ত্রিপুরা উপজাতির পরিচিতি - Introduction to Tripura Tribes
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে ত্রিপুরাদের অবস্থান তৃতীয়। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে এদের জনসংখ্যা ৭৯ হাজার ৭৭২ জন। টিপরা ও ত্রিপুরা একই জনগোষ্ঠী। ত্রিপুরা জাতি মোট ৩৬টি দফায় বা গোত্রে বিভক্ত। বাংলাদেশে ১৬টি গোত্রের সন্ধান পাওয়া যায় যাদের মধ্যে উপভাষা-ভেদ রয়েছে।
অবস্থান
বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করে। তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী সমতল এলাকার কুমিল্লা, সিলেট, বৃহত্তর চট্টগামের বিভিন্ন উপজেলা, রাজবাড়ি, চাঁদপুর, ফরিদপুর ইত্যাদি অঞ্চলেও বর্তমানে বসবাস করে। ত্রিপুরি একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন উপজাতি। ব্রিটিশ আমলে ত্রিপুরা ছিল একটি দেশীয় রাজ্য। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা রাজ্য ভারত ইউনিয়নে যোগদান করে। বর্তমানে ঐ ত্রিপুরা রাজ্যটিই ত্রিপুরা জাতি বা ত্রিপুরীদের মূল আবাসস্থল।
ভাষা
ত্রিপুরা জাতির ভাষার নাম ককবরক। ‘কক’ মানে ‘ভাষা’। ‘বরক’ মানে ‘মানুষ’। ‘ককবরক’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘মানুষের ভাষা’ চীন পরিবারের তিব্বতী-বর্মী উপ-পরিবারের ভাষা। এ ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই। ককবরক ভাষায় দু’ধরনের লিপিতে লেখার প্রচলন রয়েছে- রোমান ও বাংলা। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী প্রায় ১০ লাখ ত্রিপুরা ককবরক ভাষায় কথা বলে। মধ্যযুগে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী-শাষিত পূর্ববঙ্গের এক বিশাল এলাকায় ককবরক প্রচলিত ছিল।
ধর্ম
ত্রিপুরারা মূলত সনাতন (হিন্দু ধর্ম) ধর্মাবলম্বী। তবে বর্তমানে বান্দরবান জেলার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী। খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলায়ও ত্রিপুরাদের একটি অংশ বর্তমানে খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী। সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা দূর্গাপূজা, কালী পূজা, রাজ মেলা, স্বরস্বতী পূজা ইত্যাদি ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকে।
অপরদিকে খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীরা বড়দিন পালন করে। এছাড়াও ত্রিপুরারা বহুবিধ পূজা-পার্বণ করে থাকে। পূজা-পার্বণের মধ্যে ক) কের পূজা, খ) কাথারক পূজা, ৩) চুমুলাই পূজা, ৪) সাকচরাই, ৫) নাইরাং, ৬) খ্রাঙ পূজা, ৭) মৌতাই কাইমানি, ৮) খার্চি পূজা, ৯) গড়িয়া পূজা ইত্যাদি অন্যতম।
পোশাক ও অলংকার
