সাপে কামড়ালে প্রাথমিক চিকিৎসা - First aid for snake bite
সাপে কাটার সঙ্গে ‘আতঙ্ক’ শব্দটি জড়িয়ে আছে। তবে সাপে কাটলেই যে বিষক্রিয়া হবে, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। অনেকের জানা, দেশে বিষধর সাপের চেয়ে নির্বিষ সাপের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু অপচিকিৎসা ও অজ্ঞতার কারণে আক্রান্ত মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৯১৯ জন সাপের কামড়ের শিকার হয়। এদের মধ্যে বছরে মারা যায় ৬ হাজার ৪১ জন। আশঙ্কার বিষয় হলো, এর মধ্যে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ।
বিষধর সাপ কত প্রকার
বিষধর সাপ প্রধানত দু’টি লম্বা, বাঁকানো ও নালিযুক্ত দাঁত থাকে। দাঁত দু’টি উপরের চোয়ালের সাথে যুক্ত এবং মিউকাস পর্দা দ্বারা আবৃত। সাপের কামড়ের সময় দাঁতগুলো সামনের দিকে সামান্য সোজা হয়ে যায় এবং শিকারের দেহে প্রবেশ করে। এ লম্বা দাঁতের পাশাপাশি ছোট দাঁত থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে।
সাপের বিষ মূলত সাপের লালা আর বিষগ্রন্থি হলো বিশেষায়িত লালাগ্রন্থি। এ বিষগ্রন্থিগুলো চোখের পেছনে নিচের দিকে থাকে। গ্রন্থি থেকে নালির মাধ্যমে বিষ দাঁতে সঞ্চারিত হয়। যখন সাপ দংশন করে, তখন ওই লম্বা দাঁতের নালির মাধ্যমে বিষ আক্রান্তের দেহে প্রবেশ করে।
বিষক্রিয়া কিছু সাপের দংশনের লক্ষণ
বাংলাদেশে প্রায় ৮০ প্রজাতির সাপের মধ্যে বিষধর সাপ রয়েছে ২২ প্রজাতির। বিষধর সাপ দংশন করলে শরীরে বিষক্রিয়ার কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন- ক্ষতস্থানে বিষদাঁতের দু’টি দংশনের চিহ্ন, ক্ষতস্থান থেকে অনবরত রক্তপাত, ক্ষতস্থান অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠা, প্রচণ্ড ব্যথা, কখনো কখনো সমস্ত শরীর ফুলে যাওয়া, খাবার ও ঢোক গিলতে অসুবিধা, শ্বাসকষ্ট, চোখে ঝাপসা দেখা ও চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসা, ঘুম ঘুম ভাব, হাত-পা অবশ হয়ে আসা ও অচেতন হয়ে পড়া, ঘাড় সোজা রাখতে না পারা, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রভৃতি।
সাপে কামড়ালে প্রাথমিক চিকিৎসা
সাপ কামড়েছে জানলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। সাথে সাথে আপনার যা করনীয় –
১.সাপে কামড়ানো জায়গা তৎক্ষণাৎ পরিষ্কার ব্যান্ডেজ বা সুতির কাপড় দিয়ে ঢেকে দিন, যাতে ধুলোবালি না লাগে।
২.সাবান জল দিয়ে ক্ষতস্থানটা ধুয়ে ফেলা ও শরীরের যে অংশে সাপ কমড়েছে সেটা যতটা সম্ভব স্থির করে রাখা।
৩.সাপে কামড়ানো ব্যক্তিকে কখনোই কাত করে শোয়ানো যাবে না। সব সময় সোজা করে শোয়াবেন। তার বুকের নিচে কিছু একটা দিয়ে বুকটা উঁচু করে রাখুন কিংবা রোগীকে এমনভাবে শোওয়ান যেন কামড়ের স্থান হৃদযন্ত্র বরাবর কিছুটা নিচের দিকে থাকে। অর্থাৎ রোগীর আক্রান্ত স্থানকে হার্ট লেভেলের নিচে রাখতে হবে।
