
রাজবংশী উপজাতির পরিচিতি - Introduction to Rajvanshi tribe
রাজবংশী বাংলাদেশে বসবাসরত একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাদেরকে ক্ষত্রিয় নামক এক কোচ শাখার সঙ্গেও অভিন্ন বলে অনেকে মনে করেন। দূরাতীত কালে হিমালয় অঞ্চল বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে আগত রাজবংশীরা খর্বকায়, চ্যাপ্টা নাক, উঁচু চোয়ালবিশিষ্ট এক মিশ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ। এরা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। বর্তমানে এদের কেউ কেউ মুসলমান, কেউবা খ্রিস্টান। বাংলাদেশে এদের বসবাস প্রধানত রংপুর, দিনাজপুর ও রাজশাহী এবং অতি অল্পসংখ্যায় বগুড়া ও ময়মনসিংহ জেলায়। ১৯৪১ ও পরবর্তী আদমশুমারিতে রাজবংশীদের হিন্দু জনগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এদের মোট জনসংখ্যা পাঁচ হাজারের একটু বেশি।
পেশা
রাজবংশীরা মূলত কৃষিজীবী, তবে মাছধরা এবং মাছ বিক্রয় এদের অন্যতম পেশা। মেয়েরা কুটির শিল্পের কাজে দক্ষ। পিতাই পরিবারের প্রধান। পিতার মৃত্যুর পর পুত্রসন্তান সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে।
পোশাক,অলঙ্কার
রজবংশীরা ধুতি ও জামা পরে। বিয়ের সময় বর কনে উভয়ই পাড়বিহীন সাদা কাপড় পরে। আগে রাজবংশী নারীরা চারহাত দৈর্ঘ্য এবং আড়াই হাত প্রস্থের হাতে বোনা মোটা ধরনের বহু বর্ণ রঞ্জিত এক বস্ত্র পরিধান করতো। এটিকে বলা হতো ‘ফতা’। বর্তমানে সুতার অভাবে এটি আর তৈরি হয় না। নারীরা বিভিন্ন ধরনের গহনা ব্যবহার করেন। চুলের অলংকার হিসেবে তারা সিঁথা-পাটি, সেঁদ, বন ব্যবহার করেন। ওন্তি, এন্তি, সাদিয়া-পাত, গুজি, সোনা, সিসা, চাকি, সাকিরি প্রভৃতি হচ্ছে তাদের কানের অলংকার। গলায় সূর্যহার, চন্দ্রহার, শিকইল হার, কাঠি-মালা, ছোরা-কাঠি প্রভৃতি অলংকার ব্যবহার করে। কোমরে গোটা-খারু, গোকুল খারু, মোটা খারু, মুটিয়া-খারু, বাউটি-চুরাতি, রতনচুর এবং হাতে মোটা-খারু, শাঁখা-খারু, গজরা, সোমপাত্তি প্রভৃতি পরে। রাজবংশীরা বিভিন্ন গোত্রনাম গ্রহণ করেছে। তাদের গোত্রগুলি হলো: কাশ্যপ, শান্ডিল্য, পরাশর, ভরদ্বাজ, গৌতম, সবর্ণ, কপিল প্রভৃতি।
অনুষ্ঠান
গর্ভাধান: আগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের অল্পবয়সেই বিবাহ হতো। সেসময় বিবাহিতা যখন প্রথম ঋতুদর্শন করতো, তখন অন্যান্য সধবারা তার বক্ষস্থল ঘিরে আগ্রান নামক কাপড় বেঁধে দিত। এই দিন থেকে ওই মেয়ে যুবতী হিসেবে স্বীকৃতি পেতো। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিবাহের আগেই ঋতুমতী হলে, তাকেও আগ্রান গ্রহণ করতে হতো। বর্তমানে এই প্রথা অনেকাংশে শিথিল হয়ে গেছে।
জন্মোৎসব: গর্ভবতীর আসন্ন প্রসবকালে সূতিকা ঘর নির্মাণ করা হয়। শিশুর জন্মদিন থেকে পরবর্তী ৩১দিন জন্মাশৌচ থাকে। এই সময় এরা সূতিকাঘরের দরজা-জানালা, দেওয়ালে কাঁটা গাছের ডাল ঝুলিয়ে ভূতকে ঠেকানোর ব্যবস্থা করে। এরপর পুরোহিতের নির্দেশ মতো ৩ থেকে ৩০ দিনের ভিতরে শিশুর নামকরণ করা হয়। এর ভিতরে ১৩ দিনের মাথায় শিশুর ক্ষৌরকর্ম করা হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বৈষ্ণবপন্থী রাজবংশীরা জন্মের পরপরই শিশুর কানে হরিনাম শোনানো হয়।
