ মিটার থেকে ১.৫ মিটার লম্বা হয়ে থাকে।
৫.টাইগার স্নেক(Tiger Snake)
টাইগার সাপ বিষাক্ত প্রজাতির সাপের মধ্যে ৯ম। এরাও মারাত্নক বিষ ধারি সাপ, এদের দেখলেই বুজা যায় এরা আক্রামনাত্নক সাপ। বৈজ্ঞানিকভাবে Notechis scutatus নামে পরিচিত। এদের দেহের রঙ বাদামী কালো বাঘের মতো ডোরাকাটা সাপ।এই সাপ গুলো অস্ট্রেলিইয়া তে বসবাসকারী সাপের মধ্যে একটি সাপ। এরা লম্বায় ৭ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। এরা খুব তাড়াতাড়ি বিষ তুলতে পারে। এই সাপ হিংস্র নয়, হঠাৎ করেই ছোবল দিয়ে বসে না। এরা প্রথমে মুখ হাঁ করে সাবধান করে। এদের বিষ রক্ত ও মস্তিষ্ককে অকার্যকর করে এবং শরীর প্যারালাইজড হয়ে যায়, এমন কি মৃত্যু হয়ে যায়।
৬. স-স্কেলড ভাইপার (Saw-Scaled Viper)
স-স্কেলড ভাইপার-কে বৈজ্ঞানিকভাবে Echis Carinatus বলা হয়। ভারতে উপস্থিত চারটি বড় ভাইপার সাপের মধ্যে এটি আকারে সবচেয়ে ছোট। কিন্তু এটি রাসেলের ভাইপার, ক্রাইট এবং কোব্রার সাথে প্রতিযোগিতা করে। এই সাপগুলি তাদের মুখ থেকে হিসিং শব্দ করে না। বরং, তারা তাদের ত্বকে তৈরি আঁশগুলো এত শক্তভাবে ঝাঁকিয়ে দেয় যে তাতেই শব্দ হয়। তার দংশনে ক্ষত স্থান ফুলে যায়। ব্যথা ভয়াবহ। এ কারণে শরীরের ভেতর রক্তপাত শুরু হয়। কিডনি ফেইল করে। এর দ্বারা কামড়ানো ব্যক্তিকে যদি বাঁচাতে হয়, তাহলে এক বা দুই ঘন্টার মধ্যে অ্যান্টিভেনম দিতে হবে। এর বিষ কাটানোর জন্য ভারতে ৯ ধরনের অ্যান্টিভেনম রয়েছে।
৭.র্যাটল স্নেক(Rattlesnake)
বিষধর প্রজাতির মধ্যে র্যাটল স্নেক এক ধরনের বিষধর সাপ। এই সাপের বৈজ্ঞানিক নাম হলো ক্রোটালাস। এরা বিষধর সাপের উপ পরিবার। এরা সাধারনত মরু অঞ্চলে বসবাস করে। এদের কে যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া যায়। এই সাপের লেজ এর দিকে ঝুনঝুন শব্দ করার জন্য একটা বিশেষ অঙ্গ রয়েছে। এদের প্রধান খাদ্য হলো ইঁদুর, পাখি ও অন্যান্য ছোট ছোট প্রানী। এরা সাধারনত লাফিয়ে শিকার করে। এদের বিষ ক্রিয়া খব মারাত্নক হয়ে থাকে।
এ সাপ খুব রাগি প্রকৃতির হয়। র্যাটল সাপ চোখের পলকে আক্রমণ করতে পারে। এদের বাচ্চা বড় সাপের তুলনায় বেশি বিপদজনক কারন বাচ্চাদের বিষ খুব বেশি হয়ে থাকে। সঠিক সময় চিকিৎসা না হইলে এই বিষে মানুষ মৃত্যুবরন করে। এরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বছর প্রায় ৭০০০-৮০০০ মানুষ কে দংশন করে থাকে।
৮.হাইড্রোফিলিস বেলচেরি (Hydrophis Belcheri)
অনেকে ইনল্যান্ড তাইপানকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ হিসেবে ধারনা করলেও পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ হল বেলচেরি। প্রকৃতপক্ষে এটি ইনল্যান্ড তাইপানের চেয়েও প্রায় ১০০ গুন বেশি বিষাক্ত। সমুদ্রে বসবাসকারী এ সাপটি ০.