৪.রোগীকে আশ্বস্ত করুন। কারণ রোগী খুবই আতঙ্কের মধ্যে থাকে। আতঙ্কও মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। রোগীকে বোঝান, সাপের কামড়ে আক্রান্ত বহু মানুষ চিকিৎসায় বেঁচে উঠেছেন, আপনিও নিশ্চিন্তে থাকুন।
৫.সাপ যদি হাতে বা পায়ে কামড় দেয় তাহলে বাঁধন দিতে হবে। বাঁধনটি যেন খুব বেশি শক্ত না হয়। বাঁধনটি এমনভাবে দিতে হবে যেন একটা আঙুল ওই বাঁধনের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। দংশিত স্থানের কিছুটা ওপরে দড়ি বা হাতের কাছে যা পান, তা দিয়েই বেঁধে ফেলুন।
৬.সাপে কাটলে আতঙ্কিত না হয়ে নিরাপদ স্থানে বসে থাকুন। দংশিত স্থান কিছুতেই কাটাছেড়া করা উচিত নয়। কেবল ভেজা কাপড় দিয়ে কিংবা জীবাণুনাশক মলম দিয়ে ক্ষতস্থান মুছে দিতে হবে।
৭.কোন সাপ কামড়েছে, সেটা জানা দরকার। কিন্তু সাপ ধরার চেষ্টা করার দরকার নেই। সম্ভব হলে মোবাইলে ছবি তুলে বা ভিডিও করে রাখতে পারেন। সাধারণতঃ চিকিৎসকরা অ্যাণ্টিভেনম (সাপের বিষের প্রতিরোধক) ব্যবহার করেন। দুরকমের অ্যাণ্টিভেনম এখন পাওয়া যায়। এগুলি ব্যবহার করলে কিছু কিছু লোকের বিরূপ প্রতিক্রিয়াও হয়, সেইজন্য ডাক্তারদের এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
সাপে কাটলে কখনো করা উচিত নয়
আমাদের দেশে অনেক ক্ষতিকর প্রাথমিক চিকিৎসা প্রচলিত যা ওঝা ও সর্প-চিকিৎসকরা দিয়ে থাকেন। এ থেকে অনেক সময় রক্তপাত, ধনুষ্টংকার ও পঁচনসহ অন্যান্য অসুবিধা হয়।
* দংশিত স্থান ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে রক্তক্ষরণ করানো।
* একাধিক স্থানে খুব শক্ত করে গিঁট দেয়া।
* কার্বলিক এসিডজাতীয় রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে দংশিত জায়গা পোড়ানো।
* গাছ-গাছড়ার রস দিয়ে প্রলেপ দেয়া।
* বমি করানোর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার।
* কানের ভেতর বা চোখের ভেতর কিছু ঢেলে দেয়া।
সর্প দংশন প্রতিরোধের উপায়
১. বেশিরভাগ সর্প দংশনের ঘটনা হয়ে থাকে পায়ে। কাজেই সাপ থাকতে পারে এমন জায়গায়, যেমন- ঘাসের মধ্যে কিংবা ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর হাঁটার সময় বিশেষ সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। এজন্য পায়ে লম্বা জুতা বা বুট ব্যবহার করা উচিত এবং অন্ধকারে হাঁটার সময় টর্চলাইট, লাঠি ইত্যাদি সঙ্গে রাখতে হবে।
২. কখনো সাপ সামনে পড়ে গেলে ধীর-স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত। সাপ প্ররোচনা ছাড়া অনর্থক দংশন করে না।
৩. বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখুন। শয়নকক্ষের সাথে খাদ্যসামগ্রী, যেমন- ধান-চাল কিংবা হাঁস-মুরগি, কবুতর ইত্যাদি না রাখাই ভালো।
৪. ঘুমানোর সময় মেঝেতে না ঘুমিয়ে খাটের ওপর মশারী ব্যবহার করে ঘুমাবেন। রাতের বেলায় মাচায় শোয়ার ব্যাপারেও বিশেষভাবে সতর্ক থাকুন।
৫. কোনো গর্তের মাঝে হাত কিংবা পা দেবেন না ও স্তূপিকৃত লাকড়ি অথবা খড় খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করুন।
৬. মাছ ধরার সময় ‘চাই’ কিংবা ‘জাল’র মধ্যে হাত দেওয়ার আগে সাপ আছে কি-না তা দেখে নিন।