অন্নপ্রাসন: পুরোহিতদের বিধান মতে শিশুর অন্নপ্রাসন করা হয় ৭ থেকে ১১ মাসের ভিতরে। কোনো সধবা মহিলা শিশুটিকে কুলা, প্রদীপ ও মঙ্গলসূত্র দিয়ে বরণ করে।
বিবাহ
রাজবংশীদের বিবাহ প্রথায় সাঁওতাল, ওরাওঁদের বিবাহরীতির প্রভাব যথেষ্ট। বিবাহ বিচ্ছেদ, পুনর্বিবাহ ও বিধবা বিবাহ সমাজে প্রচলিত। তবে বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রে দেবরদের দাবি অগ্রগণ্য।
মৃত্যু সৎকার
রাজবংশীরা মৃতদেহ পুড়িয়ে সৎকার কাজ সম্পন্ন করে। একমাস পর মৃত ব্যক্তির জন্য শ্রাদ্ধকর্ম অনুষ্ঠিত হয়।
ভাষা
রাজবংশীদের কোন লেখ্য ভাষা বা বর্ণমালা নেই। এদের ভাষা স্থানিক তথা আঞ্চলিক ভাষার এক মিশ্ররূপ। ভাষা বিচারে এরা বৃহত্তর বোড়ো ভাষা গোত্রভুক্ত হলেও বর্তমানে তা লুপ্ত হয়ে গেছে। এই ভাষার কোনো নিজস্ব লিপি ছিল না। এদের সাহিত্যের-নিদর্শন কোনো লিপিতেই রচিত হয় নি। এদের ভাষায় ‘বোড়ো ভাষার উৎস জাত শব্দাবলী ও বোড়ো ভাষার অপভ্রংশ শব্দ পরিলক্ষিত হয়। এদের ভাষায় বাংলা ক্রিয়া পদে ও বিশেষ্য পদের শেষে ও মাঝে ‘ঙ’, ‘ং’ এবং ‘ম’-এর উচ্চারণ ও ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এসব শব্দ রাজবংশীদের কথ্য ভাষায় বহুল প্রচলন রয়েছে।
ধর্ম
ধর্মের বিচারে এরা বহু-ঈশ্বরবাদী। আদিতে এদের প্রধান দেবতা ছিল শিব। কালক্রমে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সূত্রে বৈষ্ণবপন্থী ধর্ম-দর্শন চালু হয়েছে। রংপুর ও কোচবিহারের রাজবংশীদের অধিকাংশই বৈষ্ণব ও শৈব। অন্যান্য অঞ্চলে এই দুই পন্থী ছাড়াও প্রকৃতি-পূজারী দেখা যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শৈব, বৈষ্ণব, বৌদ্ধ, তান্ত্রিক প্রভৃতি বিশ্বাসের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। তাই এদের দেবতার তালিকায় পাওয়া যায় শিব, বিষহরী (মনসা, দুর্গা, কালী (শ্যামা), লক্ষ্মী, জগন্নাথ, নারায়ণ, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবদেবীদের। এর বাইরে রয়েছে প্রাচীন কৃষিসংস্কৃতির প্রতীক ‘বারিধারা’ ব্রত কিংবা উর্বরতা ও প্রজননের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্রত বা অনুষ্ঠানাদি এবং এদের সাথে যুক্ত দেবদেবী। যেমন শস্য রোপণের পূর্বে এরা বলিভদ্র ঠাকুরের পূজা করে। আবার খরা, অনাবৃষ্টি উপলক্ষে ‘হুদুমা’ পূজা করে। প্রকৃতি উপাসক হিসেবে এরা পাহাড়, নদী, অরণ্য ও মৃত্তিকার পূজা করে। সংসারের মঙ্গল কামনায় এরা বাস্তুদেবতা হিসেবে 'বাহাস্তো' বা 'বাহুস্তো' পূজা করে। এরা হিন্দুদের মতো এরা শবদাহ করে। তবে, কুষ্ঠরোগী, শিশু ও সর্পদংশনে মৃতদের মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলা হয়।
আপনার মতামত লিখুন