৫ মিটার থেকে ১ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এর মাথা শরীর থেকে ছোট এবং এর পেছনে মাছের মত সাতারে সহায়ক লেজ রয়েছে। এ সাপটি একবার শ্বাস নিয়ে প্রায় ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা পানির নিচে ঘুরে বেড়াতে বা ঘুমাতে পারে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত এ সাপটি খুবই ভদ্র স্বভাবের। এটি সাধারনত কাউকে কামড়ায় না। তবে বার বার একে বিরক্ত করলে এটি কামড় দিতে পারে। এ সাপটি নিয়ে বেশি ভয়ের কারনও নেই কারন এটি কাউকে কামড়ালেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিষ ডুকায় না। তবে কারো ভাগ্য খারাপ হলে এর বিষাক্ত ছোবলে ১৫মিনিটের কম সময়েই তার মৃত্যু ঘটতে পারে। মাত্র কয়েক মিলিগ্রাম বেলচেরির বিষ ১০০০ এর বেশি লোক বা ২৫ লক্ষ ইদুরকে মারার জন্য যথেষ্ট্য।
৯.ফিলিপাইন কোবরা(Philippine cobra)
পৃথিবীর সব কোবরাই বিষাক্ত এবং ভয়ানক সাপ। কিন্তু অন্যসব কোবরা থেকে ফিলিপাইন কোবরা একটু আলাদা। কোবরা প্রজাতির মধ্যে এরাই সব থেকে বেশি বিষধর। এরা প্রায় তিন মিটার দূর থেকে বিষ ছুড়ে মারতে পারে।এই সাপে কামড়ালে আধা ঘন্টার মধ্যে মৃত্যু হয়। কামড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শরীর অবশ, মাথা ঘোরানো, বমি, মেরুদণ্ডে ব্যথা, পাতলা পায়খানাসহ নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এদের বৈজ্ঞানিক নাম: Naja philippinensis । সাপটি বাদামী রঙের হয়, বয়স্ক সাপ বয়সের সাথে সাথে তাদের বাদামী চেহারা হালকা হয়ে যায়। কোবরার গড় দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৩.৩ ফুট, তবে কিছু ফিলিপাইন কোবরা ৫.২ ফুট পর্যন্ত হতে পারে ।
১০.ইনল্যান্ড তাইপন (Inland Taipan)
পৃথিবীর সবচেয়ে বিষধর সাপ ইনল্যান্ড তাইপেন। এর বিষ এই গ্রহের সবচেয়ে মারাত্মক। এই সাপ সাধারণত অস্ট্রেলিয়ার প্রান্তদেশে দেখা যায়। লম্বায় এগুলো প্রায় আট ফুটের মতো হয়ে থাকে। এক ছোবলে তাইপেন এত বিষ ছোড়ে যা ৬০-১০০ লোকের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। অথবা এতে মারা যেতে পারে এক লাখ ইঁদুর। প্রাণীবিদরা জানান, তাইপেনের এক ছোবল অন্তত ৫০টি কোবরার ছোবলের সমান। এদের বিষে আছে মারাত্দক ধরনের নিউরোটঙ্নি। যা মানুষের শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুরোপুরি বিকল করে দিতে পারে। এর ছোবল পেশি অবশ করে হার্ট বন্ধ করে দেয়। আরেকটি টঙ্নি রক্ত জমাট করে ঘন স্যুপের মতো করে দেয়। এদের বিষের আরেকটি ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে, এ বিষ মানুষের রক্তে মিশলে রক্ত শক্ত হয়ে যায়। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই সাপের মানুষ মারার কোনো রেকর্ড নেই। কারণ এগুলো অস্ট্রেলিয়ার এমন প্রান্ত এলাকায় বাস করে যেখানে লোকজন খুব একটা থাকে না। ভয়ঙ্কর বিষাক্ত হলেও স্বভাবে এরা খুব শান্ত। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Oxyuranus microlepidotus, যা স্মল স্কেলড স্নেক (Small Scaled Snake) বা ফিয়ারস স্নেক (Fierce Snake) নামেও পরিচিত।