তারা কাপড় বয়নে বেশ দক্ষ। তারা নিজেদের পরনের কাপড় নিজেরাই তৈরি করে। পুরুষেরা পরিধান করে নিজে দের তৈরী গামছা ও ধুতি। ত্রিপুরা নারীরা অলংকার প্রিয়। ত্রিপুরা নারীদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অলংকার সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে- বেংকি, বারা, কুনচি, তাল, খার্চী, অাঁচলী, রাংবাহাতাং, তয়া, ওয়াখুম, সুরাম, সাংগে, নাকে, লŠক, য়াইতাম, চাংখুং, বাতাং, কুংবার, আংতা, তালবাতাং, খানাইসেপ ইত্যাদি। অতীতে ত্রিপুরী নারীদের মতো পুরুষেরাও অলংকার ব্যবহার করতেন।
বিয়ে
ত্রিপুরা সমাজে পিতার পরিচয়েই সাধারণ সন্তানের বংশ পরিচয় নির্ধারিত হয়। তবে কোনো কোনো গোত্রে মেয়ে সন্তানরা মায়ের বংশ পরিচয়ে পরিচিত হয়। এদের একই গোত্রে বিয়ে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। গোত্র মিলিয়ে তারা বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করে থাকে। যেসব সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ত্রিপুরা বিয়ে নিষিদ্ধ থাকে সেগুলো হচ্ছে- ১. আপন ভাইবোন; ২. আপন খালা, চাচা-চাচি, মামা-মামি; ৩. আপন খালাতো ভাইবোন, চাচাতো ভাইবোন, মামাতো ভাই বোন এবং ৪. সৎ মা, সৎ ভাইবোন ইত্যাদি।
ত্রিপুরা সমাজব্যবস্থায় চার ধরনের বিবাহ ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। এগুলি হল – ১) হামজাক-লাই লামা, ২) খকয়ৈই লামা, ৩) ফারান খৌলায়ৈ লামা, ৪) চামিরি কামা। ত্রিপুরা সমাজে বিধবা বিবাহেরও প্রচলন আছে। ত্রিপুরা সমাজে বহু বিবাহ সিদ্ধ; তবে অতীতকাল থেকে এ রীতি সমাজে নিন্দনীয় ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত।
রীতিনীতি
ত্রিপুরা সমাজে শিশু জন্ম হলে জন্মের পর পর গুমাচক(দাত্রী), অচাই(পৌরহিত) মিলে ছড়া বা নদীতে যেয়ে পূজা দিতে হয়। এ পূজাকে বলা হয় – ‘কউমা বৌতৈ লানাই’। হলুদ, সুকই বমলক ও পানি মিশিয়ে ‘কউমা বৌতৈ’ তৈরি করতে হয়। সেই ‘কউমা বৌতৈ’ বাঁশের চোঙায় করে বাড়িতে নিয়ে যেতে হয়। পূজা দেওয়ার পর সেই বাঁশের চোঙার কউমা বৌতৈ-এর সাথে পূজায় বলি দেওয়া মুরগির রক্ত মিশাতে হয়। গুমাচৌকসহ যে সব নারী-পুরুষ সন্তান প্রসবের সাথে সম্পৃক্ত ছিল তাদের সবার শরীরে ‘কউমা বৌতৈ’ ছিটিয়ে দিয়ে শুদ্ধ করতে হয়। শরীর থেকে নাভি পৃথক হবার পর আবার মুরগি কেটে নদী বা ছড়ায় গিয়ে পূজা দিতে হয়। ত্রিপুরা সমাজে শিশুর জন্মসংক্রান্ত সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হল – ‘আবিয়াক সুনায় পান্ডা’ বা নামকরণ অনুষ্ঠান। ছাগল, শূকর, মুরগি কেটে এই ‘আবিয়াক সুনায়’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
খাদ্য
ত্রিপুরাদের প্রধান খাদ্য ভাত। প্রতিবেলায় ভাতের সঙ্গে থাকে সেদ্ধ সবজি, মরিচ ও ভুট্টা। তাদের শাক-সবজি সিদ্ধ মানেই এই মরিচ ও ভুট্টার উপস্থিতি। তারা বাঁসকোড়লকে চাখৈ, মৈতুরু, বাংসোং, কেসক, লাকসু, বাজি প্রভৃতি বিভিন্ন উপায়ে খেয়ে থাকে। সবজি হিসেবে ঢেড়স, কলাগাছ, মাসরুম ঝিঙ্গা, হলুদ ফুল, আদা ফুলকে তারা সিদ্ধ এবং গুদাক (বিশেষ এক প্রক্রিয়া) করে খায়। ত্রিপুরারা মাছকে রোদে শুকিয়ে আগুনে পুড়ে খেতে পছন্দ করে। তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘বৈসুক’ উত্সবে মাংস রান্নার প্রচলন রয়েছে। ত্রিপুরাদের মাংস রান্নাকে সুস্বাদু করতে একরকম বিশেষ সুগন্ধি পাতা ‘বানা’ দেয়া হয়। এছাড়া এদিন মহিলারা বিন্নি চালের পিঠা ও চোলাই মদ তৈরি করে। বৈসুকে পিঠা বেশ প্রসিদ্ধ। বিন্নিচাল, কলাপাতা এবং লাইরু পাতা দিয়ে তারা পিঠা তৈরি করে থাকে। অতিথি আপ্যায়নে ত্রিপুরাদের রয়েছে বিশেষ সুপরিচিতি।
চাষাবাদ
ত্রিপুরাদের প্রধান উপজীবীকা চাষাবাদ হচ্ছে জুম চাষ। পাহড়ের ওপরে বিশেষ কায়দায় করা হয় চাষাবাদ। পাহাড়ে এই বিশেষ ধরনের চাষাবাদকেই জুম চাষ বলা হয়। জুম চাষের প্রকৃত অর্থ হলো স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে চাষাবাদ। এ ধরনের চাষাবাদে শুকনো মৌসুমে (ফাল্গুন-চৈত্র) মাসে পাহাড়ের গাছপালা কেটে ও পুড়িয়ে এক বছর চাষাবাদের পর আবার কম পক্ষে ৪-৫ বছর পতিত রাখা হয়। এই পতিত রাখার সময়ে জমি আবার তার উর্বরতা ফিরে পায়; কিন্তু বর্তমানে জনসংখ্যার তুলনায় জমি কম হওয়ায় মাত্র তিন-চার বছর জমি পতিত রাখা হচ্ছে। জমি নির্বাচনের সময় বাঁশ, গাছ, আগাছাসহ ঢালু জমি নির্বাচন করা হয়। এরপর বাঁশ বা গাছ কেটে রোদে শুকাতে দেওয়া হয়। পরে এগুলোতে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে পুরে গাছগুলো ছাই হয়ে যায় এবং আধা ইঞ্চি মাটিও পুড়ে যায়। এই পোড়ামাটি ও ছাই জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। এরপর বৃষ্টি হয়ে মাটি একটু নরম হলে ফসল বোনা হয়। জুম চাষে একসঙ্গে অনেক ফসল বোনা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফসল ঘরে তোলা হয়। ত্রিপুরাদের জীবন যাপনের জন্য জুম চাষ অপরিহার্য একটি বিষয়। সাধারণত জুম চাষে ধান চাষ ছাড়াও আদা, হলুদ, মিষ্টিকুমড়া, কলা, ভুট্টা, তিল, তুলাসহ আরো প্রভৃতি ফসলের চাষ হয়ে থাকে।
উৎসব
ত্রিপুরাদের প্রধান সামাজিক উৎসবের নাম ‘বৈসু’। ত্রিপুরারা তিনদিন ধরে এই উৎসব উদযাপন করে থাকে। এগুলো হল – ১) হারি বৈসু, ২) বৈসুমা ও ৩) বিসিকাতাল। পুরনো বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে বাগত জানানোকে কেন্দ্র করে এ ঐতিহ্যবাহী উৎসব উদযাপন করা হয়ে থাকে।
এই তিন দিনে বিন্নি চাল দিয়ে নানান ধরনের পিঠা তৈরি করা হয়। নারী পুরুষেরা নূতন নূতন কাপড়-চোপড় পরিধান করে আনন্দে মেতে উঠে। এদিনে গান বাজনা হয়, খেলাধুলা হয়। বৈসু উপলক্ষে ৫/৭ দিন গড়িয়া নৃত্য পরিবেশন করা হয়। দল বেঁধে গড়িয়া দল গ্রামে গ্রামে ঘুরে গড়িয়া নৃত্য পরিবেশন করে। বৈসুমার দিনে ধনী-গরিব সবাই সামর্থ্যনুযায়ী নানা ধরনের পিঠা, মদ, সরবত, পাঁচন ইত্যাদি অতিথিদের পরিবেশন করে। তবে ‘বৈসুমা’র দিনে প্রানীবধ একেবারেই নিষিদ্ধ। ‘বৈসুমা’র দিনে ও গড়িয়া নৃত্য পরিবেশন করা হয়। গড়িয়া নৃত্য ছাড়াও পালা গান ও বিভিন্ন খেলাধুলা সারাদিন ধরে চলে। বিসিকাতাল দিনে নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয়। এদিকে নতুন বছরে সুন্দর ও নিরাপদ জীবনের প্রত্যাশায় সমাজের সকল বয়সের মানুষ বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট আর্শীবাদ গ্রহণ করা হয়।
বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতী নতুন কাপড়-চোপড় পরিধান করে গ্রামের ঘরে ঘরে হাঁস-মুরগি ও অন্যান্য পশু-পাখির খাবার বিলিয়ে দেয় এবং ত্রিপুরা সামাজিক রীতি অনুসারে বয়স্কদের পা ধরে সালাম করে আর্শীবাদ গ্রহণ করে। এদিনে পরিবারের সকল সদস্যের মঙ্গলের জন্য পূজা ও উপাসনা করা হয়।
ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা
ত্রিপুরাদের আউটদূর খেলাধুলার মধ্যে অন্যতম হলো সুকই, গুদু, চু বা চুর, ওয়াসৌলাই, পর খেলা, হাতিতি, ওযাক-মৌসা, ওয়াংদে ইত্যাদি এবং ইনডোর খেলাধুলার মধ্যে তকঃ, চেচঙ, পাইং, খগ্রি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
শিক্ষা
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার একেবারে কম। তবে এ বিষয়ে সরকারিভাবে কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। ১৯৯৮ সালে এডিবি কর্তৃক পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের ৬৫.৫১%, মারমাদের ৫৩.১৭%, বাঙ্গালিদের ৫২.৬০% শিক্ষার হারের বিপরীতে ত্রিপুরাদের শিক্ষার হার মাত্র ২৭.২৪%।
রাষ্ট্র ও সরকারি সুযোগ-সুবিধার বঞ্চনা, আদিবাসী বান্ধবহীন শিক্ষা নীতিমালা, শিক্ষা চেতনার অভাব ইত্যাদি কারণে ত্রিপুরারা শিক্ষা-দীক্ষায় বেশ পিছিয়ে আছে। ত্রিপুরাদের গ্রামীণ জীবন, তাদের ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বিদ্যালয় থাকে না, যুগ যুগ ধরে শিক্ষার সুবিধা থেকে বঞ্চনা, শিক্ষা দীক্ষায় ত্রিপুরাদের অনগ্রসরতার অন্যতম কারণ।
মৃত্যু সৎকার
ত্রিপুরারা সাধারণত মৃতদেহকে দাহ করে। একেবারে কম বয়সী শিশু মারা গেলে বা কোন লোক দুরারোগ্য বা ছোঁয়াচে রোগ যেমন – কলেরা, বসন্ত, কুষ্ঠ ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তাকে কবর দেয়া হয়। রীতি অনুসারে মৃতব্যক্তির সন্তানরাই প্রথম চিতায় অগ্নিসংযোগ করে। মৃতব্যক্তির সন্তান না থাকলে ঘনিষ্ঠ আত্নীয়-স্বজনরা প্রথম অগ্নিসংযোগ করে। সামাজিক রীতি অনুসারে মৃতদেহ দাহ করার সাতদিন অথবা তেরদিন পর শ্রাদ্ধক্রিয়া অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে হয়।
হস্তশিল্প
ত্রিপুরা বাঁশ ও বেতের হস্তশিল্পের জন্য উল্লেখযোগ্য। উপজাতিদের ঝুমি (বীজ বপন) এর মধ্যে বাঁশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এটি নেভিগেশন ঘড়ি স্টেশন নির্মাণ ব্যবহৃত হয়, এবং খাদ্য এবং জল বহন করার জন্য ব্যবহূত হয়।এই ব্যবহারগুলি ছাড়াও বাঁশ, কাঠ এবং বেতের আসবাবপত্র, পাত্রে, হাতবড়িত ভক্ত, প্রতিলিপি, ম্যাট, টুপি, মূর্তি এবং অভ্যন্তর প্রসাধন সামগ্রী তৈরি করার জন্য ব্যবহৃত হয়।